ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটু চিকিৎসা হওয়া দরকার

শাবলু শাহাবউদ্দিন, পাবনা  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২২, ২৮ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৪:২৭, ২৮ অক্টোবর ২০২১
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটু চিকিৎসা হওয়া দরকার

সবকিছুই কোনো একসময় এসে দুর্বল হয়ে যায়। সেই দুর্বলকে শক্তিশালী কিংবা আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে গেলে একটা মেরামতের দরকার। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে চিকিৎসা। আর এই চিকিৎসা দিতে হলে একজন ডাক্তারের দরকার অবশ্যই আছে। সেই ডাক্তারের সন্ধানেই আজ আমার এই লেখা।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিন ধরনের। স্বায়ত্তশাসিত, সরকার শাসিত এবং বেসরকারি। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শেষ চিকিৎসা দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক ও দার্শনিক আহমদ ছফা। ‘গাভি বৃত্তান্তে’ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সবেমাত্র গাভি বানিয়ে পাবলিকের কাছে ছেড়ে দিলেন। সেটাকে আর মানুষ বানাতে কেউ পাড়লো না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গাভিতেই থেকে গেলো, ষাঁড় কিংবা মানুষ আর হলো না। কেন যে হলো না এই প্রশ্ন আজ অবধি কেউ কী জোরালোভাবে করেছেন? করেছেন বলে আমার মনে হয় না! মাঝে মাঝে দেখা যায় দু'একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বিষয়টি নিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেন কিন্তু আবার চুপসে যায়। কারণ ভদ্রলোকেরা কাদা নিয়ে খেলতে চান না। কাদা নিয়ে খেলার সময় এখন কোনো ভদ্রলোকের নেই। এই কাদা নিয়ে যে ভদ্রলোক খেলবেন তার জীবনে আর হয়তো ইট-পাথরে সুখ জুটবে না। যাক এদিকের কথা।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায় আগেই বলেছি। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। আন্দোলন হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন্দ্রবিন্দু। ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন, নিজেকে টিকিয়ে রাখার আন্দোলন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা- কর্মচারী। সবাই নেতা। রাজনৈতিক নেতা। রাজনীতি তাদের ধ্যান-জ্ঞান। পড়াশোনা যে চলে না তা নয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যা চলছে তা হলো বিসিএস কেন্দ্রিক পড়াশোনা। এটা হতে পারলে ভালো পাত্রী কিংবা পাত্র কে ঠেকায়? আর ক্ষমতা তো থাকছেই আজীবন। বাকিগুলো বেকার। একটা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার। বাংলাদেশে যত বেকার আছেন, তার সিংহভাগ বেকার কোনো না কোনো০ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন।

এরপরেও অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, কেন আমাদের ছেলেমেয়েরা তো অনেকেই বিশ্বের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপ পাচ্ছে। গুগল, ফেসবুক, অ্যাপেল ও আমাজনের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। এগুলো কী পড়াশোনা না করে এমনি এমনি হচ্ছে? না, তা অবশ্যই হচ্ছে না। তবে মহাশয়, এখানে দেশের লাভ কী? দেশের খাইলো-পড়লো। পাবলিক তাদের পেছনে অর্থ খরচ করলো।  কোন স্বার্থে? বলতে পারবেন? জানি পারবেন না। নিজের সীমিত সুখের আশায় পাবলিকের (বাংলাদেশের) কত বড় একটা ক্ষতি করছে একবার ভেবে দেখুন। 

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের যত বড় বড় প্রজেক্ট চলছে তার বেশির ভাগ ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পরামর্শ বিদেশের। তাহলে শতবর্ষের ঢাবি, চবি, রবি, জাবি, বুয়েট, ডুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ইত্যাদি দিয়ে আমরা কী করবো? বিদেশি লোক বাংলাদেশে কাজ করে তাদের দেশকে সমৃদ্ধশালী করছে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাও তাদের দেশে গিয়ে আয় রোজগার করে সেখানেই স্থায়ী হয়ে; সেই বিদেশকেই সমৃদ্ধশালী করছে। তাহলে বাংলাদেশের লাভ কী হচ্ছে? প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায়।

আবারও বলছি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিন প্রকার। স্বায়ত্তশাসিত, সরকার শাসিত এবং বেসরকারি। স্বায়ত্তশাসিত যা করবে, সরকার শাসিত তাই করবে আর বলবে সব ঠিক আছে। আহমদ ছফার গাভি হলো স্বায়ত্তশাসিত আর তার বাছুর সরকার শাসিত। আর বেসরকারি গাভির মাংস কিংবা দুধ ক্রেতা। গাভি থেকে যাই হোক না কেন, তাদের কিনতেই হবে। বিলাসিতা তাদের জীবনের অংশ। তাইতো বছর দুই আগে বেসরকারি কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একজন শিক্ষার্থী বলেছিলেন, সরকারি (স্বায়ত্তশাসিত) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানে ক্ষেতের মধ্যে বসে থাকা; আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়া মানে অন্যরকম একটা ব্যাপার। কী ছিল ওই শিক্ষার্থীর দর্শন! আপনারা একবার ভেবে দেখছেন? তিনি কিন্তু আহমদ ছফার সেই গাভি এখানে তুলে ধরেছেন। তাতে কি! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তো আর কারো দর্শন নেবে না। আন্দোলন শুরু হয়ে গেলো। অবশেষে ওই শিক্ষার্থী ক্ষমা চাইতে বাঁধ‌্য হয়েছিল। হ্যাঁ এটাই পারে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তাইতো মনের দুঃখে-সুখে-আবেগে-বিবেকে মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে হাত যে দিয়েছে, তার হাতই পুড়েছে’।

আজ আমরা গুগল, আমাজন, ফেসবুকে চাকরি নেওয়ার জন্য পাগল। একবার ভাবুন, আপনার দেশের জনসংখ্যা কত? বাঙালি ভাষাভাষী জনসংখ্যা কত? তাহলে নিজেরাই এমন একটি গুগল, ফেসবুক, আমাজন, অ্যাপেল তৈরি করার কথা মনে আসবে। চাকরিজীবী না। নিজেরাই হবেন মালিক কিংবা মহাজন। বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন তরুণ ধনীর আট জন হলো এমন একটি রাষ্ট্রের, যাদের জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে মাত্র দেড় গুণ। তাহলে তারা পারলো, আমরা কেন পারলাম না? আমাদের না পারার কারণ কী? এই বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রশাসনদের।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটা দেশের হৃদপিণ্ড। হৃদপিণ্ড ভালো থাকলে শরীর যেমন ভালো থাকে, ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো থাকলে একটি দেশ ভালো থাকে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান সমস্যা হলো শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতি, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য, মেধাবীদের অবমূল্যায়ন, স্বজনপ্রীতি, একজনের দায় অন্যজনের ঘারে চাপানো, প্রতিহিংসা ইত্যাদি। এগুলো যে কোনো মূল্যে পরিহার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্ররা যদি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে গবেষণা করবে কে, নতুন নতুন আবিষ্কার-তৈরি করবে কে? দেশকে ক্রান্তিকাল থেকে উদ্ধার করবে কে? দেশের দারিদ্র্যতা, কৃষি, জলবায়ু, প্রযুক্তি, মুক্তচিন্তা নিয়ে ভাববে কে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানেই একেকজন দার্শনিক, চিন্তাবিদ, গবেষণা, আবিষ্কারক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। রাজনীতি করে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিতে হবে। কেননা এই দুইটা পেশা দুই মেরুর বাসিন্দাদের। একজন আরেক জনের বিপরীত। স্বচ্ছ জ্ঞানে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সরকারি ভর্তুকি সীমিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায়। জনগণের টাকায় নয়। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আখড়া। পাবলিকের টাকায় বাজেট হয় বলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অবস্থা। নিজেদের টাকায় চললে বৃদ্ধি পাবে গবেষণা। তৈরি হবে নতুন কিছু। ল্যাবগুলো পড়ে থেকে থেকে আর জং ধরবে না। বিশ্ব র‌্যাংঙ্কিংয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে, গবেষণায় যতটা সম্ভব বরাদ্দ বাড়াতে হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয় কোনো শিক্ষক চাইবেন না শিক্ষার্থীদের চুল কেটে নাপিত উপাধি পেতে। কোনো শিক্ষক চাইবেন না কোনো শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে, কোনো শিক্ষার্থী চাইবেন কোনো শিক্ষককে আন্দোলন করে বহিষ্কার করতে। শিক্ষার্থীরা হবে শিক্ষকদের সন্তান। শিক্ষকেরা হবেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, পিতা, মাতা। কোনো ভিসি আর বলতে পারবেন না, ওয়েবসাইটে তথ্য কমতির জন্য আমরা র‌্যাংঙ্কিংয়ে নেই।

বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। তারা চাইলে এ দেশকে সোনার বাংলাদেশ থেকে ডায়মন্ডের বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিরে আসুক স্বচ্ছতা, তৈরি হোক নতুন যুগের নতুন বাংলাদেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, পাবনা ‍বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ‌্যালয়।

/মাহি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়