ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

স্বাধীন মানুষ কিন্তু পরাধীন নারী 

আরোশি আঁখি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৮, ২৬ জানুয়ারি ২০২১  
স্বাধীন মানুষ কিন্তু পরাধীন নারী 

নারী শব্দটার সঙ্গে অবলা আর অবহেলা শব্দটা যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। মানসিক ও শারীরিক আঘাত সহ্য করতেই মনে হয় নারীর জন্ম হয়েছে। জন্ম থেকে শুরু বৃদ্ধ পর্যন্ত তার দায়ভার বয়ে বেড়ায় কোনো না কোনো পুরুষ। যেমন বাবা, স্বামী এবং সন্তান। যদিও দিন পাল্টেছে, নারীরা এখন গুটি গুটি পায়ে নিজের লক্ষ্য অর্জনে প্রস্তুত, কিন্তু কমেনি নারীর প্রতি সহিংসতা। 

ঘরে-বাইরে বা অফিসে কোথাও তৈরি হয়নি নারীর শতভাগ নিরাপত্তা। অবহেলা অবমাননার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে তথাকথিত এই পুরুষ সমাজ। যেখানে একজন নারীর পরিচয় মা, মেয়ে, অর্ধাঙ্গী, সেখানে এই সমাজের কিছু নরপিশাচ তাদের বিভিন্ন নোংরা নামে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। শিশুরাও পাচ্ছে না মুক্তি। তাই তো এখনই সময় নারীর প্রতি সহিংসতারোধে সবাইকে এক হয়ে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যখন নারীরা পাবেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি, তখনই দেশ পাবে ভিন্নধর্মী সফলতা এবং পরিচয়।         

‘‘হয়তো নারী বটের ছায়া দিতে পারেনি, কিন্তু নারী নিম গাছের মতো সমস্তটা দিয়ে আগলে রাখতে ভুলেনি।’’

নারী যেই শব্দের সঙ্গে মিশে আছে, আমরা সব পারি। না না হয়তো নারীর একার পক্ষে বিশ্বজয় সম্ভব নয়, অবশ্য তা পুরুষের দ্বারাও সম্ভব হয়নি নারীর সহায়তা ছাড়া৷ কিন্তু নারী যেটা পারেন, তা হলো সহ্য করা। যুগের পর যুগ নারীরা কেবল তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতা সহ্য করে চলছেন। অনেকেই প্রতিবাদের ভাষা জানিয়েছেন, তবে অধিকাংশ ঘটনা আড়ালেই চেপে সব পারি শব্দটাকে বাহবা জানিয়েছেন। যদিও শখ করে নয়, কেবল লোক লজ্জা ও ভয়ে।

পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে তথাকথিত সোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্র চোখে পড়ে নারীর প্রতি অবমাননা। দিন দিন উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এই সহিংসতার মাত্রা। একজন নারী যার উপর ঘরে, বাইরে সব জায়গায় উঠতে বসতে চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত হোক বা অপ্রতিষ্ঠিত নারীরা কোথাও পাচ্ছেন না সঠিক নিরাপত্তা। 

বাচ্চা থেকে বৃদ্ধা সবার প্রতি সহিংসতার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী হয়ে জন্মানো কি আজন্ম পাপ হয়ে রয়ে যাবে? এই প্রশ্ন থেকেই যায়। ইদানীং ফেসবুক নামক সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিনেত্রী হোক বা যে কোনো নারী, তাদের কমেন্ট বক্সে দেখা মেলে একদল বিকৃত মস্তিষ্কের পরিচয় দেওয়া পুরুষের। এই বিকৃত একদল মানুষ যেন কেবল নারীর ত্রুটি খুঁজতেই ব্যস্ত।

বিভিন্ন ধরনের পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, নারীরা নানাভাবে হচ্ছেন সহিংসতার শিকার। আর প্রধানত সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে যা, তা হলো যৌন নির্যাতনের আধিক্য। করোনাকালে যৌন নিপীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকাংশেই। 
তাছাড়াও ইভটিজিং, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, গলায় ফাঁস দিতে বাঁধ্য করা, অমানবিক নির্যাতন করা ছাড়াও এসিড নিক্ষেপের মতো ভয়নক জিনিসও সমাজে বিদ্যমান। তবে, আগের মতো নেই এই বিষয়টা। 

জাতিসংঘ থেকে বলা হয়, সহিংসতা হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে নারী ও পুরুষের মধ্যকার ঐতিহাসিক অসম ক্ষমতা সম্পর্কের প্রকাশ। আর নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে প্রধান সামাজিক কৌশলগুলোর মধ্যে একটি, যার দ্বারা নারীকে পুরুষের অধীনস্থ অবস্থানে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়।

২০১৫ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি বিবাহিত মহিলা বা মেয়েরা সঙ্গীদের থেকে নানা মাত্রার নির্যাতনের শিকার। তাদের মধ্যে অধিকাংশ নারী শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হয়েছেন। যাদের সিংহভাগ কখনো কাউকে কিছু  জানায়নি।  ০৩ শতাংশেরও কম ভুক্তভোগী আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ২০২০ সালের প্রথম ৯ মাসে কমপক্ষে ২৩৫ জন নারীকে তাদের স্বামী বা স্বামীর পরিবার হত্যা করেছেন বলে জানা গেছে। 

নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্যমতে, নারী ও মেয়েদের জন্য সরকারের ৯টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কোনো একটির মাধ্যমে আইনি মামলা দায়ের করা ১১,০০০ এরও বেশি নারীর মধ্যে কেবল ১৬০টি ঘটনার সফলভাবে দণ্ডাদেশ এসেছে, যা প্রায় এক শতাংশ মাত্র। বাকি কেস বিচারহীনভাবেই রয়ে গেছে। 

এখনই সময় টেনে ধরতে হবে নারীর বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া সহিংসতার লাগাম।  আর গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের দুর্গ৷ একজন নারী সমাজে অনেক পরিচয় বহন করে, তাই তাদের সুরক্ষা অবশ্যই রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এই সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব নয়। ঘরে ঘরে দেখা যাবে এমন সমস্যা বিদ্যমান।  সমাজের নারী পুরুষ সবাকেই এগিয়ে আসতে হবে এই সমস্যা দূর করতে। সতর্ক করতে হবে প্রতিটা ব্যক্তিকে।  

প্রচলিত একটি কথা আছে ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন’। তাহলে প্রশ্ন হলো নারীরা কেন পরাধীন? নারীরা কি মানুষ নয়? এ প্রশ্নের উত্তর সমাজ এবং রাষ্ট্রকেই খুঁজে বের করতে হবে। তাহলেই কেবল নারী ও মানুষের বৈষম্য দূর হবে। মানুষের মুক্তি মিলবে।   

লেখক: শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

ইবি/মাহি  

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়