ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সড়ক ধরে সুরে সুরে ...

খান মো. শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সড়ক ধরে সুরে সুরে ...

খান মো. শাহনেওয়াজ : সাধারণ ছুটির দিন শুক্রবারের অলস সকাল। রাজধানী ঢাকার মোহম্মদপুরে আবাসিক এলাকা মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেড। এই আবাসিক অঙ্গনে ভবনগুলো সব ছয় তলা। গাছপালা নেই কিন্তু আশ্বিনের আমেজ এখানে নেমে এসেছে। এরই মধ্যে গলিপথে গানের সুর।

তিনটি কণ্ঠে সমস্বরে গান- তিনটা ফকির আইসাছে, দুয়ারে খাড়াইয়াছে, ভিক্ষা দেন গো আম্মাজান, দুইটা টাহা দিয়া যান …।
 
সুরের বিন্যাসও চমক ছড়ানো। একজন সুর ধরেন, চারমাত্রা আড়ি দিয়ে আরেকজন গলা মেলান। এরপর চারমাত্রা আড়িতে অন্যজন সুর ঢেলে দেন। আটমাত্রার তালে ত্রিগালবন্দি। দুই পাশে সারবাধা ভবনের মাঝখানে সুর ধ্বণিত হয়ে আরো জোড়ালো হয়ে বাতাসে ভাসে। তিনটি কণ্ঠই দরাজ– আম্মা গো, দুইটা ফকির জনম অন্ধ, একটা হইলো অকর্মা, একটা হইলো অকর্মা …।
 
গানের কথা নিজেদের বাধা। আর সুর প্রৌঢ় ও বর্ষিয়ান নারীপুরুষ সকলেরই পরিচিত। সেই জনপ্রিয় হিন্দি গানের সুর- জিয়া বেকারার হ্যায়, ছায়ী বাহার হ্যায়, আজা মোরে বালমা, তেরা ইন্তিজার হ্যায় …।
 
এই তিনজন ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বয়স কাছাকাছি। দু’জন চোখে দেখতে পান না, অপরজন আবছা দেখতে পান। ভিক্ষা করতে করতেই তাদের পরিচয়, ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব এবং একপর্যায়ে যৌথভাবে আয়ের পথে পা বাড়ানো। প্রায় ২০ বছর ধরে তারা একসাথে ভিক্ষা করে চলেছেন। আগে তারা একা একা গান গেয়ে ভিক্ষা করতেন। এখন একসাথে ভিক্ষা করেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বসিলা এলাকায় তিনজনই কাছাকাছি বাসা ভাড়া নিয়ে বাস করছেন। তারা তাদের আসল নাম ঠিকানা বলতে রাজী হননি। তবে বলেছেন ছদ্মনাম শুক্কুর আলী, কামাল শেখ ও জিন্নাত মণ্ডল। শুক্কুর আলীর বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়, কামাল শেখের বাড়ি গাইবান্ধায় আর জিন্নাতের বাড়ি কুড়িগ্রামে।
 
কামাল শেখ এই জীবনে কোনদিনই চোখে দেখতে পাননি । তবে গ্রামে থাকতে শুনেছেন ছোটবেলায় তার চোখে দৃষ্টি ছিলো। তার ধারণা বুদ্ধি হওয়ার আগেই তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এ কারণে ছোটবেলায় তিনি ভিক্ষায় নেমে পড়েন। তার বাবা তাকে ভিক্ষার গান শেখার জন্য একজন ভিক্ষুক ওস্তাদের কাছে দিয়েছিলেন। তার কাছেই তিনি শেখেন ভিক্ষার জন্য প্রচলিত গান । তিনি বিয়ে করেছেন এবং তার স্ত্রী ও দুটো ছেলে আছে। ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা থাকে এবং তার দেখভালও করে। স্ত্রী গৃহকর্মীর কাজ করেন। কামাল শেখ মনে করেন, তার সংসার বেশ ভরা এবং সব মিলিয়ে তিনি ভালো আছেন। তিনি সবসময়ই গান করেন এবং সুযোগ পেলে আসরেও বসেন। তাদের গানের একটা জোট আছে।   
 
জিন্নাত মণ্ডলের বাড়ি কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে। বাবা-মায়ের সাথে একেবারে ছোটবেলায় চলে যান রংপুর শহরে। ১১/১২ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি পরিস্কার দেখতে পেতেন। তার বসন্ত রোগ হয়েছিলো এবং এরপরই তার দৃষ্টিশক্তি চলে যায়। বাবা-মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি ভিক্ষা করেননি। রংপুরে লালকুঠি এলাকায় বাসায় বাবা-মায়ের সাথে থাকতেন। একবছরের ব্যবধানে বাবা ও মা দুজনেই মারা যান। তার বড় দুই বোন ও দুই ভাই তাকে এক আত্মীয় পরিবারে বিয়ে করান। তার সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তাদের খানিক পড়ালেখা করিয়েছেন এবং বিয়েও দিয়েছেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঢাকায় থাকেন। গান গেয়ে ভিক্ষা করলে পয়সা বেশি পাওয়া যায় বলে তিনি রংপুরেই এক অন্ধ ভিক্ষুকের কাছে গান শিখেছেন। হোটেল রেস্তোরাঁর সামনে ও বিভিন্ন জায়গায় যখন যে গান তিনি শুনতেন তাই গলায় তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। আধুনিক গান, হিন্দি গানও শিখেছেন। তিনি নিজে গান বাধতে পারেন। ভিক্ষায় বেশি পয়সা আয়ের জন্য তিনি বিভিন্নভাবে গানের কথা সাজিয়েছেন এবং তাতে জনপ্রিয় গানের সুর আরোপ করেছেন। এভাবে নিজের সাজানো কথায় ও নকল সুরে গান গেয়ে তিনি মানুষের নজর বেশি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। এতে তার আয় তুলনামুলক অনেক বেশি হয়েছে। তার ভাষায়, অভাব তাকে স্পর্শ করেনি। স্ত্রী সন্তান নিয়ে তিনি সুখী।  
 
শুক্কুর আলী গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন । ছোটবেলা থেকেই তিনি কর্মঅক্ষম। একটুখানি পরিশ্রমেই তার শরীরে ব্যথা হয়। ফলে তিনি ভারী কাজ করতে পারেন না। প্রথম জীবনে ময়মনসিংহে চরপাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। অষুধ খেলে কয়েকদিন ভালো থাকতেন পরে আবার আগের মতই। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেননি। দিনশ্রমিক হিসেবে কম পরিশ্রমের কাজ করতেন কিন্তু অনুকুল কাজ সবসময় জুটতো না। এক পর্যায়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে হাটে বাজারে গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে দু’চার পয়সা নেওয়া শুরু করেন। যুবক বয়সেই তার চোখের দৃষ্টি কমতে থাকে এবং ঝাপসা দেখতে শুরু করেন। বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। তার তিন ছেলে এক মেয়ে। তাদের সবার এখন আলাদা সংসার এবং শুক্কুর আলী মনে করেন তারা সবাই ভালো আছেন।
 
আয়ের জন্য বের হলে তিনজনের দলে সামনে থাকেন শুক্কুর আলী।  চোখে খানিক দেখতে পান বলে তিনি পথ দেখান। বলতে গেলে তিনিই দলনেতা। মানুষের সঙ্গে প্রয়োজনে কথা বলেন তিনিই। প্রায় তিরিশ বছর আগে ভিক্ষা করতে করতে ঢাকায় এসেছেন। এই নগরীতে বহু কিছু দেখেছেন, বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার। তাদের তিনজনকেই ভিক্ষুক পুনর্বাসন কেন্দ্রে যেতে হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে তারা ওই কেন্দ্রের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। এ কারণে তারা হিসেব করে এলাকা বেছে নেন এবং বেশিরভাগ সময় আবাসিক এলাকায় পথ হাঁটেন।

তাদের মাসকাবারি সিএনজি অটোরিকশা বাধা আছে। সেই অটোরিকশা তাদেরকে একেক দিন একেক এলাকায় সকালে নামিয়ে দিয়ে যায় আবার দুপুরের পর এসে নিয়ে যায়।  
 
শুক্কুর আলী জানান, গানের সুরে তিনজনের কণ্ঠ বিন্যাস করেছেন জিন্নাত। গানের কথাও সাজিয়েছেন জিন্নাত। এক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন তিরিশ চল্লিশ বছর আগের জনপ্রিয় হিন্দি ও বাংলা গানের সুর। ভিক্ষার জন্য অনেক আগে তারা গোটা বিশেক গান বেধেছেন। সেগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরিবেশন করেন এবং বেশ সাড়া পান।
 
শুক্কুর আলী বলেন, ‘আমরা ভিক্ষা করতে চাই না, এটা করতে আমাদের ভালো লাগে না। কিন্তু উপায় তো নেই।’ একই কথা বলেন অপর দুজন। তিনজনেই জানান, জীবনের শুরুতে তারা যদি বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত কোন কাজ পেতেন তাহলে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করতেন না। পরবর্তী সময়ে অনেক চেষ্টা করেছেন এ থেকে সরে যাওয়ার কিন্তু আর হয়নি।

শুক্কুর আলী বলেন, ‘আমাদের বয়স হয়েছে, পথ হাটারও একটা পরিশ্রম আছে। মানুষের দয়া দাক্ষিণ্য নিয়ে বেঁচে আছি। অনেক বছর ধরেই এ কাজ করি ঠিক কিন্তু তা করি ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আমাদের মত নিরুপায় মানুষের জন্য সমাজের ধনীদের এগিয়ে আসা উচিত, আন্তরিকভাবে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এখনও আমরা মনে  করি, সহায়তা পেলে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেবো।’     
 
কথায় দ্রুত ইতি টেনে এগিয়ে যেতে থাকেন তিনজন। গান ধরেন- তিনটা ফকির আইসাছে …। পথের মানুষ তাদের টাকা দিয়ে চলে যান। বাসার বাড়ান্দা ও ফটক থেকেও আসে দু’চার টাকা। তারা পা ফেলেন ধীরে, তিনটি কণ্ঠ সমস্বরে মিশে যায় বাতাসে, বেঁচে থাকার তাগিদে ছড়িয়ে চলেন সুর, সুমধুর।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ নভেম্বর ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়