অগ্নিকন্যা
ইসহাক খান || রাইজিংবিডি.কম
‘অগ্নিকন্যা’ ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস। ঠিক ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়। উপন্যাস ঐতিহাসিক হয় না। ইতিহাস আশ্রিত কিংবা ইতিহাসের কোনো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে উপজীব্য করে লেখা। ‘অগ্নিকন্যা’ তেমনি একটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। সময়কাল ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬। লেখক তার বইয়ের ভূমিকায় বিষয়টি নিজেই খোলাসা করেছেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যে বাঙালির ইতিহাস, কৃষ্টি, কালচার ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল এবং তারই প্রতিবাদে বাঙালি যে ধীরে ধীরে প্রতিবাদী এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে তারই নিপুণ ও সহজ বর্ণনা এবং ইতিহাসের নানা বাঁক এই গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে, যা পাঠককে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাবে ইতিহাসের নানা স্তরে।
জাতি হিসেবে আমরা ইতিহাস বিস্তৃত জাতি। আমরা নিকট অতীতের ইতিহাসই জানি না, কিংবা ভুলে গেছি। আমরা দ্রুত সব কিছু ভুলে যাই। আমরা কতসংখ্যক মানুষ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানিদের অপরাজনীতির ইতিহাস জানি? যে ইতিহাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। এক কথায় এর উত্তর, আমরা সে সব ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ জানি না। জানার প্রয়োজনও বোধ করি না।
আমাদের কি মনে আছে, দেশভাগের পর কি ঘটেছিল? তুমুল জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা পাকিস্তানের প্রস্তাবক হয়েও জিন্নার কূটকৌশলে হয়ে গেলেন পাকিস্তানের দুশমন। পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকেও দেশভাগের পর পরই সরিয়ে দেওয়া হলো। কপাল খুললো জিন্নাহ, লিয়াকত এবং তাদের প্রিয়ভাজন খাজা নাজিমউদ্দিনের।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী জিন্নাহ দেশভাগের প্রাক্কালে পাকিস্তানের হিস্যা আদায়ের চেয়ে বড়লাট হওয়ার ব্যাপারেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। এটাই পাকিস্তানের জন্য কাল হলো। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রতিহিংসার আগুনে জ্বললো পাকিস্তান। তাতেও জিন্নাহ সাহেবের খায়েশ মিটলো না। তিনি উর্দু ভাষী নন। অথচ খাজা নাজিমউদ্দিনের পরামর্শে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। আর তাতে ফুঁসে উঠলো বাঙালি। রাস্তায় নামলেন শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ আরো অনেকে।
রক্তের বিনিময়ে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু এতে শোষণ-নিপীড়ন যেন অনেকটাই বেড়ে গেল। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। শুরু হলো গোলাম মোহাম্মদ-ইস্কান্দার মির্জাদের ষড়যন্ত্র। তারাও দোদণ্ড প্রতাপশালী সামরিক শাসক আইয়ুব খানের কাছে পরাস্ত হলেন। বন্দি হলো রাজনীতি। কারাগারে বসে শোসিত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শেখ মুজিব আঁকলেন ছয় দফার ছক।
লেখক ‘অগ্নিকন্যা’ শেষ করেছেন শেখ মুজিবের ছয় দফা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। ভূমিকায় তিনি বলেছেন, এই বিষয় নিয়ে তিন খণ্ড উপন্যাস লিখবেন তিনি, যাকে আমরা বলি ট্রিলজি। আমাদের দেশে ট্রিলজি লেখা তেমন হয়নি বলা চলে। ওপার বাংলায় ট্রিলজি লিখেছেন অনেক লেখক। লেখক মোস্তফা কামাল এই ট্রিলজি লেখার ঘোষণা দিয়েছেন তার ‘অগ্নিকন্যা’ এর ভূমিকায়। আমরা সেই আশায় আছি। আমরা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তুরের ট্রাজেডিসহ আরো অনেক অজানা ইতিহাসের অমোঘ সত্য জানতে পারব। যে সত্যের মাধ্যমে অহেতুক অনেক বিতর্কের অবসান হবে। ‘অগ্নিকন্যা’ প্রকৃত ইতিহাস পাঠককে আয়নার মতো সামনে মেলে ধরবে।
গ্রস্থটির বাড়তি পাওনা হলো এর রচনাশৈলী। পাঠক একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারবেন না। যদিও দীর্ঘ উপন্যাস। তারপরও পাঠককে আবিষ্ট করে রাখবে ঘটনার পরম্পরায়। মতিয়া নামের একটি মেয়ে যাকে লেখক অগ্নিকন্যা বোঝাতে চেয়েছেন, তারই কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে কাহিনী এগিয়ে চলবে। কাহিনী না বলে বলা যায় ইতিহাস। সঙ্গে পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে। পাঠকও মুগ্ধ চিত্তে এগিয়ে যাবে ঘটনার ঘনঘটায়। মতিয়া হয়েছে উঠেছে বইয়ের মূল বিষয়। লেখক তাকে অন্য এক মানবীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। যাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গ। বইটি পাঠাকের অনেক তৃষ্ণা মেটাবে। পাঠক আকাঙ্ক্ষিত চিত্তে পরবর্তী খণ্ডের জন্য অপেক্ষা করবে বলে আমার বিশ্বাস।
অগ্নিকন্যা : মোস্তফা কামাল। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। প্রকাশক : পার্ল পাবলিকেশন্স। প্রকাশকাল : ২০১৭। ৩২০ পৃষ্ঠা । দাম : ৫০০ টাকা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফুল
রাইজিংবিডি.কম