ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

লোকোমাস্টাররা ট্রেন চালায়, তাদের চালায় কে

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৫:৫৪, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
লোকোমাস্টাররা ট্রেন চালায়, তাদের চালায় কে

অপু, দুর্গার মতো কাশবনে দাঁড়িয়ে অপার বিস্ময়ে রেলগাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রজন্মের কমবেশি সবারই আছে। কালো কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়িয়ে ছুটে চলা রেলগাড়ি দেখে অজগর সাপ বলে ভুল হয়েছে- কত কল্পনার জাল বুনেছি! একটা প্রশ্নই মনের ভেতরে গেঁথেছিল- কে এই বিশাল রেলগাড়ি চালায়? না জানি কত বড় বাহদুর! আমার মতো শৈশবে অনেকেই হয়তো রেলগাড়ির ড্রাইভারও হতে চেয়েছেন।

যারা রেলগাড়ি চালায়, তারা কেমন হয় দেখতে? মনের মধ্যে হয়তো এমন প্রশ্নও জেগেছে। সৌভাগ্যবশত আমার বাবা ছিলেন অ্যাসিস্টেন্ট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অপারেশন। ফলে এদের নিয়ে আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে। বাবা যখন রেলে যুক্ত হন তখন মাত্র ডিজেল ইঞ্জিন আসতে শুরু করেছে। কয়লার বড় বড় পিতলের ইঞ্জিনে ট্রেন চলত। স্টেশন চত্বর কয়লার গুঁড়িতে ভরে থাকত। সেই কয়লার ইঞ্জিনগুলোতে একজন ড্রাইভার আর একজন ফায়ারম্যান থাকতেন। ডিজেল ইঞ্জিন আসার পর ড্রাইভারের নাম ‘লোকোমাস্টার’ আর ফায়ারম্যানের নাম ‘অ্যাসিস্টেন্ট লোকোমাস্টার’ হয়। কেন তাদের এমন নাম? এর উৎস খুঁজলেই বুঝতে পারবেন, দূর থেকে পেশাটা যেমন রোমান্টিক মনে হয়, আসলে তা নয়।

তখন ইঞ্জিনের সঙ্গে একটা বড় কয়লা রাখার জায়গা থাকত। সেখান থেকে বেলচা দিয়ে কয়লা নিয়ে ইঞ্জিনের চুল্লিতে দেওয়া হতো। কয়লার আগুনে তেলের গাড়ির ট্যাংকারের মতো বিরাট পানি ভর্তি বয়লারটা গরম হয়ে উঠত। তৈরি হতো বাষ্প। বাষ্পের শক্তিতে পিস্টন ঘুরত। সঙ্গে রেলের চাকা। এই কয়লা দেওয়ার কাজটি করতেন ফায়ারম্যান। ড্রাইভার কয়লার তাপ ও ব্রেকের চাপ লক্ষ্য রাখতেন। এভাবেই চলত গাড়ি। যেখানে তারা কাজ করতেন ফ্যান তো দূরে থাক, একটা ভালো বসার জায়গা ছিল না। প্রথম দিকে ইঞ্জিনের ক্যাব চারদিকে খোলা রাখা হতো। কারণ অগ্নিকাণ্ড ঘটলে যেন ছড়াতে না পারে।

সেসময় রেলের সবচেয়ে বড় স্টেশনগুলোর কাছেই থাকত যক্ষা হাসপাতাল। কারণ কয়লার গুঁড়ো ফুসফুসে ঢুকে ড্রাইভার, ফায়ারম্যানরা প্রায়ই অসুস্থ হতেন। বেশিদিন এসব চাকরি করলে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিত। সবকিছু ভুলে থাকার জন্য আকণ্ঠ মদ খেয়ে লোকো ক্রুরা ট্রেন চালাত। ব্রিটিশ আমলে বেশির ভাগ ড্রাইভারই ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তাদের নামে অভিযোগ ছিল বিস্তর। তারা থ্রটলে ইট রেখে মদ খেয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু সিগন্যালে এলে ঠিকই জেগে উঠতেন। তাদের অলৌকিক ক্ষমতা ছিল- এমনও শোনা যায়!

পরে এলো ডিজেল ইঞ্জিন। রাতারাতি ড্রাইভারদের নামের সঙ্গে পেশারও সুযোগ-সুবিধা বেড়ে গেল। দিব্যি সাদা জামা পরে রেল ইঞ্জিন চালানোও সম্ভব হলো। কিন্তু সেই মদ পানের দুর্নাম রয়েই গেল। সেই সঙ্গে যুক্ত হলো ইঞ্জিনের তেল চুরি। এই তেল চুরির অশুভ সূচনা বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে আসা বিহারী ড্রাইভারদের হাতে। এদের প্রতি পাঞ্জাবী অফিসারদের ছিল অন্ধ স্নেহ। তারা ব-কলম লোককে লোকো ক্লিনার থেকে পদোন্নতি দিতে দিতে গ্রেড-১ ড্রাইভার বানাতেন।

ব্রিটিশ আমলে লোকোমাস্টারদের কষ্টের চাকরির কারণে বহুদিন এ চাকরির প্রতি শিক্ষিত ছেলেরা আকৃষ্ট হতো না। তার উপর দীর্ঘদিন (১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৫) রেলে লোকোমাস্টার নিয়োগ বন্ধ ছিল। ২০০৫-এ এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ না হলে অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকোমাস্টার পদে আবেদন করা যাবে না বলে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। এরপর অনেকগুলো ব্যাচে অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকোমাস্টার (এএলএম) নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের বেশির ভাগই গ্র্যাজুয়েট। এরা আসার পর বাংলাদেশ রেলওয়ের এএলএম পেশার চেহারা পাল্টে যায়। এখন অনৈতিক কাজগুলো হয় না বললেই চলে। রেল কর্তৃপক্ষও তাদের  বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এখন লোকোমোটিভগুলোর ভেতরকার চেহারা অনেক উন্নত। ভবিষ্যতে তাপানুকুল এবং অ্যাটাচড টয়লেটের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনাও আছে। আর এলএমরা বেতন ভাতা ইত্যাদি মিলে মাস শেষে যা পান তা খুবই আকর্ষণীয়। একজন সরকারি অফিসারের চেয়ে তা কোনো অংশে কম নয়। পরিশ্রমী ও সাহসী যুবকদের জন্য খুবই ভালো একটি পেশা এটি।

লোকোমাস্টাররা ট্রেন চালায়, কিন্তু তাদের চালায় কে? লোকোশেড নামে রেলের প্রধান গন্তব্যস্থলের কাছে একটি ছোট কারখানা থাকে। সেখানে ট্রেনের নৈমিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে পাহাড়তলী নামের একটা স্টেশন আছে, তার উল্টো দিকে চট্টগ্রামের লোকোশেড। একইভাবে লাকসাম আখাউড়াতে লোকোশেড আছে। কমলাপুর রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে ঢাকার লোকোশেড।

এখান থেকেই ড্রাইভারদের চাকরি নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে এসে ড্রাইভাররা রিপোর্ট করেন। নিজের ডিউটি অনুসারে ট্রেনে ওঠেন। ট্রেনে ওঠার আগে তেল বুঝে নেন। ট্রেন চালু করা মোটরগাড়ি চালুর মতো সহজ নয়। জটিল ক্রিয়া। প্রথমে তাকে ডিজেল ইঞ্জিন চালু করতে হয়। সেখান থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তা চালাবে ইলেকট্রিক জেনারেটর। এই জেনারেটর চালাবে ইঞ্জিনের চাকা। শুধু তাই নয়, দেখতে হবে ইঞ্জিনের লাইটিং-এর জন্য ব্যবহৃত ব্যাটারির অবস্থা। সবকিছু ঠিকঠাক হলে তবেই তিনি ইঞ্জিন নিয়ে বের হবেন।

বাংলাদেশ রেলওয়েতে মোট ১৪টি লোকোশেড আছে। প্রত্যেক ড্রাইভার ও ইঞ্জিন কোনো না কোনো লোকশেডের তালিকাভুক্ত। তাকে বলা হয় বেস। বাংলাদেশের লোকোশেডগুলো হলো: ঢাকা, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম বন্দর, লাকসাম, আখাউড়া, কুলাউড়া, সিলেট, কেওয়াটখালি (ময়মনসিংহ), খুলনা, ঈশ্বরদী, পার্বতীপুর, লালমনিরহাট, ও বোনারপাড়া।

বিরতিবিহীন ট্রেন বাদে দূরপাল্লার একটা ট্রেনের পুরোটা পথ একজন ড্রাইভার চালান না। দেখবেন ঢাকা চট্টগ্রামের ট্রেন আখাউড়া এসে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে এলএম এবং এএলএম বদল হয়। পাহাড়তলী লোকোশেডের এলএম আখাউড়ায় এসে বিশ্রাম নেন। সেখান থেকে ঢাকা লোকোশেডের এলএম ট্রেনের দায়িত্ব নেন। আখাউড়াতে তাদের থাকা এবং খাওয়ার সুবন্দবস্ত আছে। সেই থাকার জায়গাকে বলে ‘রানিংরুম’। তিনি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে অন্য একটি ট্রেনে দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে যান। পাহাড়তলী লোকোশেডে সেই ট্রেনের ইঞ্জিন বুঝিয়ে দিয়ে তবেই তার ডিউটি শেষ। যতক্ষণ তিনি ট্রেন চালান মাইল প্রতি একটি ভাতা পান। একে মাইলেজ বলে। তাহলে বলবেন, মালগাড়ির চালকরা নিশ্চয়ই প্রতারিত হন। কারণ মালগাড়িতে অল্প পথ যেতে অধিক সময় লাগে। সেক্ষেত্রে ঘণ্টা হিসেবে মাইলেজ দেওয়া হয়।

ট্রেনের চালক হওয়া কিন্তু চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। দূরপাল্লার ভালো ট্রেনগুলো যারা চালান তারা যেমন অভিজ্ঞ, তেমনি প্রশিক্ষিত। একজন ভবিষ্যতের চালকের চাকরি শুরু হয় শিক্ষানবিশ অ্যাসিস্টেন্ট লোকোমাস্টার গ্রেড-২ হিসেবে। হালিশহরে রেলওয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁর পেশাগত প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হলেই কেবল চাকরির সুযোগ পাবেন। তারপর পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা দুটোর ফলস্বরূপ পদোন্নতি পেয়ে হন গ্রেড-১। তারপরের পদোন্নতি পেয়ে হন সান্টিং লোকোমাস্টার। তারা আসলে স্টেশনে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ট্রেন সরানোর কাজ করেন। এরপর পদোন্নতি পেলে একজন পূর্ণাঙ্গ লোকোমাস্টার হন। তাও গ্রেড-২। আরেকটি পদোন্নতি পেলে গ্রেড-১ হবেন। তখন তিনি সুযোগ পাবেন সুবর্ণ, সিল্কসিটির মতো ট্রেন চালানোর।

এই প্রতিটি পদোন্নতির আগে তাকে পেশাগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর এদের পেশাগত দক্ষতা দেখা হয়। তাই ট্রেনের ড্রাইভারের লাইসেন্স না থাকলেও তাদের প্রশিক্ষণ ও কর্মকুশলতা প্রশ্নাতীত। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ট্রেন চালকেরা রেখেছেন সাহসী ভূমিকা। আশির দশকে হরতাল হলেই শোনা যেত: ‘হরতাল হরতাল রেলের চাকা ঘুরবে না।’এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ট্রেনের ক্রুরা যে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়।

পাকিস্তান ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও রেল শ্রমিকদের ভূমিকা অনন্য। ১৯২০ সালে  চা শ্রমিকরা মুলুক চলো আন্দোলনে নামে। তারা ট্রেনে উঠতে না পেরে আসাম থেকে পায়ে হেঁটে চাঁদপুরে এসে স্টিমারে ওঠার চেষ্টা করে। তখন ব্রিটিশ সরকার নির্মমভাবে সেই আন্দোলন দমন করে। হাজার হাজার শ্রমিকের লাশ মেঘনার বুকে ভাসতে থাকে। সেই হত্যার প্রতিবাদে প্রথম সোচ্চার হয় রেলের শ্রমিকরা। তিনদিন ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। আর কেউ কোনো তীব্র প্রতিবাদ করেনি এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের।

একসময় বাম প্রগতিশীল আন্দোলনের তীর্থক্ষেত্র ছিল রেলপ্রাঙ্গণ। রেলের একজন ড্রাইভার কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে সারাদেশে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি হলেন জসিমউদ্দীন মণ্ডল। তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের রেলগাড়ি’ পড়লে শ্রমিক আন্দোলনের অনেক অকথিত কাহিনী জানা যায়।

ঢাকা/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়