ঢাকা     সোমবার   ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ১ ১৪৩১

নতুন বাংলাদেশের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা

সানজিদা জান্নাত পিংকি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ১৩ আগস্ট ২০২৪  
নতুন বাংলাদেশের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা

ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে হালের আরববসন্ত, সর্বত্রই সফল শিক্ষার্থীরা। তেমনি সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে গণ আন্দোলন। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। তারুণ্যের বিজয়ের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া নতুন বাংলাদেশের কাছে নিজেদের প্রত্যাশা রাইজিংবিডির কাছে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের রাষ্ট্র চাই

আগামীর বাংলাদেশকে আমরা উন্নত, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী দেখতে চাই। বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক ও বহু-ধর্মীয় সমাজের দেশ। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থান দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অঙ্গ। বাংলাদেশকে আমরা সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যে পূর্ণ দেখতে চাই। এজন্য দরকার পারস্পরিক সম্মান, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা। প্রত্যেক ধর্ম, বর্ণ ও জাতির মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত রাখতে হবে। আমাদের প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে হবে। সুশিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে ঘৃণা ও বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রয়োজন।

এমন একটি বাংলাদেশের কামনা করি যেখানে বৈষম্য, দারিদ্র্য, এবং অশিক্ষার জায়গায় থাকবে সমতা, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও সুশিক্ষার প্রসার। সবার জন্য সমান সুযোগ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের সুরক্ষায় বাংলাদেশ হবে একটি মডেল রাষ্ট্র।
(লেখক: মারিয়া সুলতানা, শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়)

স্বতন্ত্র বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা জরুরি

বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি স্বতন্ত্র বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে। আমাদের আদালতগুলো আইন অনুসারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, যা ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার মূলমন্ত্রে পরিচালিত হবে। মানুষের জন্যেই সরকার, মানুষ সরকারের জন্য নয়- এ মতবাদ থেকে আইনানুগ ন্যায়বিচার নীতি জন্মলাভ করেছে। আইনানুগ ন্যায়বিচার একটি গণতান্ত্রিক চেতনা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পরম নির্দেশনা। নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে, যাতে বৈষম্যের মামলা সমাধান করা যায়।

নাগরিকদের আইনগত প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কমিউনিটি আ্যডভাইজরি বোর্ড এবং বিচার ব্যবস্থার ও আইন প্রয়োগের স্বচ্ছতার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। এ পরিকল্পনা একটি নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করবে। যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার আমাদের গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হবে। সবাই মিলে এমন একটি জাতি গড়ি, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, প্রতিটি অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং সবাই আইনের কাছে সমান হবে।
(লেখক: জেসিকা সুলতানা, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি)

ঢাকা কেন্দ্রিকতা মুক্ত জনসেবা জরুরি

রাষ্ট্রের উন্নয়ন অসংখ্য ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার আলোকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেক্টরে কিছু প্রস্তাবনা জানাতে চাই। বহির্বিশ্ব যেখানে ৫জি ইন্টারনেট সংযোগে স্থান্তরিত হয়েছে, সেখানে মফস্বল ও প্রান্তিক অঞ্চলে আমাদের ৪জি সংযোগ না পাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। পাশাপাশি মোবাইল অপরেটরদের গ্রাহক বান্ধব ইন্টারনেট, টকটাইম ও অনান্য পরিষেবা এবং গ্রাহক পর্যায়ে ক্রয়কৃত প্যাকেজে সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত না। ই-কমার্স সেক্টরে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশি মার্কেটে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগী যেমন- অ্যামাজন, আলিবাবা ও অনান্য প্রতিষ্ঠান না আসায় মনোপলির সৃষ্টি হয়েছে। এটির পরিবর্তন প্রয়োজন।

দেশের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক মানুষ ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্ত পেশার সঙ্গে জড়িত। তাদের কাজের গতির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমগুলো যেমন পে-প্যাল, গুগল-পে, অ্যাপল-পে এর মতো সার্ভিসগুলো বাংলাদেশে আসা জরুরি। পাশাপাশি লোকাল এমএফএস রিলেটেড সার্ভিসগুলো যেমন- বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদির মধ্যে ক্রসট্রানজাকশন চালু করা সময়ের দাবি। এমএফএসসি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানি ট্রানজাকশনে উভয়পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ফি নেওয়া বন্ধ করতে হবে।

দেশে স্টারলিঙ্কের মত স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করতে হবে। নাগরিক সেবা প্রদানে নিয়োজিত ওয়েবসাইটগুলোর আরও আধুনিকায়ন প্রয়োজন। ওয়েবসাইটের গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি সেগুলো আরও বেশি ব্যবহারকারীবান্ধব ও আকর্ষণীয় করতে হবে। যাতে যে কোনো নাগরিকের সুষ্ঠু সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। আইটি ও আইটি রিলেটেড প্রোডাক্টগুলোর সহজপ্রাপ্তি ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। আনঅফিসিয়াল প্রযুক্তি বাজারে আসার ফলে রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয়োত্তর পরিষেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। সে ক্ষেত্রে আনঅফিসিয়াল প্রযুক্তিসামগ্রী যদি অফিসিয়ালি দেশে আসে এবং সেটি আনঅফিসিয়াল পণ্যের সমমূল্য বা তার চেয়ে কমে বিক্রয় নিশ্চিত করা হয়, রাজস্ব অর্জনের পাশাপাশি তা ক্রেতার জন্য স্বস্তিদায়ক হবে। প্রযুক্তিপণ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঢাকা কেন্দ্রিকতা সরিয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে তাদের বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পণ্যপ্রাপ্তি, পণ্যের সহজলভ্যতা এবং যথাযথ বিক্রয়োত্তর সেবা নিশ্চিতে সক্ষম হবে।

দেশীয় প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের পণ্যের মান উন্নতিকরণের পাশাপাশি বৈদেশিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গবেষণামূলক উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনবে। এ বাদেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেক্টরকে জনবান্ধব ও শক্তিশালী করতে বহুমাত্রিক পদক্ষেপের প্রয়োজন, যার সবটুকু এ ক্ষুদ্র আলোচনায় সম্ভব নয়। দেশের অনান্য সেক্টরগুলোকেও পর্যাপ্ত জনবান্ধব এবং আধুনিকায়নের মাধ্যমে আগামীর কাঙ্ক্ষিত বাঙলাদেশ গড়ে ওঠার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
(লেখক: লাবিব বিন শাহেদ, শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি)

জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে

সুখী ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বাংলাদেশকে একটি দারিদ্রমুক্ত, মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা এটা নিশ্চিত করতে পারিনি। বিপুল সম্ভাবনাময়ী জনসংখ্যা থাকার পরেও, এ জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার ব্যর্থতা, দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থতা এবং আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া এর মূল কারণ। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের কামনা, আমাদের এই মাতৃভূমি সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতির বলয় মুক্ত হয়ে দারিদ্রমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। সব ক্ষেত্রেই দেশের প্রতিটি নাগরিককে মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে এ দেশকে একটি মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হোক।
(লেখক: মীর ইবরার আলী, শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)

রেজাল্ট নির্ভর নিয়োগ প্রথার কবর দিতে হবে

দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের হাত থেকে আমাদের দেশ মুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশের তরুণরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাংলাদেশের এক ক্রান্তিলগ্নে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দীর্ঘদিন স্বৈরশাসনের ফলে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হয়ে পড়েছে, সেগুলো সংস্কার করতে হবে। নতুন বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশা থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি উৎখাতের। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে আধুনিক ও যুগোপযোগী সিলেবাসের মাধ্যমে একটি স্মার্ট শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে। এছাড়া শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য ড. ইউনুসের যুগান্তকারী ‘মাইক্রো ফিন্যান্স’ দেশে একটি আমূল পরিবর্তন আনবে বলে আমি মনে করি।

এছাড়া শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। সিজিপিএ দেখে নিয়োগের রীতিকে কবর দিতে হবে। সব প্রতিষ্ঠানে নির্দলীয় লোকের অধিষ্ঠানই কাম্য হবে। সেশনজট মুক্ত শিক্ষাঙ্গণ নিশ্চিতের পাশাপাশি সরকারকে আইনের শাসনও নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।
(লেখক: মারিয়া আক্তার রিয়া, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়)

দুর্নীতি মুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়তে হবে

আমাদের দেশে বহু ধর্মের মানুষ রয়েছে। প্রত্যেক ধর্ম যেন সুষ্ঠু, স্বাভাবিক এবং স্বাধীনভাবে পালন করতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ধর্মীয় দাঙ্গা, কটুক্তিকারীদের তৎক্ষণাৎ বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ধর্মে মৌলবাদী চেতনা জাগ্রত হলে, তা নিঃসরণে দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যারা আছেন, এখনো নিযুক্ত বা যোগ দিবেন, তারা যাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে না পারে, সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। রাষ্ট্র দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হলেও আবার যেন দাঙ্গা, জুলুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার না হয়, সেটা অবশ্যই সরকারকে সঠিক নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমদের রাষ্ট্র সরকার গঠনে যদি সর্বদা জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে দেশ একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করবে। তাছাড়া ট্রেডিং ইকোনোমিক্স অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের দুর্নীতি র‍্যাংকিংয়েও আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। যদি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে দুর্নীতি দমন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশকে এক সুযোগ্য, মানবিক ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম হবো।
(লেখক: অমর্ত্য সেন, শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি)

/মেহেদী/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়