ঢাকা     শুক্রবার   ১৭ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

নিরাপদ সড়ক দিবস ও কিছু কথা

মোহাম্মদ নাদের হোসেন ভূঁইয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৮, ২১ অক্টোবর ২০২৩  
নিরাপদ সড়ক দিবস ও কিছু কথা

২০২০ সালে গোটা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও আঘাত হানে মহামারী করোনা। যার প্রভাবে পুরো বিশ্ব ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। কেড়ে নেয় অসংখ্য মানুষের প্রাণ। অনেক প্রাণের অবসান শেষে অবশ্য মুক্তিও পেলাম এ মহামারী থেকে। কিন্তু দেশে যে সড়ক দুর্ঘটনার মহামারী চলছে সেটি থামবে কবে!

করোনা থেকে রক্ষা পেতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কতই-না অভিযান। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমার কতটুকু সচেতন, সরকারি উদ্যোগ কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে?

২০২১ সালে মাঝামাঝিতে একটি প্রতিবেদন দেখতে পেলাম, সেই সময় করোনায় মৃত্যু ছিল প্রায় ছয় হাজারের মত। একই সময়ে আরেকটি প্রতিবেদনে লক্ষ্য করলাম ওই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছয় হাজার পেরিয়ে বহু দূর। হিসেব করলে দেখা যায় করোনার চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? তাহলে কি আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারিনি?

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত আট বছরের মধ্যে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এ বছরটিতে ছয় হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নয় হাজার ৯৫১ জন নিহত ও ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে রেলপথে ৬০৬ দুর্ঘটনায় নিহত ৫৫০ জন এবং আহত হয়েছেন ২০১ জন। নৌ পথে ২৬২ দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত, ৩৫৭ জন আহত এবং ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন। সব মিলিয়ে সড়ক, রেল ও নৌ পথে বিদায়ী বছরে সাত হাজার ৬১৭টি দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৮৭৫ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন (২৮.৫৯%) মোটরসাইকেল আরোহীরা।

২০২১ সালে পাঁচ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছয় হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন সাত হাজার ৪৬৮ জন। প্রতিদিন গড়ে ১৭টির বেশি প্রাণ ঝরেছে। আর ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকার বিষয়টি হিসাবে নেওয়া হলে, গড়ে দৈনিক নিহতের সংখ্যা ২২ ছাড়িয়েছে।

সংস্থাটির তথ্য মতে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো- নিহতদের অনেকেই শিক্ষার্থী।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ওই বছরের মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ৮৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হন। ফেব্রুয়ারি মাসে নিহত হন ৮৩ শিক্ষার্থী। সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে কম ৫৩ জন শিক্ষার্থী নিহত হন জুনে। শিক্ষার্থীদের বড় অংশ নিহত হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো ও ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বড় শহর ও মহাসড়কগুলোতে। অবৈধ যানবাহন— ভ্যান, রিকশা, নছিমন, অটোরিকশা এ জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। আইনকে অমান্য করে ধীরগতির বাহন মহাসড়কে এখনো চলাচল করে, যা দূরপাল্লার বড় গাড়িগুলোর চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশকে এই ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায় না।অনেকটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে তারা চলাচল করে।

পথচারীরা গাড়ি চাপায়, পেছন দিক থেকে ধাক্কাসহ বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনায় পড়েছে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা, রাস্তা চলাচল ও পারাপারে মোবাইল ব্যবহার, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, পদচারী-সেতু ব্যবহার না করা, যত্রতত্র পারাপারের ফলে পথচারীরা দুর্ঘটনায় পড়ছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যেভাবে কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং এটি যে একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে, এ নিয়ে সরকারের কোনো অবস্থান আছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছে। 

কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর গঠিত তদন্ত কমিটি থেকে শোনা যায়, গাড়ির ফিটনেস নেই, গাড়ির কাগজপত্র নেই, কিংবা চালকের লাইসেন্স নেই অথবা চালকের সহকারি গাড়ি চালাচ্ছে। তবে খুব কম ক্ষেত্রে এর পরিপূর্ণ রিপোর্ট পেয়ে থাকি। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণ কি এবং কিভাবে কমানো যায়, এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয়।অথচ সর্বক্ষেত্রেই জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
সড়ক দুর্ঘটনার হার যেখানে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, একটি অন্যতম প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে এবং উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সেখানে সরকারকে নির্বিকার হলে চলবে না। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

২০১১ সালে মস্কোতে জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোয় ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমিয়ে আনার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশও এর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ কেবল সংহতি প্রকাশ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। উল্লেখিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা বা কর্মসূচি নেয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে এ ধরনের কর্মসূচি প্রণয়নে সরকারের উদাসীনতা কোনোভাবেই কাম্য  নয়।

বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারি আকার ধারণ করছে। সড়ক দুর্ঘটনার সার্বিক চিত্রকে স্মরণ করতে ও মানুষে মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হয়। কিন্তু আমরা কতটাই বা সচেতন হতে পারি। কিংবা মানুষকে সচেতন করতে সরকারের দিবস কেন্দ্রিক প্রচেষ্টাও কতটুকু! শুধু দিবস পালন নয়, এর তাৎপর্য সবার সামনে ব্যাখ্যা করতে হবে। এটি যে করোনার চেয়েও ভয়াবহ মহামারি, সে বিষয়টি সবার সামনে উপস্থাপন করতে হবে। তা না হলে দিবসের সকল চেষ্টাই বৃথা যাবে।

এখনই সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সমস্যা আরও গুরুতর হতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রথমত আমাদের পরিবহণ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে লাইসেন্সবিহীন গাড়ি যাতে কেউ রাস্তায় নামাতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে চালকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। উপযুক্ত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকদের সরকারি উদ্যোগে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।

বর্তমান সময় লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে একটি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ চালকের মত, ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে তাদের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয় এবং নির্ধারিত অর্থের চেয়েও বেশী অর্থ ব্যায় করতে হয়। তাই তারা লাইসেন্স করতে ভয় পায়। 

চালকরা যাতে সুষ্ঠুভাবে লাইসেন্স পেতে পারে তার সুব্যবস্থা করতে হবে। লাইসেন্স প্রদানের জন্য অবশ্যই চালকের ডোপ টেস্ট করতে হবে। যাতে করে কোনো প্রকার মাদকাসক্ত ব্যক্তি লাইসেন্স গ্রহণ না করতে পারে। তাছাড়া রাস্তার পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে।

শহরের টাউন সার্ভিস খ্যাত বাসগুলো যাত্রী উঠানোর নাম করে যত্রতত্র পার্কিং করে, যা যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তাই তাদের পার্কিংয়ের একটি নির্দিষ্ট স্থান করে দিতে হবে। ফুটপাত দখল মুক্ত রাখতে হবে। পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। সেই সাথে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা করতে হবে। 

মহাসড়কে স্থান ভেদে যে নিদিষ্ট গতিসীমা দেয়া হয় তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি-না সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। তাই এই ব্যাপারে সবাই সর্বাত্মক সচেতন করতে হবে। সেজন্য সব শ্রেণি পাঠ্য বইয়ে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি মিডিয়ায় এই বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একদিন বাংলাদেশ হবে সড়ক দুর্ঘটনা মুক্ত বাংলাদেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ফেনী সরকারি কলেজ।

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়