ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘অসম্পাদিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশ লেখকের জন্য গ্লানিকর’

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘অসম্পাদিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশ লেখকের জন্য গ্লানিকর’

রাইজিংবিডির স্টলে মুহম্মদ নূরুল হুদা (ছবি : ছাইফুল ইসলাম মাছুম)

মুহম্মদ নূরুল হুদা। মূলত কবি। তবে কথাসাহিত্য, মননশীল রচনা, অনুবাদ, লোকসাহিত্য, মেধাস্বত্ব ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে লেখেন। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা শতাধিক। তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো, জেনেভাস্থ ওয়াইপো-র কনসালট্যান্ট, আমেরিকান ফোকলোর সোসাইটি, আইএসএফএনআর, এশিয়াটিক সোসাইটিসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত সদস্য। তার কবিতা বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত। বর্তমানে বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ও নান্দনিক কবিতা-আন্দোলন কবিতাবংলা-র সভাপতি। তিনি দরিয়ানগর কবিতামেলা-র প্রবর্তক। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে বৃহস্পতিবার (বইমেলার ৯ম দিন) বিকেল আসেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাইজিংবিডি ডটকমের স্টলে। এ সময় কবিতা, সাহিত্যে, বই, লেখক, পাঠক ও বইমেলা নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ।

সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল, কেমন দেখছেন?
মুহম্মদ নূরুল হুদা :
এখনো পুরোপুরি জমেনি। তবে জমবে। বইমেলার কিন্তু শেষটাই হলো আসল ব্যাপার। মেলা ভালোভাবে শেষ হবে এটা প্রত্যাশা। আশা করি কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না। কারণ এটা মিলনমেলা। সব মত, সব পথের লোক এখানে আসে। বড় কথা হচ্ছে পাঠকদের আসা এবং পাঠকদের বই কেনা। তারপরে বলব- বই পাচ্ছি তো? বলা হয় তিন-চার হাজার বই বের হয়, এর নব্বই ভাগ বইতো প্রকৃত প্রস্তাবে বই কি না। অসম্পাদিত কোনো পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ করা লেখকের জন্য গ্লানিকর। গত বছর কয়েক হাজার বই বের হয়েছে- এটা অসম্ভব ব্যাপার। এই যে এতগুলো বই বেরিয়েছে, এর কয়টা বই মনে আছে আমাদের, এর পাঠক কয়জন? আমি বলব যে, এটা মানুষের সৃষ্টিশীলতার কসরত নষ্ট হচ্ছে। টাকা নষ্ট হচ্ছে। এটা না করে একটা পদ্ধতি অবশ্যই আমাদের উদ্ভাবন করতে হবে। সুসম্পাদিত পাণ্ডুলিপিভিত্তিক বই করতে হবে। যাতে বই পাঠযোগ্য হয়, ইতিবাচক হয়। লেখক হওয়ার জন্য যখন তখন লিখে অসম্পাদিতভাবে বই বের করা- এটা কোনোভাবেই হতে পারে না।

সাইফ বরকতুল্লাহ : এক্ষেত্রে আমরা দেখি যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্পাদনা প্রতিষ্ঠান আছে। আমাদের দেশেও এরকম কিছু প্রতিষ্ঠান হচ্ছে..
মুহম্মদ নূরুল হুদা :
বড় কথা হচ্ছে প্রত্যেক পাবলিশিং হাউজে সম্পাদনা পরিষদ থাকা দরকার। যেমন চিত্তরঞ্জন সাহা, আমি তার সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলাম আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা, ৭৩-৭৪ সালে মুক্তধারা যখন শুরু হয়। আমাদের যে বড় বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোতে কারো কারো সম্পাদনা পরিষদ আছে। কিন্তু অধিকাংশ প্রকাশনাতে তাদের কোনো সম্পাদনা পরিষদ নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে বইগুলো বের হয়, সেগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা প্রক্রিয়া থাকা দরকার। এজন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা চিন্তা করছি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব, আগামী বছর থেকে এ বিষয়ে গাইড করার জন্য, সৃষ্টিশীলতার সম্পূরক কিছু কলাকৌশল শেখানোর জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছি।

সাইফ বরকতুল্লাহ : অনেক বই বের হয়, সমালোচনাও হয়, কিন্তু এর মধ্যেও কিছু নতুন লেখক তো বের হয়ে আসছে..
মুহম্মদ নূরুল হুদা :
হ্যাঁ নতুন লেখক তো বের হবেই। যারাই নতুন লিখছেন তারাই নতুন লেখক। তার ভেতরে লেখক হিসেবে টিকে থাকা- এটা হলো বড় ব্যাপার। প্রতি বছর ৪ হাজার বই যদি বের হয়ে থাকে, তার মধ্যে অর্ধেক লেখক জানা লেখক। বাকী অর্ধেকই অজানা লেখক হয়ে যায়। সেই অজানা লেখক তো হারিয়ে যায়। তবে কে হারাচ্ছেন, কে টিকে থাকবে- এটা আমাদের কাজ নয়, এটা সমকাল ঠিক করবে, মহাকাল ঠিক করবে, সময় ঠিক করবে। তারচেয়ে বড় কথা যিনি গ্রন্থটি প্রকাশ করবেন, তার আগে অন্তত ভাবা উচিত, বইটি যেন পাঠযোগ্য হয়, পাঠক পড়ে যেন ভাবে বইটি ভালো। লেখকও গর্বিত মনে করে যে আমার বই পাঠযোগ্য হয়েছে। মলাট নিয়ে বই, এটা হতে পারে না।



সাইফ বরকতুল্লাহ : এখন ফেসবুক কিংবা সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সাহিত্যচর্চা করছেন। সেখানে অনেকেই ভালো ভালো লেখা দিচ্ছে, সেটা ছোট হোক, এখানেও কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একটা উন্মেষ হচ্ছে। এ বিষয়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুহম্মদ নূরুল হুদা :
 এটা ইতিবাচক।

সাইফ বরকতুল্লাহ : প্রত্যেক বছরই প্রচুর কবিতার বই বের হয়। প্রতি বইমেলায় চারশ-পাঁচশোরও অধিক কবিতার বই। কিন্তু সেই অর্থে ভালো কবিতার বই পাচ্ছি না..
মুহম্মদ নূরুল হুদা :
কবিতা লিখতে হলে ব্যাপক প্রস্তুতি দরকার। প্রস্তুতি ছাড়া কবিতা লেখা যায় না। প্রস্তুতি ছাড়া কবিতার যে ভাবটা আছে সেটা উচ্চারণ করা যায়। তবে প্রথাগত ছন্দ না জানলেও চলে যদি আপনি গাইতে পারেন। আপনি গাইতে পারলে, সেটা আরো সুর দিয়ে অমর করতে পারেন। লোক কবিরা যেটা করেছেন। কিন্তু এর বাইরে যদি আপনি কবিতা হিসেবে দাঁড় করাতে চান তাহলে অবশ্যই ছন্দ জানতে হবে। বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে গেলে অক্ষর বৃত্ত, মাত্রা বৃত্ত, স্বরবৃত্ত জানতে হবে।

সাইফ বরকতুল্লাহ : কিন্তু ছন্দ ছাড়াও তো কবিতা লেখা হচ্ছে..
মুহম্মদ নূরুল হুদা :
লেখা যায়। কিন্তু ছন্দ জেনে তারপর আপনাকে ভাঙতে হবে। আপনি ছন্দ না জেনে কবিতা লিখতে চান, দাঁড়াবে না। তারপর কবিতা লিখার আরো কিছু প্রকরণ আছে। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন..। পাখির সাথে নীড়ের তুলনা- এটা যে ‘উৎপ্রেক্ষা’ আপনি জানেন! জানেন না। না জেনেই দিয়েছেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ, তিনি ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন, তিনি জানতেন। কবিতার অলংকার তৈরি করার বিষয় জানতে হবে। আমি বলব, ছন্দ আপনাকে শিখতেই হবে। ছন্দ না শিখে কবিতা লিখে আপনি হাজার কবিতার বই বের করেন সেটা টিকবে না।

সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি তো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বইমেলা ঘুরেছেন, দেখেছেন। বিদেশের বইমেলা আর অমর একুশে বইমেলার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?
মুহম্মদ নূরুল হুদা :
বিভিন্ন দেশের বইমেলাগুলো বইকে প্রমোশন করে। বইকে ছড়িয়ে দেয়। এর ভেতর ব্যবসা আছে, নান্দনিকতাও আছে। নান্দনিকতা আছে এই কারণে বলব, বইয়ের মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান সম্প্রসারিত হয়। বইয়ের মাধ্যমে মানুষ আগের জ্ঞানকে জানে। সেই জ্ঞানকে পাঠ করার পর নিজের ভেতর যে শঙ্কা আছে, সেই শঙ্কাকে মিলিত করে সে নতুন জ্ঞান নেয়। বিদেশের মেলাগুলোয় এটা হয়। বাংলা একাডেমির বইমেলাতেও হয়। তবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুধু জ্ঞানের নয়, এটা সংস্কৃতিরও। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের শৃঙ্খলা, জাতীয় জীবনের শৃঙ্খলা- তা পরিশুদ্ধ করার জন্য অমর একুশে গ্রন্থমেলার একটা অবদান আছে। সবচেয়ে বড় অবদান আমাদের জাতি, রাষ্ট্র, এর যে উৎসব, আমাদের মূল প্রেরণা, আমাদের ভাষাতাত্ত্বিক জাতীয়তা, সেই ভাষাতাত্ত্বিক জাতীয়তার একটা বড় দৃষ্টান্ত, প্রমাণ। আমরা বলি বিমূর্ত প্রমাণ হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এটা হলো প্রাণের মেলা। আমাদের জাতীয় নান্দনিকতার মেলা এই বইমেলা।

সাইফ বরকতুল্লাহ : এবার আপনার নতুন কী কী বই বের হয়েছে?
মুহম্মদ নূরুল হুদা :
এবার আমার বেশ কয়েকটি নতুন বই আসার কথা। এটা ১৫ ফেব্রুয়ারির পরে আসবে। তবে এবার আমি যে বইটিতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি- সেটা হলো কবিতার বই। গত এক বছরে যে কবিতাগুলো লিখেছি, তা নিয়েই বের হচ্ছে ‘বেদনার বংশধর’ নামে একটি গ্রন্থ। বের করছে পরিবার প্রকাশন। একটি কবিতার বইয়ের ভেতর তিনটি কবিতার বই বলা যেতে পারে। ১০ ফর্মার বই এটি।

 

সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মুহম্মদ নূরুল হুদা : আপনাকেও। রাইজিংবিডিকে শুভেচ্ছা।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়