ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

নতুন শিক্ষাক্রম ও আমাদের বাস্তবতা

তামান্না শারমিন তিথি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৭, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৯:০০, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
নতুন শিক্ষাক্রম ও আমাদের বাস্তবতা

গতানুগতিক শিক্ষা ধারা থেকে বের হয়ে আসা ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা, বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে শেখার জন্য নতুন শিক্ষাক্রম অনেক যুগোপযোগী একটা রূপরেখা। ২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে তার বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণিতে তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয় পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আনা হবে। আর ২০২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কার্যক্রম।

নতুন শিক্ষাক্রম সম্ভাবনাময় নিঃসন্দেহে। তবে তার বাস্তবায়ন মোটেও সহজসাধ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) রিপোর্ট মতে, দেশে সরকারি প্রাথমিক, কিন্ডারগার্ডেন, এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৬ জন। শিক্ষার্থী ১ কোটি ৪১ লাখ ৪৪৫ জন। এই হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হয়ে যায় ১:৩৯ জন। আবার ২০ হাজার ৬০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন, শিক্ষক ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৫ জন। অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরে সারাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৪২ জন।

পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে গতানুগতিক ধারার শিক্ষাতেই কার্যকর শ্রেণিব্যবস্থাপনা ব্যাহত হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। সেখানে নতুন শিক্ষাক্রমের একীভূত শিক্ষা ও সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা নিশ্চিত তো আরো বেশি দুরূহ ব্যাপার। তাছাড়া প্রাথমিকে এখনো নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। মাধ্যমিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও তা যৎসামান্য। অপর্যাপ্ততা, গুরুত্বহীনতার কারণে বহু শিক্ষকই এখনো তার মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ। নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তিত ফোকাস শুধু জ্ঞান বা জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং সেখানে থাকবে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ। এখানে একাডেমিক বিমূর্ত বিষয়গুলোর চেয়ে প্রয়োগ ও জীবন-জীবিকা সংশ্লিষ্ট বিষয়কে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে শিক্ষকের মূল কাজ শেখানো নয়, বরং শিখনে সহায়তা করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষক হবেন একজন ফ্যাসিলিটেটর। আর এই জন্য প্রয়োজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, দক্ষতা ও পারদর্শিতা।

কিন্তু তার বাস্তব চিত্র খুব করুণ। সারাদেশে এখনো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব রয়েছে। শহরগুলোতে এটা কম হলেও গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তা বিরাট বড় সমস্যা। যেখানে গণিত শিক্ষকের দ্বারা বিজ্ঞানের ক্লাস নেওয়া, ইংরেজি শিক্ষকের দ্বারা ইতিহাস ক্লাস নেওয়া স্বাভাবিক বিষয় বলেই ধরে নেওয়া হয়, সেখানে কি করে আশা করা যায় যে- বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমের একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষার বাস্তবায়ন হবে! শিক্ষার্থীর শিখন সহায়তায় অভিভাবকদের নিয়মিত ওয়াকিবহাল থাকার দিকটি নতুন শিক্ষাক্রমের তাৎপর্যপূর্ণ দিক। কিন্তু বাস্তব অবস্থা খুব ভয়াবহ। দেখা যায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক এমন কোনো কাজ দেন যা অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। অথচ অভিভাবক তার সন্তানকে সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য বা ধারণা দিতে সমর্থ নন। তাছাড়া তাদের নিরক্ষরতা, অসচেতনতা, ঔদাসীন্য এসব তো রয়েছেই। তার জন্য বিদ্যালয়েও অভিভাবকদের নিয়মিত সমাবেশ প্রয়োজন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, নিয়মিত সমাবেশও হয়না বা হলেও তাদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা প্রভৃতি কারণে সব সময় সকলের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা যায়না।

নতুন শিক্ষাক্রম মূল্যায়ন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন এসেছে। এখানে সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা প্রচলিত প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক, বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গাঠনিক বা শিখনকালীন মূল্যায়নকে। অর্থাৎ মূল্যায়ন হবে পাঠ চলাকালীন সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট, দলগত কাজ, সমস্যা সমাধানমূলক কাজ, মৌখিক উপস্থাপনা, রিপোর্ট তৈরি, মাঠ পরিদর্শন এসবের মাধ্যমে। এই শিখনকালীন মূল্যায়ন মূলত সারা বছরব্যাপী চলতে থাকে যা যথার্থভাবে সম্পন্ন হলে অবশ্যই সর্বোত্তম মূল্যায়ন হবে এটি। যোগ্যতাভিত্তিক এই মূল্যায়নে থাকবে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশের সুযোগ। অতএব এখানে শিক্ষকের দায়িত্বশীলতা ও সততা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বাস্তবে এদেশে সেই শিখনকালীন মূল্যায়ন কেমন হয় তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কমতি নেই। কারণ এতোদিনও নবম-দশম শ্রেণিতে জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা হিসেবে শিখনকালীন মূল্যায়ন ছিল যার মান হলো ২৫। দেখা যায় বহু শিক্ষার্থী এসব কাজ পরীক্ষার কয়েকদিন আগে অন্যকে দিয়ে করিয়ে বা লিখিয়ে নেয়। এমনকি বাজারে ব্যবহারিক খাতা কেনাবেচার সমালোচনাও আছে এদেশে। শিক্ষকও অর্থ বিনিময়ে ব্যবহারিক খাতা সিগনেচারের নামে এককালীন রমরমা ব্যবসা পেয়ে যান। যেখানে ব্যবহারিকে পুরো ২৫ পেয়ে যায় প্রায় সব শিক্ষার্থী, অথচ তারাই আবার লিখিত পরীক্ষায় পাস নম্বরটাও পুঁজি করতে পারেনা।

নতুন শিক্ষাক্রমে একীভূত শিক্ষা অর্থাৎ ধনী, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, গ্রামীণ-শহুরে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, সুবিধাবঞ্চিত সকল শিক্ষার্থীর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অবকাশ রেখে সমতা ও ন্যায্যতাভিত্তিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। অথচ নতুন পাঠ্যবইগুলোতে একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিখনে সহায়ক কোনো বিশেষ ব্যবস্থা বা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নেই। এসব ছাড়াও পাঠ্যবই এর বড় দাগের ভুলগুলোরও সমালোচনা তো আছেই। এই কয়েকটি বই তৈরিতেই এতোগুলো বড় আকারের ভুল রীতিমতো সকলের মনে শংকা জাগিয়ে গিয়েছে। এতো দীর্ঘ প্রচেষ্টা, দীর্ঘ সময়ের পর এটা মোটেও কারো প্রত্যাশা ছিল না। আরো একটা বিষয় না বললেই নয় যে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মূল কাজটি সরেজমিনে পালন করতে হয় বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদেরই। এখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষণ সামগ্রী সংগ্রহ, তৈরি, প্রদর্শন, প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগান, নিয়মিত অভিভাবকদের সমাবেশ নিশ্চিত করা এসবের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট বাজেট। হতাশজনক হলেও সত্যি যে শিক্ষকতাই এদেশে সবচেয়ে অবহেলিত পেশা, জীবন জীবিকার প্রয়োজনীয় সামগ্রী যোগানেই কখনো কখনো হিমশিম খাওয়া শিক্ষকদের কাছে এসব মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ এর মতোই বিষয়।

নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা সত্যিই অনেক সম্ভাবনাময়। আধুনিক বিশ্বের শিক্ষা কখনোই চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকা, শ্রেণিতে শিক্ষকের বর্ণিত বুলি গলাধঃকরণ ও পরীক্ষার খাতায় সেই বুলি উদগীরণের মাধ্যমে একটা সনদ উঁচিয়ে পাস করে যাওয়া নয়। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে আমাদের দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই হতে পারে বিশ্বের বহু দেশের কাছে মডেলস্বরূপ। কিন্তু এদেশের শিক্ষার বাস্তব অবস্থা খুব হতাশজনক। আমাদের শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম সুন্দর, যুগোপযোগী, আকর্ষণীয়। কিন্তু নেই তার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, বাজেট, অবকাঠামো এবং যোগ্য, দক্ষ, সৎ ও উদ্যমী লোকবল।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

/ফিরোজ/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়