ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শতভাগ মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ সম্ভব নয়: সোহেল রানা

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২২, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৩:২৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০
শতভাগ মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ সম্ভব নয়: সোহেল রানা

ঢাকাই চলচ্চিত্রে সোহেল রানা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম। ৭০ ও ৮০-এর দশকে পর্দা কাঁপানো নায়ক সোহেল রানার চলচ্চিত্রে আগমন প্রযোজক হিসেবে। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজনা করেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র এটি। বছর ঘুরতেই তিনি ‘মাসুদ রানা’ সিনেমার মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন। একইসঙ্গে এই সিনেমায় তিনি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। প্রযোজনা, পরিচালনা এবং অভিনয়- তিন অঙ্গনেই সমান জনপ্রিয় এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বোর্ড তাঁকে আজীবন সন্মাননা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। সোহেল রানা একজন মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনেও রেখেছেন নায়কোচিত ভূমিকা। মহান বিজয় দিবসে সোহেল রানার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত সাইফুল।

রাহাত সাইফুল : বিজয়ের মাস। এ মাসেই ভাস্কর্যকে সামনে এনে একটি চক্র ইস্যু তৈরি করছে। সর্বশেষ জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

সোহেল রানা : এটি এমন একটি বিষয়, যা খুব সেনসেটিভ! বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। আমরা সকলের কাছে প্রিয়। সবাই আমাদের ভালো জানেন। আমি যে কথাটা বলবো, সেটা হয়তো এক ধরনের মানুষের পছন্দ হবে, অন্যদের হবে না। জীবনের এই প্রান্তে এসে ভালো না লাগার পাত্র হতে খুব একটা ইচ্ছা করে না। যতটুকু না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে- সরকারীভাবে জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণ করা হচ্ছে। এ নিয়ে আমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। ধর্মে সত্যিকার অর্থে কী বলা হয়েছে তা বড় আলেমদের কাছে গিয়ে জানতে পারি। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা বলা হয়। আমার মনে হয়, আলোচনায় বসে সিদ্ধান্তে আসা উচিত।

রাহাত সাইফুল : মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনি সরাসরি অংশ নিয়েছেন। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য কীভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?

সোহেল রানা : ছাত্রজীবন থেকেই আমি বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। যুদ্ধে যখন অংশ নেই তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের সহ-সভাপতি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। আমরা তখন তাকে ‘মুজিব ভাই’ ডাকতাম। তাঁর ভাষণ শুনেই অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জীবন বাজি রেখে নয় মাস যুদ্ধ করেছি। চোখের সামনে দেখেছি মানুষের নির্মমতা, অসহ্য নির্যাতন। অনেক মানুষকে না খেয়ে মরে যেতে দেখেছি। আমরাও অনাহারে, কম খেয়ে যুদ্ধ করেছি। এমনও হয়েছে একটি ডিম ভাগ করে খেয়েছি। এভাবেই আমরা যুদ্ধ করেছি। সেই সব দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও কান্না পায়।

রাহাত সাইফুল : সদ্য স্বাধীন দেশ। পোড়া মাটির গন্ধ তখনও বাতাসে। লড়াইয়ের ক্ষত দৃশ্যমান। মানুষ অসহায়। ঠিক সেই সময় সিনেমা প্রযোজনা করার কথা কীভাবে ভাবলেন?

সোহেল রানা : যুদ্ধের পর ঢাকা ফিরে আসি। ফিরে এসে ইকবাল হলে যাই। তখন হলের একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনারা যুদ্ধ করে ফিরে এলেন কিন্তু অনেকেই তো ফিরে আসতে পারেননি!’ কথাটা আমার মনে খুব দাগ কাটে। তখন ভাবি, আসলেই তো, আমরা অনেক আপনজন হারিয়েছি। এমন কিছু কি করতে পারি না, যেখানে সব ফুল এক করা যাবে। হয়তো ভালো কিছু হবে না। কিন্তু একটি মালা তো হবে। এই ভাবনা থেকে যুদ্ধে অংশ নেওয়া সব বন্ধু মিলে ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণ করি।

রাহাত সাইফুল : এই নির্মাণ-যজ্ঞের কথা আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

সোহেল রানা : এটি একটি ডকু ফিল্ম। এই সিনেমায় যা কিছু হয়েছে সবই সত্য। এমনকি সিনেমাটিতে সত্যিকারের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো কিছুতে ডামি ব্যবহার করা হয়নি। এ ব্যাপারে আমার বন্ধু নূরে আলম সিদ্দিকী অনেক সহযোগিতা করেছেন। অধিকাংশ শিল্পী পারিশ্রমিক নেননি। এমনো দিন ছিল, তখন প্রযোজক হিসেবে আমি তাদের ভাত পর্যন্ত খাওয়াতে পারিনি। এ সিনেমার ১১ জন মুক্তিবাহিনীর প্রত্যেক সদস্য সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এদের মধ্যে আলতাফ ছাড়া আর কারো অভিনয়ের কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। ১৯৭২ সালের ১৩ আগস্ট মুক্তি পায় সিনেমাটি।

রাহাত সাইফুল : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমান সময়ে খুব বেশি সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে না। এটা কেন হচ্ছে না বলে মনে করেন?

সোহেল রানা : স্বাধীনতার সংগ্রামের উপর গল্প আগে লিখতে হবে। স্বাধীনতার পর কয়টা উপন্যাস বাংলাদেশে লেখা হয়েছে। ৩৫ বছর পর হুমায়ূন আহমেদ একটা উপন্যাস লিখেছেন। একটা উপন্যাস লিখতে লাখ টাকা প্রয়োজন হলে সিনেমা নির্মাণ করতে কোটি টাকা প্রয়োজন। ৫০টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের নাম যদি না বলা যায়, সেক্ষেত্রে সিনেমা হবে কীভাবে? যারা সিনেমা নির্মাণ করবেন তারা তো পকেটের টাকা খরচ করে করবেন না। এ জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। সরকারীভাবে সরঞ্জামের সাপোর্ট দিতে হবে। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ করা বেশ কঠিন। যুদ্ধের সময়ের অনেক সরঞ্জাম পাওয়া যাবে না। যুদ্ধকালীন সেই পরিবেশ তৈরি করাও কঠিন। আমি মনে করি, এ জন্য শতভাগ মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ করা সম্ভব নয়। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা ও মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণ করলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে একটা ধন্যবাদপত্র পাইনি। আমার জন্য এটা দুঃখের বিষয় না। কিন্তু পরবর্তীতে যারা নির্মাণ করবেন তারা যদি সরকারের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা, ভালোবাসা না পান তাহলে কেন করবেন?

রাহাত সাইফুল : আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আপনাদের রাষ্ট্র কতটা সন্মান দিয়েছে বলে মনে করেন?

সোহেল রানা : মূল্য পাওয়ার জন্য আমরা যুদ্ধ করতে যাইনি। আমাদের কে মূল্যায়ন করবে? হ্যাঁ, আমাদের সন্মান কতটা দেখানো হয়েছে সেটা বলতে পারেন। এটাকে যদি ভাতা দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে আমার কাছে সুন্দর দেখায় না। ভাতা দিচ্ছে ঠিক আছে। আমি মনে করি, এটি একটি ছোট পদক্ষেপ। মুক্তিযোদ্ধাদের এমন কিছু করে দিতে হবে, তাদের দেখলে যেন সরকারী কর্মকর্তারা সন্মান দেখায়। অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা ভিআইপি মর্যাদায় পায়।

রাহাত সাইফুল : নতুন প্রজন্মের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

সোহেল রানা : আমি মনে করি, নতুন প্রজন্ম এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে খুব একটা জানেন না। কিন্তু তাদেরকেই এখন এটা খুব বেশি জানা প্রয়োজন। কেন দেশ স্বাধীন হয়েছে? এটা না হলে একটা সময় স্বাধীনতার ইতিহাস হারিয়ে যাবে।

 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়