ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

হামিদুর রহমান মাকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন 

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৭:৫১, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১
হামিদুর রহমান মাকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন 

‘হামিদুর রহমানের পরিবারের কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে না। কেউ আসে না। আমরা কবরটি দেখাশোনা করে রাখি। উনাগো না দেখলে, দ্যাখবো কার? উনারা হইছে দ্যাশের মাথা।’ হামিদুর রহমানের সমাধি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মিন্টু মিয়া বলছিলেন এসব কথা।

বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। যাঁর কবর এদেশের মাটিতে ছিল না। এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল তাঁর মায়ের; ছেলেকে হারিয়ে, এক সময় ছেলের কবর খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন তিনি।

আরো পড়ুন:

স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু। সিপাহী হামিদুর রহমানের বীরত্বের কথা জানার পর তিনি এই বীরশ্রেষ্ঠের  পিতা-মাতাকে ডেকে এনেছিলেন ঢাকার ৩২ নম্বর বাড়িতে। নিজ বাড়িতে ১০ দিন রেখেছিলেন এই শহীদ সন্তানের জনক ও জননীকে। সে সময় একদিন খাবার টেবিলে বসে হামিদুর রহমানের মা মোসাম্মাৎ কায়মুন্নেসাকে শেখ মুজিব বলেছিলেন ‘মা আপনি আমার কাছে ১৭টি দাবি করেন। আমি আপনার দাবি পূরণ করবো।’ হামিদুর রহমানের মা বলেছিলেন, ‘একটা দাবিও নাই। আমার ছেলেটারে কনে মাটি দিয়েছ, সেই কবরটা দাও। এই হলো আমার দাবি।’

হামিদুর রহমানের ছোট বোন রিজিয়া বেগম আসাদুজ্জামান নূরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন। একই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত বীরপ্রতীক লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির হামিদুর রহমানকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘হামিদুর রহমান তাঁকে বলেছিল কোম্পানি কমান্ডারকে বলার সাহস হচ্ছে না, আপনাকে বড় ভালো লাগলো স্যার, মার জন্য বুকটা পুড়ে যাচ্ছে স্যার। দুই দিনের ছুটি দরকার, রাতের অন্ধকারে যাবো, মাকে সালাম করে চলে আসবো।’ কাজী সাজ্জাদ আলী জহির কথা দিয়েছিলেন ওয়ারলেসে লে. কাইয়ুমকে অনুরোধ করবেন হামিদুর রহমানকে ছুটি পাইয়ে দেওয়ার জন্য। অথচ মাত্র দুদিন পর ড্রাইভার বদরের মাধ্যমে তিনি হামিদুর রহমানের শহীদ হওয়ার খবর পান। 

কথা রাখতে না-পারার বেদনা কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরকে পোড়াত। তিনি যুদ্ধের পর দেখা করেন ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক সুবেদার তাজুল ইসলাম এবং সুবেদার আবুল হাসেমের সঙ্গে। তাঁরা কাজী সাজ্জাদকে জানিয়েছিলেন ধলই-এর যুদ্ধে শহীর হামিদুর রহমানের মৃত দেহ পেছনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে ভারতের কোনো এক জায়গায় কবর দেওয়া হয়েছে। এই দায়িত্বে ছিলেন সিপাহী হাবিলদার আব্দুল রশীদ। তিনিও শহীদ হয়েছিলেন ’৭১ এর ডিসেম্বরে। ফলে হামিদুরের কবর কোথায়? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার মতো আর কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না এই মুক্তিযোদ্ধা। তবে তিনি থেমে থাকেননি। ১৫ বছর পর বিএসএফ-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর রাহাত খানের সহযোগিতায় খোঁজ পান হামিদুর রহমানের কবরের।

তারপরও কেটে গেছে অনেক সময়। হামিদুর রহমানের শাহাদাতের ৩৬ বছর পর ১১ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে তাঁর দেহাবশেষ স্থানান্তর করা হয়। রাষ্ট্রীয় সম্মানে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে পুনঃসমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২৫ মার্চ বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সেনারা হামলা চালালে হামিদুর রহমান সেখান থেকে পালিয়ে হেঁটে নিজ গ্রামে চলে যান। মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে যোগ দেন যশোরের কাছে অবস্থানরত ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সিপাহী হিসেবে রেজিমেন্ট থেকে তাঁর সৈনিক নাম্বার দেওয়া হয় ৩৯৪৩০১৪। হামিদুর রহমান প্রথমে নিযুক্ত হয়েছিলেন রান্নার কাজে। কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধের প্রতি অদম্য আগ্রহের কারণে তাকে লে. কাইয়ুমের রানার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ২৮ অক্টোবর, ১৯৭১, ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ধলই আক্রমণে সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষার্থে শত্রুর বাঙ্কার ধ্বংস করতে গিয়ে তিনি শাহাদত বরণ করেন।

তখন হামিদুর রহমানের বয়স ১৭ বছর ৩ মাস। এই সেই আঠারো- এই সেই সমীকরণ- যা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পৃথিবীর বুকে ফিরে আসার প্রার্থনা করেছেন কবিতায়। আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি। রণক্ষেত্রে অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলেন এই বীর। এ ছাড়া সেদিন উপায়ও ছিল না। হামিদুরদের আত্মত্যাগে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে।

মাকে দেখার জন্য হামিদুর রহমানের বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলছিল সে আগুন নিশ্চয় হামিদুর রহমানের মায়ের অন্তর পুড়িয়েছে। সেই আগুনের আলোয় বাংলাদেশ দূর করেছে অন্ধকার। দেশ স্বাধীন হবার পরেও হামিদুর যখন বাড়ি ফিরছিলেন না তখন তাঁর পিতা আক্কাস আলী মণ্ডল হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরেছেন সন্তানকে, সন্তানের লাশ, সন্তানের কবর।

এই সেই কবর, এখানে সেই অদম্য আঠারোর স্মৃতিচিহ্ন, এখানে বাংলাদেশের জন্মদাগ। হামিদুর আমাদের সেই তারুণ্যের গল্প, যে তারুণ্য আরাধ্য, যে তারুণ্য প্রার্থনা। 

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়