ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে..

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৯ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে..

শাহ মতিন টিপু : ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব/বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে/(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি/বিরাম)মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত/দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!/যশোরে সাগরদাঁড়ি কবতক্ষ-তীরে/জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি/রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।’

এই চমৎকার চতুর্দশপদী কবিতার স্রষ্টা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।মহাকবি তার জীবনের অন্তিম পর্যায়েও জন্মভূমির প্রতি তার সুগভীর ভালবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তার সমাধিস্থলে স্মরণীয় হয়ে আছে এই চতুর্দশপদীটি।

বাংলা সাহিত্যের মোহে বিমোহিত হয়ে যে বাঙালি তার পরম কাঙ্ক্ষিত ইংরেজি সাহিত্যকে ত্যাগ করতে পেরেছিলেন তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

সুদূর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে থেকেও  স্বদেশভূমিকে ভোলেননি মধুসূদন । ভোলেননি শৈশব স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদকে। সেখানে এই নদকে উদ্দেশ্য করে মধুকবি লেখেন-

‘সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে,

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে’

(কপোতাক্ষ নদ)

আজ এই মহাকবির ১৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। শুধু দেশকে ভুলে যাওয়ায় তিনি সর্বদা দগ্ধ হয়েছেন। তার উপলব্ধিতে বারবার এটাই অনুরণিত হয়েছে যে, স্বদেশই মানুষের একমাত্র আশ্রয়। দেশমাতা ক্ষমা না করলে সে অভিশপ্ত হয়ে যাবে। তাই মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। বলেছেন-

“রেখো মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করিপদে।

সাধিতে মনের সাধ, ঘটে যদি পরমাদ,

মধুহীন করোনা গো তব মন: কোকনাদে।”

(আত্ম বিলাপ)

মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায়ে তিনি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারেননি। তা ছাড়া অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য তিনি ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন ভারতের আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন (অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মারা যান।

অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও চতুর্দশপদী কবিতার স্রষ্টা এই কবি বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্যেও অসামান্য অবদান রাখায় বিশ্ববাসী এই  কবিকে মনে রেখেছে কৃতজ্ঞচিত্তে। বিশ্বসাহিত্যে সনেট কবিতা একটি অভাবনীয় সৃষ্টি হিসেবে পরিগণিত। এই সনেট মধুসূদনই প্রথম বাংলা সাহিত্যে নিয়ে আসেন। তিনি না থাকলে হয়তো আমরা সনেটের সংজ্ঞার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতাম।

মধুসূদন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবিই নন, প্রথম সার্থক নাট্যকারও। তিনিই প্রথম নবজীবনবোধের সঙ্গে নবীনতম আঙ্গিকের সমন্বয় সাধন করে বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতায় নিয়ে আসেন। তাকে বলা হয়, তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার পথ নির্মাতা।

মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত 'রত্নাবলী' নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের লক্ষ্য নিয়েই মধুসূদন নাটক লেখায় আগ্রহী হয়েছিলেন। ১৮৫৯ সালে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা' নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। ১৮৬০ সালে রচনা করেন দুটি প্রহসন : 'একেই কি বলে সভ্যতা' এবং 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' এবং পূর্ণাঙ্গ 'পদ্মাবতী' নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। ১৮৬০ সালেই তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্য।

এরপর একে একে রচিত হয় 'মেঘনাদ বধ কাব্য' (১৮৬১) নামে মহাকাব্য, 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্য (১৮৬১), 'কৃষ্ণকুমারী' নাটক (১৮৬১), 'বীরাঙ্গনা' কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনন্য সাহিত্যকীর্তি আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের মহামূল্যবান সম্পদ। পত্রকাব্য, মহাকাব্য, সনেট, নাটক, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার অমর সৃষ্টিসমূহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে আসীন করেছে।

তার জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুর থানার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে। বাবা  রাজনারায়ণ দত্ত ও মা জাহ্নবী দেবী। যা তার সমাধিস্থলের কবিতায়ই লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়