ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

জীবনের গল্প : পথে পথে ২৭ বছর

সাজ্জাদুল ইসলাম পাপ্পু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০০:০৭, ২ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জীবনের গল্প : পথে পথে ২৭ বছর

রফিক ড্রাইভারের ২৭ বছরের একটি মুহূর্ত এভাবেই ফ্রেমবন্দি করেছেন সাজ্জাদুল ইসলাম পাপ্পু

সাজ্জাদুল ইসলাম পাপ্পু : এই গল্পের শুরুটা কেমন হওয়া উচিত, তা পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি। একজন ট্রাক ড্রাইভারের জীবনের গল্প। খুব জাদুকরি কিছু নয়। জীবনের বিচিত্র প্রবাহে ট্রাক ড্রাইভাররাও তো আমাদেরই লোক। এমন একজন ট্রাক ড্রাইভারকে নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।

 

রফিক ড্রাইভার, পরিবহণ খাতের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, যার কথা কেউ বলেনি কখনো। রফিকও বলতে আগ্রহী নন, ‘আমরা ট্রাক চালাই, আমাদের কথা শুনে আর কী লাভ?’

 

ধরে নিলাম, পুরোটাই লোকসান। কিন্তু লোকসান দিতে গিয়ে খুঁজে পেলাম ২৭ বছরের এক অনবদ্য গতির কবিকে। গতির ছন্দে, গতির পতনে লিখে চলেছেন সুখ-দুঃখের কবিতা, যা বড়ই সাদাসিধে ও সহজ-সরল চাওয়া-পাওয়া ও না-পাওয়ার বৃত্তে পঁইপঁই করে পাক খাচ্ছে।

 

পুরো নাম রফিকুল ইসলাম। ৪৪ বছরে পা দিয়েছেন। প্রায় স্বাধীনতার সমান বয়স তার। শ্যামলা বর্ণের হালকা গড়নের দেহ, জমাট গোঁফ, পাঁকধরা দাড়ি আর রাউন্ড ছাঁটে কাটানো ছোট ছোট চুল, ডান হাতে ব্রেসলেট। গায়ে তামাটে রঙের শার্ট আর পরনে লুঙ্গি। স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন ড্রাইভিং সিটে। এই বসে থাকা শুরু হয়েছে ২৭ বছর আগে, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর।

 

সবার কাছে তিনি রফিক ড্রাইভার। কিন্তু কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ট্রাকের হেলপার হিসেবে। প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ঘাড়ে। দায়-দায়িত্বের জোয়াল কাঁধে নিয়ে এক পরিচিতের সূত্র ধরে হেলপারির চাকরি নেন। বেতনকড়ি ঠিকঠাক ছিল না। হেলপাররা ড্রাইভারকে ওস্তাদ বলে ডাকে। সপ্তাহ শেষে ওস্তাত যা দিত, তা-ই মুখ বুঝে নিতে হতো। ১০০ থেকে ২০০ টাকার বেশি ছিল না তা। আর কোনো উপায়ও ছিল না। রফিক মনে করতেন, ‘দিনমজুরের চেয়ে হেলপারি ভালো। একদিন ড্রাইভার হওয়া যাবে। কিন্তু দিনমজুর তো সারা জীবনই দিনমজুর।’

 

এক সময় তা সত্যি হলো। তিন-চার বছরের মাথায় ড্রাইভারের আসনে বসার সুযোগ হয়ে গেল তার। মাইনেকড়ি বেড়ে গেল। তবে হেলপারি করার তিন-চার বছর তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল। প্রতিনিয়ত ওস্তাদের ধমকানি, গালিগালাজ, লাথিগুঁতা সহ্য করতে হতো। গাড়ি ধোয়ামোছার কাজ তো ছিলই। ওস্তাদের অন্যায় আবদার যেমন বিড়ি-সিগারেট, চা-পানি এনে দিতে হতো। দেরি হলে মা-বাপ তুলে গালি দিতে ছাড়ত না। ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল ট্রাকেই। মালঝোবাই চলন্ত ট্রাকের ওপর ঘুমাতে হয়েছে বহু রাত। ফেরি ঘাটে রাতের পর কেটে গেছে ট্রাকে।  ড্রাইভার হওয়ার পর অধীনে থাকার কষ্ট কিছুটা কমেছে, কিন্তু প্রতিদিনের জীবনযাপনে থেকে গেছে আগের মতোই মনঃকষ্ট। ঘরছাড়া, স্ত্রী-সন্তান ছাড়া দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে পথের টানে, চাকার ঘূর্ণনে।

 

পরিবারকে সময় দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে রফিক বললেন, ‘ট্রাকই বাড়ি, ট্রাকই আমার ঘর। আমি প্রতিদিনের যাযাবর।’ স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় আফসোস! বিয়ে করেছি প্রায় ২০ বছর। ঠিকঠাক হিসাব নেই, তবে আমার মনে হয়, ২০ মাসও স্ত্রীর সঙ্গে কাটাতে পারেনি। বাড়ি থাকা না-থাকার কোনো হিসাব নেই। ভাড়া হলেই ট্রাকে গতি ছুটিয়ে চলে যেতে হয়। সপ্তাহে দু-এক রাত বাড়ি থাকা হয়। সংসারে আমার কাজ শুধু টাকার জোগান দিয়ে যাওয়া। এ ছাড়া আর কোনো খোঁজ রাখার সুযোগ হয় না। স্ত্রীকেই সব সামলাতে হয়।’

 

একজন ট্রাক ড্রাইভারের জীবনের গল্প এখানেই শেষ হলে তা বড়ই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রফিক ড্রাইভারের স্ত্রী-সন্তানদের খোঁজ নিতে চলে যাই তার বাড়িতে। খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার জুগনিপাশা গ্রামে রফিকের বাড়ি। যশোর ও খুলনা জেলার সীমানা হয়েছে যেখানে, মহাসড়কসংলগ্ন সেই জায়গাটির নাম শেষ সীমানা। শেষ সীমানা বাজারে গিয়ে রফিক ড্রাইভারের বাড়ি কোথায় শুনতেই স্থানীয় লোকজন তার বাড়ির পথ দেখিয়ে দিল। হেঁটেই গেলাম।

 

গ্রাম্য টিনের ছাউনির বাড়ি। ছেলেমেয়েরা বাড়ি ছিল না। কথা হয় তার স্ত্রী রেখা বেগমের সঙ্গে। মমতাময়ী নারী, কথা বলে তার প্রমাণ পেলাম। গল্পে গল্পে জানতে চাই, রফিক ভাইয়ের সঙ্গে এই যে প্রায় ২০ বছর হলো আপনার বিয়ে হয়েছে, কীভাবে কাটে আপনার সময়। কিছুটা ইতস্ততভাব। ভাঙা ভাঙা কথা দিয়ে শুরু করলেন, ‘অভ্যেস হয়ে গেছে। স্বামী ট্রাই চালায়, তার বাড়ি ফেরার ঠিকঠাক নেই। যতটা পারি নিজেই সংসারের কাজ সেরে নেই। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখার দায়িত্বও আমার।’

 

ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে বললেন, ‘আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম রাকিবুল ইসলাম। ওর বয়স ১৭ বছর। এখন কলেজে পড়ে। আর মেয়ে সুরাইয়া আক্তার। ওর বয়স ১৫ বছর। এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে এই ভেবে যে, আমার ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে। ওরা মানুষ হচ্ছে। কাজের জন্য স্বামী আমাকে সেভাবে সময় দিতে পারে না। সপ্তাহে দুই একদিনও তাকে কাছে পাই না। এ নিয়ে কষ্ট থাকলেও ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এখন আমার সময় কেটে যায়।’

 

রফিক ড্রাইভারও চান তাদের ছেলেমেয়ে মানুষের মতো মানুষ হোক। ছেলেটিকে যেন ট্রাক ড্রাইভার হতে না হয়। এই পেশার যে কষ্ট ও ত্যাগ, তা তিনি হাড়েহাড়ে টের পান। কী কী কষ্ট স্বীকার করতে হয়, জানতে চাইলে রফিক ড্রাইভার বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ লাগে মালিকের গালিগালাজ। ২৭ বছরে ছয়-সাতজন মালিকের ট্রাক চালিয়েছেন। এর মধ্যে দুজনের ভাষা এতটাই জঘন্য ছিল যে, তা মুখে আনাই মুশকিল। এক মালিক কথা বলার আগেই ‘এই কুক্তার বাচ্চা’ দিয়ে শুরু করতেন। তার মেজাজ সব সময় মগডালে চড়ে থাকত। তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন।’

 

‘মালিকের গালি তো কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু রাস্তার ভোগান্তি ও হয়রানি অসহনীয়। বিশেষ করে ফেরিঘাটে গেলেই বহুরূপী চাঁদবাজদের খপ্পরে পড়ে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আমি যতবার ফেরিঘাটে গেছি, গাড়ি নিয়ে ফেরি পার হয়েছি, ততবারই আমাকে চাঁদা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া ঘাট কর্তৃপক্ষের লোকজন বেশি টাকা নিয়ে ফেরির সিরিয়াল দিয়ে থাকে। পথে পথে চাঁদার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন। অনেক সময় বিবাদ সৃষ্টি হয়। তবে ভ্রাম্যমাণ হিসেবে আমাদেরই নত হতে হয়।’

 

এত সমস্যার মধ্যে কেন এই পেশায় এখনো আছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে রফিক ড্রাইভার বলেন, ‘গাড়ির প্রতি মায়া ধরে গেছে। আর এখন গাড়ি না চালালে মনে হয়, আমার সব হারিয়ে যাচ্ছে। আমি আর কিছুই করতে পারব না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালানো এখন নেশায় পরিণত হয়েছে।’ জানতে চেয়েছিলাম একটানা কত ঘণ্টা গাড়ি চালিয়েছেন। বললেন, ‘পথে কয়েক ঘণ্টা বিরতি বাদ দিলে একটানা তিন দিন গাড়ি চালানোর ঘটনা আছে। যশোর থেকে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম সেবার।’ একটনা গাড়ি চালালে তো দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। রফিক বললেন, ‘তা তো থাকেই। ক্লান্তিতে ঘুম এসে যায়। জোর করে চোখ খুলে রাখতে হয়। তবে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।’

 

কখনো দুর্ঘটনায় পড়েছেন কি? রফিক বললেন, ‘বড় কোনো দুর্ঘটনায় পড়িনি। একবার চাকা পাঙচার হয়ে রাস্তা থেকে ছিটকে যায় ট্রাক। কিন্তু আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। এ ছাড়া ছোট ছোট কিছু দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে, যা একেবারে অনিচ্ছাকৃত। তবে সাবধানে গাড়ি চালালে, ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না।’

 

একজন অভিজ্ঞ ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে নতুন ড্রাইভারদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? ‘হ্যাঁ, আমার ড্রাইভারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নিয়ন্ত্রিত গতিতে সাবধানে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটে না। আমরা যারা, ওস্তাদ ধরে গাড়ি চালানো শিখেছি, আমাদের শেখাটা একেবারের হাতেকলমে। গাড়ির প্রতিটি পার্টসপাতি আমরা চিনি। বর্তমানে অনেকে ড্রাইভারিতে আসছে ট্রেনিং নিয়ে। দু-চার মাস ট্রেনিং করে গাড়ি চালানো ঠিক নয়। একজন দক্ষ ড্রাইভার হতে গেলে তাকে কমপক্ষে দুই-তিন বছর সময় দিতে হয়, গাড়ির পেছনে লেগে থাকতে হয়। এমন ড্রাইভারদের হাতে দুর্ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। কিন্তু খোলা মাঠে ট্রেনিং নিয়ে অথবা কয়েক মাস হেলপারি করেই যদি কেউ ড্রাইভার হয়ে পড়ে, তবে তার হাতে দুর্ঘটনা ঘটবেই। এ জন্য মালিকদের সজাগ থাকতে হবে, তারা কার কাছে গাড়ি বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাদের অভিজ্ঞতা কেমন- বিষয়গুলো আগে থেকেই বাজিয়ে নিতে হবে। তাহলে সবাই নিরাপদ থাকবে।’

 

ড্রাইভারি জীবনে বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার না হলেও পেশার স্বীকৃতি নিয়ে তার আপেক্ষ অনেক বেশি। ‘ড্রাইভার মানেই খারাপ মানুষ’- লোকজনের এই ধারণা তাকে কষ্ট দেয়। জীবনের অনিশ্চয়তাও তাকে কুঁরে কুঁরে খায়। মালিক গাড়ি বসিয়ে রাখে না। ভাড়া হলেই টাকা। ফলে সপ্তাহখানেক অসুস্থ থাকলে চাকরি চলে যায়। দুশ্চিন্তা এখানে শেষ নয়। যখন গাড়ি চালানোর সামর্থ থাকবে না, তখন তো খালি হাতেই অবসর যেতে হবে। নেই কোনো পেনশন।’

 

জানতে চেয়েছিলাম, তার বিমা করা আছে কিনা। ‘না, নেই। কোনো বিমা নেই। তবে ট্রাকের বিমা আছে।’ ট্রাকের থাকলে ঝুঁকি নিয়ে যারা গাড়ি চালান, সেই ড্রাইভারের কেন থাকবে না? রফিক বলেন, ‘তা আমি ঠিকঠাক জানি না। তবে ড্রাইভারদের জন্য সরকার যদি বিমা করা বাধ্যতামূলক করে দেয়, তাহলে সবার উপকার হয়।’

 

লেখক : শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ আগস্ট ২০১৫/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়