ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘নারী দিবস নয়, চেয়েছি মানুষ দিবস’

তাসফিয়া আফরিন ফারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ৮ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১২:০০, ৮ মার্চ ২০২১
‘নারী দিবস নয়, চেয়েছি মানুষ দিবস’

নারীর জন্য আগামীর পথ সহজ করতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে যারা প্রতিনিয়ত কাজ করে চলছেন, এমন ছয়জন নারীর মতামত সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সমাপনী বর্ষের শিক্ষার্থী তাসফিয়া আফরিন ফারিয়া। 

বাসে নারীর জন্য সংরক্ষিত আলাদা আসন, সংসদে ৫০টি নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন, নারী কোটা এসব যতদিন থাকবে, আমাদের এই সমাজে ‘নারী দুর্বল’ এই সামাজিক দর্শনের পরিবর্তন খুব কঠিন।

নারী দিবসে খুব করে চাই, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ সমাজে এই বাক্যের ব্যবহার। যাই হোক ধর্ম, বর্ণ, কাঠামো নির্বিশেষে পুরুষ, নারী বা অন্য সব যোগ্যতার বিচারে সমাদৃত হোক। নারীবাদ শুধু এলিটদের চর্চার বিষয় না হয়ে তৃণমূল পর্যন্ত সবার চর্চা হোক। বাংলাদেশে বা আমাদের উপমহাদেশের পারিপার্শ্বিকতায় নারীবাদ কোনো দিন মডিফাইড হয়নি, হয়েছে শুধু অনুকরণ। এখন যখন অনেক পুরুষ ও আমাদের প্রতি সহনশীল এবং অধিকার আদায়ে উদ্বেগ, এখনই সময় সবার একতাবদ্ধভাবে অনুকরণীয় হওয়ার, সামাজিক দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতিতে অগ্রসর হওয়ার। 

নারীর নিজেকে উন্নয়ন ও মুক্তির পথে চলতে হবে, নারী নিজে না চাইলে তা কখনোই সম্ভব নয়। আমি নিজে একজন শিক্ষক হয়ে সে যুক্তির আলো সবার মধ্যে প্রতিফলিত করতে চাই। এই প্রজন্ম নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, আত্মবিশ্বাসে বেড়ে উঠুক সেই প্রত্যয়ে আমরা পথ চলি।

জান্নাতুল ফেরদৌস নিশি, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

যখন ‘Wonder Woman’ সিনেমাটি দেখি, সবসময়ই আমার চারপাশের নারীদের এক একজনকে ‘Super Human’ মনে হয়,  প্রত্যেকেই অলৌকিক শক্তির মতোই অভাবনীয় প্রাণশক্তি, অসাধারণ ভালোবাসার আর অসংগতি ও অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতার অধিকারী। সব ধরনের আঘাত আর ক্ষত এমনভাবে এরা কাটিয়ে ওঠে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে, আমি নিজে নারী হয়েও মাঝে মাঝে নিজেদের এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। আমার চেনা প্রত্যেকটি নারীকে নিয়ে আমি গর্বিত- এক এক নারী এক এক রূপে সমাজে ভূমিকা রাখছে। নিজের আর তার চারপাশের মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তোলার জন্য প্রতিনিয়ত তার যে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়, আমি অবাক হই প্রত্যেকটি নারীর ভেতরকার এই জীবনিশক্তি আর সৌন্দর্য দেখে।

মালিহা তাবাসসুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দিনটি ‘নারী দিবস’ না হয়ে সাধারণভাবে ‘মানুষ দিবস’ হিসেবে পালিত হলে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যময় মনে হতো আমার কাছে। জন্মলগ্ন থেকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই অদ্ভুত এক বৈষম্যের শিকার হতে হয় প্রায় সব মেয়েকেই। সে যেন মনুষ্যজাতির বাইরে অন্য এক জাত, যার নাম ‘নারী’। বৈষম্যের এই শিকল ভাঙতে হলে, নারীকে হতে হবে আত্মবিশ্বাসী। তুমি ঘরমুখী হও অথবা বিজ্ঞানমুখী, নিজের আত্মসম্মানে কোনো আপস করা চলবে না। মনে রাখতে হবে, পুরুষ আমাদের অধিকার দেওয়ার মতো কেউ নয়। তবে তাদের কাছ থেকে নারীদের একটি জিনিসই কাম্য-‘নিরাপত্তা’। 

পুরুষ নারীকে তাদের সহযোদ্ধা হিসেবে মেনে নিলে আমাদের পৃথিবীটা হতো অনেক সুন্দর, অনেক নিষ্পাপ। পৃথিবীর সব নারী যেদিন ঘরে-বাইরে নিরাপদ থাকবে, নারী দিবস উদযাপন সেদিনই সার্থক হবে। 

শারমিন সুলতানা নিশি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 

‘চিন্তার উপহাস’ গায়ের রঙ শ্যামলা হওয়ায়  প্রশংসা করতে গিয়ে বাকীরা অব্যয়সূচক শব্দ ব্যবহার করতো, সেসব ভেবে একটা সময় অবধি খুব খারাপলাগা কাজ করতো। মগজে-মননে সবাই এটিই ঢুকিয়ে দিতো ‘আরেকটুখানি সুন্দর হওয়া দরকার ছিল’। পরে নিজেরই হঠাৎ চিন্তায় এলো আমি সুন্দর কি না সেটা অন্য মানুষের মাপকাঠিতে নিজেকে কেন মাপবো, আমি তার মতো যেমন হতে পারবো না, সেও তো আমার মতো হবে না। কেন আমার দীঘল কালো চুলই লাগবে, ডাগর ডাগর চোখই বা লাগবে কেন, আমার ছোটখাটো চুলও তো সুন্দর হতেই পারে! 

সম্প্রতি একটা খবরের শিরোনামের ‘তবুও’ শব্দটা নিয়ে অনেকের মধ্যে আপত্তি প্রতিফলিত হচ্ছে, যেটা পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে। নতুন একটা চিন্তা যখন সমাজে ছড়ায়, তখন আগের ব্যাকডেটেড গোড়ামি চিন্তাগুলোকে উপড়ানোর চেষ্টা করা হয়, এমন করেই চিন্তার উপহাস চক্রে সমাজ এগোয়।

হাবিবুন নাহার বিথী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ছোটবেলা থেকে যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরতে যেতাম, তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল একদিন এভাবে পুরো দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াবো। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই ইচ্ছের একাংশও পূরণ হয়নি। কেন জানেন? কারণ আমার সমাজ, জাতি আমার জন্য এই পরিবেশ তৈরি করেনি। আজও সন্ধ্যে নামার আগে বাসায় ফেরার তোড়জোড় থাকে, আজও বের হওয়ার আগে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্নই মাথায় আসে, আমি সুস্থভাবে বেঁচে ফিরে আসতে পারবো তো? 

যে ‘নারী দিবস’ ঘটা করে একদিনের জন্য নারীদের সম্মান দেওয়া হয়, সেই নারী দিবস চাইনি, চেয়েছি একটা সুষ্ঠু নিরাপত্তা ব্যবস্থা, চেয়েছি মানুষ দিবস, যেখানে আমাদের ভয় পেতে হবে না। এমন এক দিনের অপেক্ষা করছি, যেখানে সব নারীই বলবে, ‘আমরা নিরাপদ আছি এবং নারী হিসেবে না, মানুষ হিসেবে বেঁচে আছি’। সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানাই, আর সেই সঙ্গে বলি, নারী তুমি গড়ে ওঠো নিজ অরিন্দমে, নিজ স্বাতন্ত্র্যে, নিজ শক্তিতে।

সাবরিনা রেজা, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

যে নারী জাতির কঠিন আত্মত্যাগ, জোড়কণ্ঠে, আশ্রয়ে পাওয়া স্বাধীনতার অধিকার, সেই যুদ্ধ শেষ হলেও, শেষ হয়নি সেই নারী জাতির লড়াই। প্রতিদিনের সেই লড়াইয়ে পাওয়া অর্জন নারীশক্তি আর ধৈর্যের প্রতিফলন। সমাজে প্রতিক্ষেত্রে এখনো অগণিত বাধা-বিপত্তি, কুসংস্কার আর বৈষম্যের আঘাত পেরিয়ে আসা নারীর চেয়ে পিছিয়ে পড়া নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। যে সমাজে সমান শ্রমে নারীশ্রমিক পায় না ন্যায্য মূল্য, সে সমাজে সমঅধিকার নিয়ে এত যুক্তিতর্ক আর নারীর যোগ্যতা নিয়ে অবাধ সন্দেহ মূল্যহীন। 

তবে আমার বিশ্বাস, পরিবর্তনের এটাই স্বর্ণযুগ, ক্ষুদ্রতর থেকে বড় পরিসরে এখন আলোকিত নারীর বিচরণ সব নারীর মনে আশা জাগাতে বাধ্য। উন্নত মানসিকতার মানুষ নিয়ে প্রয়োজন একত্র প্রয়াস। একজন আইনের ছাত্রী হিসেবে নিজের কণ্ঠ আর লেখা দিয়ে নারীর পাশে দাঁড়াতে চাই।

জাবি/মাহি 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়