ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ: কান কাটার পেছনের রহস্য

মোহাম্মদ আসিফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ৩১ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ: কান কাটার পেছনের রহস্য

মোহাম্মদ আসিফ : ঘটনাটি ১৯৮৮ সালের এক শীতল সন্ধ্যার। বড়দিনের ঠিক একদিন আগে ফ্রান্সের আরলেস শহরে বসবাসরত বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ তার বাম কান ক্ষুর দিয়ে কেটে ফেলেছিলেন। যেই ক্ষুর তিনি তার ছোট্ট সাজগোজের টেবিলে রাখতেন।

কিন্তু কেন? কি ছিল এর কারণ? জানা নেই কারো। যা জানা যায়, তার মধ্যে কিছু জনপ্রিয় গুজব ছিল- তার পাগলামি, পান করে মাতাল হওয়ার সমস্যা, নিজের প্রিয় শিল্পী বন্ধু পল গাউগিন এর সঙ্গে বাদানুবাদ এবং তার মা এর কাছে থেকে একটু বেশি শাসন পাওয়ার ঘটনা।

১০০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে যাবার পরেও, এই বিখ্যাত ডাচ শিল্পীর এই ঘটনা এখনো তর্কের রেশ ধরে রেখেছে।

তবে মার্টিন বেইলে নামে এক গবেষক ২০১৬ সালে তার নতুন বই ‘স্টুডিও অব দ্য সাউথ: ভ্যান গঘ ইন প্রভিন্স’ এ দাবি করেছেন, আদরের ভাই থিও’র বিয়ের খবর শুনেই কান কেটেছিলেন হতাশ ভ্যান গঘ।

মার্টিন বেইল সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘এটা ছিল ভয় যা তাকে ভেঙে পড়ার জন্য টেনে ধরেছিল। এই ভয়টা ছিল মানসিক এবং আর্থিকভাবে সহযোগিতাহীন হয়ে পড়ার।’

কিছু ঐতিহাসিকগণ এই ঘটনার সঙ্গে একমত না। তাদের অনুমান ভ্যান গঘ এর কান কাটার কাহিনি তার ভাইয়ের বিয়ের আরো অনেক পরের ঘটনা। কিন্তু মার্টিন বেইলি তা মানতে নারাজ।

তিনি বলেন, ‘বিয়ের কারণ ছাড়াও আরো অনেক হাস্যকর কারণ রয়েছে। আমি বিষয়টার ওপর নজর দিয়েছিলাম আর তার ভাইয়ের বিয়ের খবরটা অবশ্যই সেদিনই তার কাছে পৌঁছেছিল।’

‘বর্তমানে এটা সবগুলো গুজবকে একত্রীকরণের একটা বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের কাছে সেদিনের চিঠিটা নেই কিন্তু এরপর জানুয়ারিতে ভ্যান গঘ যেই চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন সেখানে তিনি তার ভাইয়ের কাছে থেকে ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ টাকা গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছিলেন।’

মার্টিন বেইলির বিশ্বাস, থিও এবং শিল্প ব্যবসায়ী জো বঙ্গার যখন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সেই খবরের সঙ্গেই টাকা আসার কথা ছিল। তিনি বলেন, ভ্যান গঘ এর চিন্তাবিদরা যে জিনিসটি ধরতে সক্ষম হননি সেটা হল থিও এর হবু বউ জো ২৩ ডিসেম্বর তার বড় ভাই এর কাছ থেকে অভিনন্দন পত্র পায়। বেইলি এটাও বলেন, ‘থিও এর ঠিক দুইদিন আগে বিয়ের জন্য মায়ের কাছে অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন এবং তার বড় ভাইকেও খবরটা জানাতে চেয়েছিলেন যাতে অন্য কারো কাছ থেকে খবরটা না আসে।’

ভ্যান গঘের অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন তার ভাই থিও। পাশাপাশি ভাইয়ের কাছে থেকে পাওয়া আর্থিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করেই নিশ্চিন্তে ছবি আঁকতেন তিনি। এবং এই ধারণা তাকে প্রবলভাবে গ্রাস করছিল যে, তার ভাইয়ের বিয়ে তাদের দুইজনের মধ্যের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে এবং আরেকটি পরিবারকে সামলাতে গিয়ে তার ভাই তাকে ছবি আঁকার কাজে কম খরচ দিবে।

মার্টিন বেইলি তার বইয়ে এও লেখেন, ‘একটা গভীর জায়গায় হয়তো হিংসার একটা উপাদান ছিল, থিও সত্য ভালোবাসা খুঁজে পেলেও ভিনসেন্ট একটা লম্বা সম্পর্ক ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল।’

ভ্যান গঘের যে ঘটনা সবাই শুনতে চায়:
মার্টিন বেইলির বই ‘স্টুডিও অব দ্য সাউথ: ভ্যান গঘ ইন প্রভিন্স’ এ মূলত দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্লেসে ভ্যান গগের যাপিত জীবনের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। যেখানে ভ্যান গঘ তার নিজ বর্ণনার ‘ইয়োলো হাউস’-এ বসবাস করতো এবং পরবর্তীতে হালকা রঙের প্রতি আবেগতাড়িত হয়েছিল।

দক্ষিণ ফ্রান্সের আলোকজ্জ্বল পরিবেশ তার চোখে আলো এবং রঙের নতুন ব্যবহারের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা ফুটিয়ে তুলেছিল। জীবনে ভ্যান গঘ তেমন নাটকীয়তার বা সাহসীকতার কোনো পরিচয় দেননি। কিন্তু অনেকের মতে, তার এই কান হারানোর ঘটনাই সাধারণ জনগণের মনোযোগ এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মার্টিন বেইলি বলেন, ‘এটাই ছিল ভ্যান গঘের সেই গল্প যেটা সবাই জানতে চায়। সে সময়ের কথা যেটা অবশ্যই আমি এর সঙ্গে যোগ দিব।’

‘পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এ ঘটনা মানুষজনের মধ্যে খুব কৌতূহল সৃষ্টি করেছে সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত।’

সেদিন রাত্রেই ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ মাথায় টুপি দিয়ে তার কাটা কান নিয়ে নিকটস্থ এক বেশ্যালয়ে গিয়েছিলেন। কানটি কাগজে মুড়ানো ছিল, যেটি তিনি গ্যাব্রিয়েল বার্লাটিয়ার নামের এক তরুণীর কাছে দিয়েছিলেন। ওই তরুণী কাগজ খুলে কানের টুকরো দেখেই মূর্চ্ছা যান। এরপর ভ্যান গঘ সেখান থেকে পালিয়ে যান। এবং তার এই ঘটনা এলাকার পত্রপত্রিকায় প্রভাব বিস্তার করে।

বেইলি তার বইটিতে বলেন, ‘ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ এই ঘটনাকে একজন সাধারণ শিল্পীর পাগলামি বলে উল্লেখ করবেন এবং এই ঘটনায় একটি ধমণী কেটে যাওয়ায় তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় এবং জ্বরে ভুগতে হয়।’

চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রূষার পর ক্ষত শুকিয়ে গেলেও কান কেটে ফেলা একটি মারাত্মক অঙ্গহানি ছিল এবং এটি প্রতিনিয়ত সকলকেই স্মরণ করিয়ে দিত যে একজন চিত্রকর তার পাগলামির কারণে কি করেছেন।

বিবাহ ছিল শুধুমাত্র একটা ক্ষুদ্র কারণ
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ভাই থিও এর বিয়ের খবর যখন তাকে শেষপ্রান্তে নিয়ে এসেছিল। মার্টিন বেইলি সিএনএনকে বলেন, ‘এটি একমাত্র কারণ নয়।’

তিনি এও বলেন, ‘ভ্যান গঘ এর মেডিকেল সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে এখন অনেক তর্ক-বিতর্ক চলমান। এবং মেডিকেল জার্নালে এ নিয়ে হাজারের অধিক রিপোর্ট রয়েছে যা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলমান। বিয়েটা ছিল একটা ট্রিগার এর মতো।’

যেখানে ভিনসেন্ট এর ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন ভিনসেন্ট মৃগীরোগী ছিলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন যে ভিনসেন্ট পাকস্থলীর পরিপাক রসের বিষক্রিয়ায়, মদ্যপান, দ্বি-মেরুকরণ ব্যাধি বা একাকিত্ব এর রোগে ভুগছিলেন। এছাড়াও অন্যান্য কারণের মধ্যে ছিল সানস্ট্রোক। কিন্তু এগুলোর মাঝে কোনো যোগসাজেশ নেই।

নিজের অঙ্গ নিজেই কেটে ফেলা বা স্বয়ং-অঙ্গহানি হয়তো এই চিত্রকর এর সাহায্য পাওয়ার জন্য কোনো অজুহাত ছিল।

বইটিতে মার্টিন বেইলি এও লেখেন, ‘১৮৯৩ সালের একটি চিঠি যেটাতে ভ্যান গঘ এর মেডিকেলের রেকর্ড সংক্রান্ত তথ্য ছিল সেখানে বলা হয়, এই ডাচ চিত্রকর শ্রবণ সংক্রান্ত ইন্দ্রিয়ানুমান সমস্যায় ভুগছিলেন।’

কান কেটে ফেলা হয়তো সেই কোলাহলকে থামানোর একটা নিরর্থক প্রচেষ্টা ছিল।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মে ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়