স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর কক্সবাজারে গণকবর শনাক্ত
সুজাউদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম
কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়া এলাকায় গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়
কক্সবাজার প্রতিনিধি : স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর কক্সবাজারে সন্ধান পাওয়া গেছে আরেকটি গণকবরের।
কক্সবাজার বিমানবন্দর সীমানা লাগোয়া নুনিয়ারছড়ার পানির কূপ এলাকায় এর অবস্থান। সম্প্রতি মাটি সরে গিয়ে মৃতদেহের হাড়গোড় বেরিয়ে আসলে গণকবরের বিষয়টি জানাজানি হয়। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত অন্তত ২০ জনের কবর রয়েছে এখানে।
এদিকে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এলে গত সোমবার স্থান পরিদর্শনে যান কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ রুহুল আমিন ও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শহীদুল ইসলাম। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে স্থানটিতে গণকবর থাকার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তদন্ত পূর্বক গণকবরটি সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোঃ রুহুল আমিন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম চৌধুরী কক্সবাজারের বধ্যভূমি সংক্রান্ত এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘৭১-র ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের কয়েকদিন পর কক্সবাজার পরিদর্শনে আসেন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর এক সামরিক কমান্ডার।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তিনিও ওই সামরিক কমান্ডারের সঙ্গে বিমান বন্দর সংলগ্ন নুনিয়ারছড়ায় নতুন করে সন্ধান পাওয়া গণকবরসহ টেকনাফের নাইট্যং পাহাড় এলাকার গণকবর, কক্সবাজার শহরের কবিতা সরণী (বালিকা মাদ্রাসা সড়ক) সংলগ্ন বধ্যভূমি, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির সংলগ্ন তিনটি বধ্যভূমি পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শনের সময় নুনিয়ারছড়ার গণকবরটিতে বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ ও হাড়গোড় পড়ে থাকতে তারা দেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন গণকবর সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এর কোন কোনটি রাস্তার পাশে, কোনটি কারো বাড়ীতে, কোনটি কোন সংস্থা বা প্রষ্ঠিানের সীমানা এলাকার ভিতরে। যাদের জীবনদানে আজকের বাংলাদেশ তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ না করা এক প্রকার অবজ্ঞার সামিল।
মৃতদেহের হাড়গোড় বের হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসির সঙ্গে আলাপকালে কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়ারছড়া এলাকার বাসিন্দা ৮৭ বছরের প্রবীন ব্যক্তি আব্দুর মোনাফ রাইজিংবিডিকে বলেন, পাক হানাদার বাহিনী লোকজনকে ধরে এনে এ এলাকার নির্জন স্থানে (তৎকালীন) হত্যা করে ফেলে রেখে যেত। এমনকি লাশগুলো বেশ কয়েক দিন ধরে যত্রতত্র পড়ে থাকত। পাক হানাদার বাহিনীর ভয়ে লোকজন লাশগুলোর কাছে যেতেও ভয় পেত। পরে স্থানীয় লোকজন সুযোগ বুঝে দিনের বেলায় অথবা সন্ধ্যায় আধাঁর ঘনিয়ে এলে স্থানটিতে গভীর গর্ত খুঁড়ে মৃতদেহগুলোকে কবর দিত। আমার দেখা মতে, অন্তত ২০টি মৃতদেহকে এখানে কবর দেয়া হয়েছিল।
গণকবর দেওয়ার কাজে অংশ নেয়া একই এলাকার বাসিন্দা ৯২ বছরের প্রবীন ব্যক্তি আব্দুর রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, সব মৃতদেহের আলাদা করে কবর দেওয়ার সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকির ব্যাপার ছিল কখন বিষয়টি পাক বাহিনীর লোকেরা জেনে যায়। তাই গোপনে গভীর গর্ত করে সব মৃতদেহ এক সঙ্গে কবর দেয়া হয়। মৃতদেহগুলোর কারো মুখে দাঁড়ি থাকলেও অনেকের মুখে ছিল না। তাই কে মুসলমান বা কে মুসলমান নয়, তা নিশ্চিত হওয়া দূঃসাধ্য ছিল। তারপরও আমরা সবার উদ্দ্যেশে গায়েবে জানাযা আদায় করেছিলাম।
তিনি আরো বলেন, এটা স্থানীয় লোকজনের জানা থাকলেও এতদিন ধরে কেউ বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে আসেনি। আমি স্থানটি সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।
গণকবরের সন্নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম জানান, এখানে গণকবর থাকার বিষয়টি এক প্রকার সবারই জানা। বিষয়টি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও জেলা প্রশাসনসহ সব মহলে ইতিপূর্বে উত্থাপন করেছেন। কিন্তু এতদিন ধরে গণকবরটি চিহ্নিত করে সংরক্ষণের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। তা সত্যিই দুঃখজনক এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি অবমাননাকর।
জেলা প্রশাসক মোঃ রুহুল আমিন রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রাথমিকভাবে আলাপ করে গণকবর সংরক্ষণের দাবি উঠেছে। আর এটি চূড়ান্ত সংরক্ষণের জন্য এ সংক্রান্ত কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। কমিটি তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তদন্ত করে এর সংরক্ষণ করবেন।
রাইজিংবিডি/৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/সুজাউদ্দিন/নওশের
রাইজিংবিডি.কম