ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

একজন সমাজকর্মী বলছি…

সেতারা কবির সেতু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪২, ২৮ অক্টোবর ২০২০  
একজন সমাজকর্মী বলছি…

সালটি ছিল ২০১৩। তখন আমি অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী। সমাজকর্ম বিভাগ থেকে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ফিল্ডওয়ার্ক করতে হয়। সেসময় আমি ফিল্ডওয়ার্ক করি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগে। হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগে কাজ করার সময় আমি দেখেছি, মানুষ কতো অসহায় থাকে। জীবন কতো কষ্টের হয়। শিক্ষানবিশ সমাজকর্মী হিসেবে আমার কাজ ছিল-

১. রোগীকে হাসপাতালের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করা। 

২. বহির্বিভাগের রোগীকে ডাক্তার দেখাতে সাহায্য করা। 

৩. রোগীর কোনো পরীক্ষা দিলে তা করাতে রোগীকে সহায়তা করা। 

৪. যদি রোগীর অপারেশনের প্রয়োজন হয়, তাহলে অপারেশন করাতে রোগীকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলা। 

৫. রোগীর যদি রক্ত বা হুইল চেয়ারের প্রয়োজন হয়, তার ব্যবস্থা করা। 

৬. রোগীকে যদি অন্যকোনো হাসপাতালে রেফার করে, তাহলে সেই হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা। 

৭. রোগীর আত্মীয়স্বজনদের মানসিকভাবে সমর্থন দেওয়া। 

৮. রোগীর সঙ্গে পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন করা। 

৯. রোগীকে নিয়মিত ফলোআপে রাখা। 

১০. রোগীর সার্বিক বিষয় নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা। 

১১. দরিদ্র বা অসহায় রোগীর চিকিৎসার খরচ কমাতে বা ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আবেদন করা। 

১২. রোগী সুস্থ হলে তাকে নিজ বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা করিয়ে দেওয়া। 

১৩. কোনো দরিদ্র রোগী মারা গেলে তার লাশ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে দাফন করা পর্যন্ত যাবতীয় খরচ দেওয়ার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরে আবেদন করা। 

সর্বপরি একজন সমাজকর্মী বিশ্বাস করে, প্রতিটি মানুষের সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে। সময় ও সুযোগের জন্য মানুষ হয়তো সেই প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে না। তাই, সমাজকর্মীর অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব সম্পদ ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে, ব্যক্তিকে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করা, ব্যক্তিকে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সমাজসেবা বিভাগে কাজ করার সময় অনেক দরিদ্র, অসহায় মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছি। ২০১৩ সালে রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় অনেক শ্রমিক আহত হয়। তাদের অনেককেই ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। সেই সময় তাদের জন্য রক্ত সংগ্রহ থেকে শুরু করে তাদের সুচিকিৎসার জন্য অনেক কাজ করা হয়েছে। কাজ শেষ করে দিন শেষে যখন বাড়ি ফিরতাম, তখন আলাদা এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করতো। ভালো লাগতো এটি ভেবে, প্রতিদিন কোনো না কোনো অসহায় মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি।

হাসপাতালে কাজ করার সময় বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিছু কিছু ঘটনা মনকে ব্যথিত করেছে। ঢাকা মেডিকেল ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালের দুটি ঘটনা আজকে বলবো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিচ তলায় সাধারণ ওয়ার্ডে রিংকি নামের এক ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় পুরাতন এক রোগীকে ফলোআপ করতে গিয়ে। রিংকির মুখটা মায়াতে ভরা। বাবা-মায়ের সঙ্গে দুষ্টুমি করছে। কাজ শেষ করে আমি রিংকির বেডের কাছে এসে তাদের দিকে মুগ্ধতার সঙ্গে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর আমার সহপাঠী আসলো। রিংকিকে ফলোআপ করছে। হঠাৎ আমার বুকের ভিতরটা আঁতকে উঠলো। বান্ধবীকে কাছে ডাকলাম, জিজ্ঞেস করলাম পেসেন্ট কি রিংকি? বান্ধবী আমাকে যা বললো, তা শুনে আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। মায়াতে ভরা মিষ্টি মুখ, ছোট্ট পরী রিংকি ব্লাড ক্যান্সারের পেসেন্ট। 

আহা! ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ভাবতে থাকি পৃথিবীতে মানুষ কতো অসহায়। পরীর মতো সুন্দর এই মেয়েটি জানে না তার কী হয়েছে। অসীম কষ্ট হৃদয়ে চেপে রেখে তার বাবা-মা কতো সাবলীলভাবে তার সঙ্গে অভিনয় করে চলছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে থাকি, এটাই জীবন। আগামীকাল রিংকিকে ব্লাড দিতে হবে ডোনার রেডি আছে। কিন্তু যখন ব্লাডের প্রয়োজন, তখন ডোনার আর ফোন ধরছে না। সেসময় রিংকির বাবা-মা অসহায়ের মতো চারিদিকে ছোটাছুটি করছে। আমার বান্ধবীর সঙ্গে রিংকির ব্লাড গ্রুপ মিলে যায়। পরে বান্ধবী রিংককে ব্লাড দেয়। 

সেদিন রিংকির বাবা-মায়ের অসহায়ত্ব আমি দেখেছি। কলিজার টুকরো সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের ব্যাকুলতা আমি অনুভব করেছি। আমাদের জায়গা থেকে আমাদের সাধ্য অনুযায়ী আমরা রিংকিকে সহায়তা করেছি। শুনেছিলাম পরবর্তী সময়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য রিংকিকে ভারতে নিতে হবে। তার আগেই আমাদের কর্ম দিবসের মেয়াদ পূর্ণ হলে আমরা চলে আসি। 

বারডেম জেনারেল হাসপাতালে ফিল্ডওয়ার্ক করি ২০১৫ সালে। তখন আমি মাস্টার্সে পড়ি। সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হতো। একদিন সমাজসেবা অফিস ছুটি হওয়ার কিছু আগে একজন রোগী আসেন। অন্যদের মতো আমিও ওইদিন আমার কাজ ম্যামকে দেখিয়ে বাসায় আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ম্যাম আমাকে ডেকে বললেন, রোগীর কিছু টেস্ট করাতে হবে তুমি সঙ্গে থেকে যতটুকু পারো করে দিও। 

রোগী বয়স্ক। বিভিন্ন সমস্যার কারণে তাকে হুইল চেয়ার ব্যবহার করতে হয়। রোগীর সঙ্গে ছিল তার ছেলে। আমি তাদের নিয়ে নিচে গেলাম। সম্ভবতো ১৫ নং কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে টেস্টের জন্য অপেক্ষা করছি। উনার ছেলে আমার কাছে এসে বললো আপু আমার হাতে একদম টাকা নেই। আমি এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসি আপনি ততক্ষণ আমার বাবাকে একটু দেখবেন প্লিজ। আমি তাকে বললাম ঠিক আছে আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।

আমাদের সিরিয়াল আসলো। আমি রোগীকে নিয়ে পরীক্ষার রুমে গেলাম। উনাকে চেয়ার থেকে বেডে নিতে হবে। আরেক জনের সাহায্য নিয়ে আমি রোগীকে বেডে তুললাম। টেস্ট শেষ হলে আবার চেয়ারে বসালাম। আমি উনার পা ঠিক করে দিলাম। রোগীর আরও একটি টেস্ট ছিল। রোগীর সঙ্গে কেউ নেই, আমি একা। ততক্ষণে আমাদের অফিসও বন্ধ হয়েছে। সবাই চলে গিয়েছে। আমি রোগীকে দুইতলায় রেখে আবার কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে স্লিপ কাটলাম। উনাকে নিয়ে কখনো এই রুমে, কখনো ওই রুমে, নিচতলা, উপরতলায় যেতে হলো।

আমি খেয়াল করলাম ভদ্রলোক অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যখন উনাকে চেয়ারে বসিয়ে উনার পা ঠিক করে দিচ্ছি, তখন উনি আমার হাতটা ধরে বলে মা তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না! আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম, না আঙ্কেল আমি ঠিক আছি। বিকেল হয়েছে অথচ উনার কিছুই খাওয়া হয়নি। আমি উনাকে ক্যান্টিনে নিয়ে কিছু নাস্তা করালাম। ৫টায় বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাবো। আমি উনার হিস্ট্রি শুনলাম। উনার সঙ্গে আমিও ডাক্তারের রুমে গেলাম। উনার সব সমস্যার কথা ডাক্তারকে বললাম। কি কি টেস্ট করানো হয়েছে সেগুলো বললাম। ফাস্টিং ও নাস্তার পর ডায়াবেটিস কতো থাকে সেই রিপোর্ট দেখালাম। আমরা যখন চলে আসবো, তখন ডাক্তার উনাকে বললো আপনি খুবই ভাগ্যবান এমন একটি মেয়ে আপনার আছে।

সন্ধ্যা হতে যাচ্ছে। আমার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে। কারণ, আমার ছোট্ট ছেলে রাকিন বাসায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কাজ শেষ, কিন্তু উনাকে একা রেখে আমি আসতে পারছি না। কিছুক্ষণ পরেই উনার ছেলের ফোন। আমাকে বলে আপু আপনারা কোথায়? আমি হাসপাতালে এসেছি। আমি উনার ছেলেকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে দ্রুত বাসায় চলে আসি।

দুইদিন পর উনার ছেলে এসেছে অফিসে। আমি তখন নবম তলায় কাজ করছি। অফিস থেকে আমাকে ফোন দিয়ে নিচে আসতে বলা হলো। আমার জন্য তার মায়ের হাতের রান্না করা খাবার এনেছেন। আমাকে এখনো মাঝে মাঝে ফোন দেয়। আমার খোঁজ খবর নেয়। তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। ফোন রাখার পর আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। আমি ভাবতে থাকি কিছু ভালো কাজ মানুষ কখনোই ভুলতে পারে না। 

আমি উপলব্ধি করি, আসলে কাজ করার জন্য করা, আর কাজকে ভালোবেসে করা এক কথা নয়। কাজকে যখন আপনি ভালোবাসবেন, কাজই তখন আপনাকে বহুগুণে প্রতিদান দেবে।

লেখক: সমাজকর্মী। 

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়