শেকড়-জীবিকার রশি টানাটানি
বাবার চাকরি সূত্রে আমার জন্মস্থান রাঙামাটি হলেও পৈত্রিক বাড়ি লক্ষ্মীপুর। এটা হচ্ছে সাবেক নোয়াখালী জেলা। ১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ যখন ১৯ থেকে জেলা সংখ্যা বাড়াতে থাকেন, তখন তিনি নোয়াখালীকে তিনটি জেলায় রূপান্তর করেন। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর আর ফেনী। সেই থেকে আমরাও নোয়াখালী বলা ছেড়ে দিয়েছি।
ছোটবেলা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকার কারণে আমাদের ভাষাগত একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। পরিবারের মানুষদের কথা শুনলে চট করে কেউ বুঝতে পারে না, আসলে কোন জেলার বাসিন্দা আমরা। কাউকে না বললে তো আরও মুশকিল। আমরা আসলে নোয়াখাইল্যা মানে লক্ষ্মীপুরের মানুষ।
এই লক্ষ্মীপুরেই আমার পূর্ব পুরুষদের জন্ম। বাপ-চাচাদের বেড়ে উঠা। বাবার ছোটবেলা, পড়াশুনা সব এখানেই। মায়ের বাড়িও একই গ্রামে। মানে দাদা আর নানা বাড়ি হাঁটা দূরত্ব। দাদা জাহাজে চাকরি করতেন। উনার তিন ছেলের মধ্যে কেবল বাবা-ই পড়াশুনা করেছেন। বাবা ছিলেন, আমাদের গ্রামের প্রথম অ্যান্ট্রান্স পাস (এসএসসি) মানুষ। তাও সেকেন্ড ডিভিশন। বাবার মুখে শোনা, পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর অনেক লোকজন নাকি দেখতে এসেছিলেন তাকে।
আমার নানা সেসময় তার ছোট মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিলেন। নানার ছিল চার ছেলে-মেয়ে। মা সবার ছোট। তো, নানা পেয়ে গেলেন আমার বাবাকে। তারপর একদিন অ্যান্ট্রান্স পাস আমার বাবার সাথে মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। মা’র বয়স তখন কেবল তের কি চৌদ্দ, বাবার বিশ/বাইশ। বাবা চাকরি নেন ওয়াপদায়। মানে পানি উন্নয়ন বোর্ডে। তারপর মাকে নিয়ে কেবল-ই ছুটে চলা। এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। এভাবে দেশের বেশিরভাগ জেলা ঘোরা হয় বাবার, সাথে আমরাও। সে কারণে আমাদের ভাই-বোন একেক জনের জন্ম একেক জেলায়।
সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় আমার দেশ। আর দেশের মধ্যে আমার জেলা, আমার গ্রাম। প্রিয় এই গ্রামেই আমার শেকড়। যদিও বাবার চাকরির সুবাদে আমার জন্ম রাঙামাটিতে। তাতে কী? এই গ্রামে আমার পৈত্রিক নিবাস। বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটে-বাড়ি এখানে। গ্রামের মাটিতে শুয়ে আছেন আমার দাদা-দাদী আর মা।
আমার সেই গ্রামের নামটাই তো বলা হলো না। অদ্ভুত একটা নাম, ‘আটিয়া তলি’। গ্রামের এহেন নাম কেন, কেউ জানে না। তবে মুরুব্বী কিসিমের লোকজন বলেন, এলাকায় প্রচুর ‘বিচি কলা’ (আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে ‘আটিয়া’ বা ‘আইট্টা কলা') হতো একসময়। সেই থেকে নাম ‘আটিয়া তলি’।
ঢাকা থেকে বাড়িতে গেলে আমরা যে স্টেশনে নামি সেটার নাম ‘জ্যাকসন বাজার’। স্থানীয় ভাষায় ‘জকসিন বাজার’। ব্রিটিশদের সময়ে কোন এক ইংরেজ জ্যাকসন সাহেব আমাদের বাজারের মধ্যে খালের ওপরে একটি পুল বানিয়েছিলেন। তারপর থেকে সেই ইংরেজ ভদ্রলোকের নামানুসারে বাজারের নাম। কালক্রমে সেটা হয়ে যায় ‘জকসিন বাজার’। যদিও এখনও ইংরেজিতে লিখি Jackson Bazar।
অনেক দিন, মাস, বছর বাদে সম্প্রতি পরিবারের প্রায় সবাই গ্রামের বাড়িতে যাই। প্রথম দিন রাতের বাসে আমরা ২৩ জন। পরদিন আরও ৮ জনসহ মোট ৩১। ভাই, বোন ও তাদের পরিবার।
শীতকে সাথী করে কুয়াশামাখা খুব ভোরে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছাই। ফ্রেশ হয়ে সবাই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুম আর আসে না। হঠাৎ করে মাথার ওপর ছাদে টিপ টিপ আওয়াজ টের পাই। বৃষ্টি শুরু হলো কি? জানালা খুলে দেখি, বৃষ্টি তো পড়ছে না!
আসলে কিছুই দেখি না। বাইরে এতটাই কুয়াশা, দুই ফুট দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছিল না। অনুভব করছিলাম, কুয়াশা বৃষ্টি হচ্ছে। সেজন্যই ঘরের টিনের চালে বৃষ্টির মতো হালকা রিমঝিম শব্দ। আহ, কতদিন পর শুনছি এমন ঘোর লাগা ছন্দময় আওয়াজ। আমি জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে থাকি। অন্ধকারে দেখি...। আসলে কিছুই দেখি না। নৈশব্দ অনুভব করার চেষ্টা করি।
সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। আহারে, আমরা যারা তথাকথিত শহুরে মানুষ, তাদের জন্য এটা বিরাট এক সৌভাগ্যের ব্যাপার। টিনের চালে শিশিরের শব্দ শুনতে শুনতে ঘোর লেগে যায়। একটু ঠাণ্ডাও কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। জানালা বন্ধ করে ফিরে আসি বিছানায়। কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, টের পাইনি।
পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন প্রায় দশটা। ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি কুয়াশা নেই, ঝকঝকে রোদ। বোনের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজেদের ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বাবার ঘরটা দেখে বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে উঠে। আশ্চর্য হয়ে ভাবি, একসময় এই ঘরে আমার বাবা-মা থাকতেন, আমরাও! অস্ট্রেলিয়ান রানী মার্কা ঢেউ টিন দিয়ে বানানো বাবার পুরোনো আমলের ঘর।
আজ কেবল কালের সাক্ষী হয়ে ঘরটাই আছে। কেমন জরাজীর্ণ অবস্থা। কেউ থাকে না সে ঘরে। কেমন অপরিষ্কার আর নোংরা সে ঘরের চারপাশ। ঘরের পাশেই নারকেল আর সুপারির বাগান। গাছগুলোতে হাত বুলিয়ে দেখি। কবে জানি আমার নিজ হাতে একটি সেগুনের চারা লাগিয়েছিলাম। সেটা এখন অনেক বড় হয়েছে। নারকেল গাছগুলোতে অনেক নারকেল। সে গাছ থেকে লোক দিয়ে ডাব পাড়ি, খাই। আহ, কী স্বাদ সে ডাবের পানিতে!
বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসকে তেমন পাত্তা দিই না। বোনের ঘরে ফিরে যাই। হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা খাই। শীতের পিঠা, মুড়ি-মুড়কি এসব। তারপর বাড়ির চারপাশটা দেখতে বেরিয়ে পড়ি। বাড়ির পাশেই ছোট্ট বাজার, গাবতলি। পাঁচ সাতটা দোকান হয়েছে ইদানীং। সেখানে যাই, চা পান করি।
কত মানুষের সাথে দেখা হয়। অনেককেই চিনি না। নানান বয়সের গ্রামের মানুষ। খোঁজ-খবর নেয় আমাদের। তাদের খবরও দেয়। নিজেদের সমস্যার কথা বলে। গ্রামের সমস্যার কথা বলে। আমরা কেনো নিয়মিত আসি না, সেটাও জানতে চায়। আমার বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ টেনে আনেন তারা। আমার এসব শুনতে ভালো লাগে না।
ভাই-বোনদের খবর জানতে চায়। আমি হু, হ্যাঁ করে ওদের সাথে তাল মিলিয়ে যাই। পাশেই নানা বাড়ি। শুধু নানা বাড়ি না, এখানেই শুয়ে আছেন আমার মা। আর বাবা শুয়ে আছেন ঢাকার আজিমপুরে।
খুব ভোরে আসার কারণে রাস্তাঘাট দেখতে পাইনি। সকালের আলোয় পথ-ঘাট দেখে অবাক হই। গ্রামের সেই ধুলো উঠা কাঁচা রাস্তা আর নেই। সব পাকা। চারদিকে প্রচুর নারকেল-সুপারির বাগান এখনও আছে ঠিকই, কিন্তু এর ফাঁকে অনেক পাকা দালান চোখে পড়লো। বিদ্যুৎ রয়েছে ঘরে ঘরে। প্রায় সব ঘরেই রঙিন টিভি। সাথে ডিশের লাইনও আছে। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে এখানেও।
বাড়ি থেকে জকসিন বাজার আধা কিমি’র মতো। বাজারের যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজি, চোখে পড়ে না। ব্যাটারিচালিত অটোতে ভরা চারপাশ। টানা রিকশা আজকাল আর লোকজন চালাতে চায় না। সেটা পাল্টে সবাই অটো-ই চালাচ্ছে। কী আর করা, সেরকম একটায় উঠে পড়ি।
জকসিন বাজারে নেমে ভাড়া জানতে চাই। বলে না ড্রাইভার। কেবল হেসে বলে-
: আপনি খুশি হয়ে যা দেন...
পরিচিত একজনের কাছে ভাড়ার কথা জানতে চাই-
: কত দেব?
সে ২০ টাকা দিতে বলে। আমি ৫০ টাকা দিই। রিকশাচালক ছেলেটা বাকি টাকা ফেরত দেয়... না নিয়ে বলি-
: রেখে দাও।
কৃতজ্ঞচিত্তে সেটা রেখে দেয় সে...। কত অল্পতেই এরা খুশি!
ঢাকা থেকে রওয়ানা হওয়ার আগে থেকেই গ্রামের ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে কথা হয় মোবাইলে। বাড়িতে আসার দিনক্ষণ ওদের জানিয়ে দিই। আমার আসার খবরে বন্ধুরা বাজারে আসে। শওকত, মনু, হারুন, মামুন, স্বপন, জহরদা, হারানদা। ওদের সাথে বাড়ি গেলে দেখা হবেই।
সবার সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করি। ছেলে-মেয়েদের গল্পও চলে আসে। সবাই যে যার মত ভালো আছে জেনে ভালো লাগে। ওদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে নানা-দাদাও হয়ে গেছে। সময় কত দ্রুত চলে যাচ্ছে! সন্তানরা বড় হচ্ছে, আমরা বুড়ো হচ্ছি। ওদের সবাইকে নিয়ে দু’তিনবার চা-পান খাওয়া হয়ে গেলো।
সবাই এক সঙ্গে হাঁটি। আমার, আমাদের সকলের কৈশোরকাল যেন ফিরে আসে। বাজারে ঘুরতে গিয়ে কত চেনাজানা মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। বাজার দেখে অবাক হই। অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে পুরো বাজারজুড়ে ১৫-২০টি দোকান ছিল। বেশিরভাগই ছিল চা আর মুদির। এখন অনেক নতুন ধরনের দোকান হয়েছে। সংখ্যায় কম নয়, তিনশো হবে।
চায়ের দোকান, মুদি দোকান, ওষুধের দোকান, কসমেটিকস্ দোকান, অনেকগুলো সেলুন, মিষ্টির দোকান; এমনকি হার্ডওয়ার, রং, ঢেউটিন এসব দোকানও দেখলাম বেশ কটা। দুটো বেসরকারি ব্যাংক, তাদের এটিএম বুথসহ আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের বুথ। এসব দেখে একদমই গ্রামের বাজার মনে হয় না।
বাজার থেকে বাড়িতে ফিরে যাই। তারপর কী করে জানি তিনটে দিন পেরিয়ে যায়। নানা বাড়ি, নিজের বাড়ি, বন্ধুর বাড়ি, ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে যেতে হয়। সবাই মন-প্রাণ ভরে আপ্যায়ন করেন। কয়েকজনের ঘরে যেতে এবং খেতে না পারায় অসন্তুষ্ট হন। কী করবো? শেষে ওয়াদা করতে হয়, আবারও বাড়িতে যাওয়ার। সেটা রাখতে পারবো না জেনেও করি।
ভাই-বোনসহ ছোটদের প্রায় সবাই আরও একটা দিন বেশি থাকার বায়না ধরে। আমিও সায় দিই। তবে সাফ কথা, আমার দু’দিনের ছুটি শেষ। বাড়তি একদিন শুক্রবার, ডে অফও ছিলাম। কোনভাবেই আর থাকা সম্ভব না। আমাকে ফিরতে হবে। বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিন দিনের মাথায় আমার ফেরার সময় হয়।
চলে আসি বাজারে। বিকেল সাড়ে চারটায় বাসের সময়। রাত নয়টা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছে যাব। বাস কাউন্টারে গিয়ে অপেক্ষা। খানিক বাদেই বাস হাজির। বাস ভরা লোকজন। তারপরও এতগুলো মানুষের মাঝে ‘একা আমাকে’ নিয়ে ছুটে চলে বাস। মনটা পড়ে থাকে আমার শেকড়, স্মৃতিময় আর মায়াময় গ্রামের কাছে। জানি না, আবার কবে ফিরে আসবো গ্রামে। আদৌ আসতে পারবো কি না, সেটাই-বা কে জানে! মানুষ কি আর সব জানে? অবশেষে জানালার পাশে বসে মন খারাপ করে, প্রাণহীন দেহটা নিয়ে বাসের সাথে সাথে আমিও ছুটে চলি যন্ত্রের নগরের দিকে...
ঢাকা/এনএইচ
আরো পড়ুন