রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার: ভবদহ জলাবদ্ধতার কারণ নদীর গতি রোধ
রাবি সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
চার দশক ধরে জলবাদ্ধতার শিকার ভবদহ অঞ্চলের মানুষ। ১৯৬১ সালে এ এলাকায় স্লুইস গেট নির্মাণের ফলে জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন তারা। ১৯৮৬ সাল থেকে স্থায়ী হয় জলাবদ্ধতা। এ পর্যন্ত ভবদহকে ঘিরে নেওয়া ২১টি প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। তারপরও নিরসন হয়নি জলাবদ্ধতা সমস্যার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ‘ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সমস্যা ও সমাধান’ শীর্ষক মুক্তেশ্বরী সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার (৩ নভেম্বর) মযহারুল ইসলাম ফোকলোর গ্যালারিতে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
যশোর জেলার মণিরামপুর, অভয়নগর, কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনা জেলার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার অধিকাংশ অঞ্চল, যা ভবদহ নামে পরিচিত।
সেমিনারে ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক ড. অনুপম হীরা মণ্ডল ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতার কারণ, ইতিহাস ও সমাধানের পথ আলোচনা করে বলেন, ‘এটা শুধু একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্যা না, পুরো দেশের সমস্যা। বাংলাদেশে আলাদা নদীর সংখ্যা খুবই কম। এ দেশের সব নদী ভারত, নেপালের সঙ্গে সংযুক্ত। এর গতিপথ রোধ ও নদী শাসন করে মানুষ এ অঞ্চলকে বিপদের মুখে ফেলেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ছোট থেকেই শুনছি, এ এলাকাগুলো আস্তে আস্তে ডুবে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে পানির নিচে আমরা ডুবে থাকি। আমরা শুধু দেখি। এ এলাকার নদী ও পানি নিয়ে কাজ করে নেদারল্যান্ড বা বৈদেশিক সংস্থাগুলো। কিন্তু এ দেশের সরকার ও এনজিওগুলো আমাদের কথার শোনেনি। তারা কিভাবে মুনাফা লাভ করতে পারবে, শুধু সেটা ভেবেছে। জনমানুষের কথা তারা ভাবে না। নদী কখনো খনন করে বাঁচানো যায় না, নদীকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে হয়।’
ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রওশন জাহিদ বলেন, ‘ভবদহ অঞ্চলের সমস্যাটা পুরো দেশের সমস্যা। দেশের সমস্ত নদী এর সঙ্গে সংযুক্ত। ভবদহ অঞ্চলের সমস্যাগুলো সরকার, এনজিওগুলো বুঝতে চায় না। সবাই শুধু ব্যবসা বোঝে। সব জায়গায় তারা ব্যবসা করে; ওটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। কারণ যারা উন্নয়ন করে, তারা কখনো জনগণের কথা ভাবে না। জন মানুষের সমস্যা তারা দেখে না। ওখানে স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছুই নেই। ভয়ংকর রকম মানবেতর জীবন-যাপন করেন তারা। এটা সংস্কার করতে হবে, আর সেটা সাধারণ জনগণকেই করতে হবে। এনজিও বা সরকারের আশায় বসে থাকলে হবে না।’
ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দন রয় বলেন, ‘আমাদের কাছে নদীর গুরুত্ব কমেছে। আগে আমাদের পরিবহন প্রদ্ধতি ছিল নদী কেন্দ্রীক। এখন রাস্তা কেন্দ্রীক হওয়ায় নদীর ব্যবহার নেই বললেই চলে। ফলে নদী যে তার গতি হারাচ্ছে ও মারা যাচ্ছে, সে দিকে কারোর খেয়াল নেই। দেশে এখন যে বড় বড় বন্যা দেখা দিচ্ছে, এগুলো আগে কখনো হয়নি। তবে এখন এগুলো খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। যার অন্যতম কারণ, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রোধ।’
তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক কোনো নিয়মের উপর হস্তক্ষেপ করলে সেটা আমাদের জন্য ভালো হবে না। যা আমরা এখন অনুভব করতে পাচ্ছি। প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো চলতে দিলেই এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। অন্যত্থায় সামনের বছর হয়তো আরও খারাপ হবে।’
ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান রাসেল বলেন, ‘একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে আরেকটি উন্নয়ন প্রকল্প যে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তা আমরা ভাবি না। আমাদের সমস্যা না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো কিছুতেই কান দেই না। অন্যের সমস্যা যে আমাদের উপর প্রভাব ফেলে, এটা কেও বুঝতে চাই না। গত ৪০ বছর ধরে ভবদহ সংকটকে আমাদের সমস্যা বলে মনে করছি না। এটা যে বাংলাদেশের মানুষের সমস্যা, এটা কেও মনে করে না। যতদিন না সংসদে এটা সমস্যা বলে মনে হবে না, ততদিন এর সমাধান হবে না।’
তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন করে করে বিশাল কিছু করা যায়, কিন্তু সেটা যখন তখন ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশের উন্নয়নের তত্ত্বগুলো বিদেশ থেকে আনা। ফলে এ দেশের মানুষের সমস্যাগুলো ঠিকমতো সমাধান হয় না; নামেই শুধু উন্নয়ন হয়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৪০ বছরে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্য কথা বলতে হবে, সচেতন হতে হবে। এ দেশের মানুষের কাছে এক মণ পানির দাম ১ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু কৃষকরা ঘাম ঝরিয়ে যে ধান উৎপাদন করেন, তার দাম ১০০০-১২০০ টাকা। এ দেশের মানুষের সঙ্গে উন্নয়ন যায় না।’
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. আবুল হাসান চৌধুরীর সঞ্চালনায় ফোকলোর বিভাগের সভাপতি ড. মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আমিরুল ইসলামসহ শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
/ফাহিম/মেহেদী/