ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য মাহবুবের গল্প

ফাহমিদুর রহমান ফাহিম, রাবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:০২, ৬ মে ২০২৫   আপডেট: ২৩:১১, ৬ মে ২০২৫
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য মাহবুবের গল্প

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহবুব আলম

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ডিনস কমপ্লেক্সের শান্ত ছায়া ঘেরা পথ ধরে হাঁটলেই চোখে পড়বে এক আন্তরিক মুখ। পুরনো আর নতুন বইয়ের স্তূপের মাঝে বসে থাকা এই তরুণ উদ্যোক্তার নাম মাহবুব আলম।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ২০০৮ সালে একটি দুর্ঘটনায় ডান চোখটি হারিয়ে ফেলেন তিনি। চোখের দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তার মনের আলোয় উদ্ভাসিত বইয়ের জগৎ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানেই চলে তার বই বিক্রি ও সাহিত্য আড্ডা।

আরো পড়ুন:

তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাজশাহী মহানগরীর মেহেরচণ্ডীর বুধপাড়ার বাসিন্দা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট।

২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে মাহবুব বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। ক্লাসের ফাঁকে অথবা ছুটির দিনগুলোতে ডিনস কমপ্লেক্সের পেছনে তার অস্থায়ী দোকানে ভিড় করেন বইপ্রেমীরা। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি তার গভীর টান। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে জেলা লাইব্রেরি পর্যন্ত ছিল তার অবাধ আনাগোনা। সেই ভালোবাসাই তাকে বই ব্যবসার পথে টেনে এনেছে।

মাহবুব জানান, পুরনো বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরনো বই সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন তিনি। অপ্রত্যাশিত সাড়া পেয়ে উৎসাহের সঙ্গে এই কাজ চালিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বই বিক্রিকে উপার্জনের একটি উৎস হিসেবে দেখেন তিনি।

বিভিন্ন জায়গা থেকে বই সংগ্রহ করে কম দামে বিক্রি করার ভাবনা তার কাছে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক, তেমনি তার নিজের চলার পথের পাথেয়। শুধু বই বিক্রিই নয়, মাহবুবের রয়েছে একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থাও; নাম ‘বর্ণ প্রকাশনা’। এই প্রকাশনা থেকে তার প্রথম দুটি বই, একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ ও একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রকাশনা নিয়েই কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এবারের বইমেলায় তার লেখা ‘ফিলিস্তিনে শিশু নির্যাতন’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

তবে তার এই স্বপ্নযাত্রায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। মাহবুব অকপটে বলেন, “বইগুলো সংগ্রহ করতেও তো অর্থের প্রয়োজন। ছোট ও বড় ভাইয়েরা বিভিন্ন বইয়ের খোঁজ করেন। আমার কাছে যদি পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা থাকত, তাহলে আমি সেই বইগুলো স্টক করে রাখতে পারতাম এবং সবার চাহিদা পূরণ করতে পারতাম।”

বন্ধুরা তার এই উদ্যোগকে অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়েছে। এক বন্ধু ১ বছর তার এই কাজে সহযোগিতা করেছে। পরবর্তীতে চাকরির সন্ধানে সেই বন্ধু সরে গেলেও অন্যদের সমর্থন আজও অটুট। বরং মাহবুবের এই কর্মোদ্যোগ তাদের মাঝেও এক ধরনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অনেকেই তার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তে ও জ্ঞানার্জন করতে আগ্রহী।

পরিবার থেকে মাহবুবের এই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানায়। নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই বহন করতে পারায় তারা খুশি। মাহবুব কখনোই অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন না। তার এই স্বনির্ভরতা তাদের কাছে বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। প্রতিদিন ১ থেকে ২ হাজার টাকার মতো বই বিক্রি করেন। এই টাকায় দৈনন্দিন খরচ ঠিকমতো চলে যায় তার।

এক চোখে স্বপ্ন আর বুকে সাহিত্যের ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে চলা মাহবুব আলম আজ অনেক শিক্ষার্থীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। বইয়ের জগতে তার এই নিরলস পথচলা শুধু তার ব্যক্তিগত সংগ্রাম নয়, বরং জ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি এক অদম্য ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পুরনো বইয়ের পাতায় নতুন দিনের স্বপ্ন বোনা এই তরুণ উদ্যোক্তা নিশ্চিতভাবেই একদিন তার ‘বর্ণ প্রকাশনা’কে আরো বিস্তৃত দিগন্তে নিয়ে যাবেন।

ঢাকা/মেহেদী

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়