কৃষিভিত্তিক সমাজে চৈত্র সংক্রান্তির লোকাচার
যে কোনো বাংলা মাসের শেষ দিনটিকে ‘সংক্রান্তির দিন’ বলা হয়। আবহমান বাংলায় সংক্রান্তির দিন মানেই ছিল উৎসবের দিন। এক সময় বারো মাসে বারো সংক্রান্তি নানা উৎসব-আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন করা হতো। কালের পরিক্রমায় এখন এসব আনুষ্ঠানিকতায় ভাটা পড়েছে। কিন্তু কোনো কোনো এলাকায় এখনও চৈত্রসংক্রান্তি, পৌষসংক্রান্তি, মাঘীসংক্রান্তি ও কার্ত্তিক সংক্রান্তির আনুষ্ঠানিকতাগুলো টিকে আছে। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তি সব এলাকাতেই কমবেশি পালিত হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি মাত্র কিছুটা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে দিনটি পালন করেন।
কৃষিভিত্তিক সমাজে চৈত্রসংক্রান্তির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় একদিন আগে থেকে। অর্থাৎ মাস শেষ হওয়ার আগের দিন থেকে। সংক্রান্তির আগের দিনটিকে বলা হয় ‘হাড়বিসু’। আর চৈত্রসংক্রান্তির দিনটিকে বলা হয় ‘বিসু’। ত্রিপুরাদের ‘হারি বৈসু’ বা চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘বিজু’ শব্দের সঙ্গে ‘বিসু’ শব্দটির মিল আছে। বিসুর দিনটিকে কেউ কেউ ‘ছাতু সংক্রান্তিও’ বলেন। এখানে চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে হাওরাঞ্চলের কিছু আনুষ্ঠানিকতা ও লোকাচারের বর্ণনা দেওয়া হলো।
ঘরবাড়ি পবিত্র করা
হাড়বিসুর দিনে গৃহিণীরা প্রতিটি বাড়িঘর, মন্দির ও তুলসিতলা ভালোভাবে লেপা-মোছা করেন। কাপড় ধৌত করেন। বাড়ির উঠান ও আশপাশের ঝাড়-জঙ্গল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। অশুভ নজর এড়াতে গোয়াল ঘরের সামনে বিষ কুমড়োর লতা ঝুলিয়ে দেন। সন্ধ্যায় গোয়াল ঘরে ধূপ-ধোনা জ্বালান। এভাবেই বাড়িঘর পবিত্র করেন তারা।
শাকান্ন গ্রহণ
হাড়বিসু ও বিসুর দিনে প্রতিটি পরিবারে চিরাচরিতভাবে শাকান্ন (শাক+অন্ন) গ্রহণ করা হয়। এ দু’টি দিনে গৃহিণীরা নানা রকমের (কোথাও কোথাও ১৪ রকমের) শাক-পাতা রান্না করা হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই থাকে গিমা, নাইল্যা (পাটগাছ), নিম, নিশিন্দা, দন্ডকলস, হেলেঞ্চা, বেহই, প্রভৃতি তেতো (তিতা) জাতীয় শাক। এ ছাড়া থাকে কাঁচা আমের ডাল, সজনে ডাটা ও আলুর দম, নিরামিশ সবজি ও চাটনি প্রভৃতি। কিছু পরিবারে হাড়বিসুর দিনে ডিমও রান্না করা হয়। লোকবিশ্বাস এ রকম যে, এসব তেতো শাক-পাতা গ্রহণ করলে শরীর রোগবালাই মুক্ত থাকে। আর ডিমের খোলস ভাঙলে বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড়ের ডিম নষ্ট হয়ে যায়। এতে তাদের বংশবৃদ্ধি ব্যহত হয়। কেউ কেউ এ কথাও বিশ্বাস করেন, ওই দিন আকাশে মেঘ ডাকলে বা বৃষ্টি হলেও সাপ ও ক্ষতিকর প্রাণীকুলের ডিম চৌচির হয়ে নষ্ট হয়। সাপের উপদ্রব বেশি ছিল বলেই হয়তো বাসিন্দাদের এমন লোকবিশ্বাস।
গবাদিপশুর বিশেষ যত্ন
বিসুর দিন (চৈত্রসংক্রান্তির দিনে) সূর্য ওঠার পর পরিবারের গৃহস্থ ও রাখাল-কামলারা তাদের গরু, মহিষ, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, হাঁস-মুরগি প্রভৃতি গবাদিপশু নদীতে স্নান করাতে নিয়ে যান। একযোগে শত শত গরু, মহিষ ও ছাগল সারি বেঁধে নদীতে নিয়ে যাওয়ার সময় মিছিলের মতো মনে হয়। নদীর ঘাটে সূচনা হয় বিশেষ এক দৃশ্যের। এরপর গবাদিপশুগুলো বাড়িতে এনে আবির গোলা রঙে রঙিন করে সাজিয়ে দেন। পরিয়ে দেন রঙিন তাগি (তাগা বা সুতা)। এদিন গবাদিপশু দিয়ে কোনো রকম চাষাবাদ করা হয় না। উপরন্তু সেগুলোকে বাড়ির উঠানে বেঁধে বিশেষ যত্নে খাবার খেতে দেওয়া হয়। কামলা বা রাখালকেও উপহার হিসেবে দেওয়া হয় নতুন গামছা, লুঙ্গি, গেঞ্জি বা জামা-কাপড়। কৃষিভিত্তিক সমাজের গৃহস্থরা বিশ্বাস করেন, গবাদিপশু ও রাখাল-কামলাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই সারা বছরের কৃষিকর্ম সম্পাদিত হয়। তাই বিসুর দিনে বিশেষ যত্ন-আত্তি করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তারা। এ দিন গৃহস্থবাড়ির গোয়ালঘরটিকেও আবিরের রং ছিটিয়ে সাজানো হয়।
ছাতু দেওয়া
চৈত্র সংক্রান্তির একটি বিশেষ আচার ‘ছাতু দেওয়া’। এ দিন হিন্দু পরিবারের মেয়েরা ভাইদের মঙ্গল কামনা করে তাদের হাতে ছাতু তুলে দেন। এটি ভাইফোটার মতোই একটি লোকাচার। চৈত্র সংক্রান্তিকে সামনে রেখে আগেই ডাল ভেজে গুঁড়ো করে ছাতু তৈরি করা হয়। সংক্রান্তির দিনে কলা, দই, চিনি, গুর প্রভৃতি দিয়ে মেখে তা পরিবেশন করা হয়। এ কারণেই অনেকে দিনটিকে ছাতু সংক্রান্তি বলেন।
হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করা
চৈত্র সংক্রান্তির একদিন পরই পহেলা বৈশাখ। অর্থাৎ নববর্ষ। নতুন বছরের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা হিসাব-নিকাশের নতুন খাতা খোলেন। আয়োজন করেন হালখাতা উৎসবের। তাই বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিতে ব্যবসায়ী, মহাজন ও তাদের সরকার-কর্মচারীরা ব্যস্ত সময় কাটান। এদিন তারা বিগত বছরের পুরনো খাতায় লাভ-লোকসান ও দেনা-পাওনার হিসাব শেষ করেন। এরপর প্রস্তুতি নেন রাত পোহালেই নতুন খাতা খুলে হালখাতা (হালনাগাদ) করার।
চড়কপূজা
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে অনেক এলাকায় চড়কপূজার আয়োজন করা হয়। এটি মূলত গ্রামীণ কৃষি দেবতা শিবের আবাহন। দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি, নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান লাভ, ধন-সম্পদ অর্জন, মনের বাসনা পূরণসহ মহাদেবতা শিবের সন্তুষ্টি লাভই এ পূজার উদ্দেশ্য। শিবের গাজন, গম্ভীরা পূজা, নীলপূজা বা হাজরা পূজাও চড়কপূজারই নামান্তর। চড়ক পূজার আয়োজন নির্দিষ্ট বর্ণ-সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর আনন্দ-উৎসবে সব ধর্ম-বর্ণ-মতের মানুষে অংশগ্রহণ করেন।
মেলা
চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে অনেক জায়গায় মেলার আয়োজন করা হয়। এসব মেলায় মাটির পুতুল, পালকি, খেলনা, হাড়ি-পাতিল, পাখা, কূলা, ডালা, দা-বটিসহ গ্রামীণ কৃষি সরঞ্জাম, চুড়ি, আলতা, পাউডার, ফিতাসহ নারীদের প্রসাধন সামগ্রী ও মুড়ি, মুড়কি, কদমা, বাতাসা, প্রভৃতি খাদ্যসামগ্রীর পশরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা।
বলা হয়ে থাকে, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে ঠিক এমন কথারই প্রমাণ মেলে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে। লোকাচার ও লোকবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে পালন করে আসা এ দিনগুলোতে সব ধর্মমতের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির মেলবন্ধন সূচিত হয়। এ দিনগুলোতে মানুষ অতীতের সব হিংসা, বিদ্বেষ, গ্লানি ও ভেদ-বিভেদ ভুলে যায়। প্রত্যেকে প্রত্যেকের হয়ে ওঠে। তাই আধুনিক ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে গ্রামবাংলার এই লোকায়ত উৎসব-অনুষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য। কারণ এসব উৎসব-পার্বনের মধ্যেই বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয় নিহিত। এগুলো নিয়েই আমরা বাঙালি। এগুলোই বাঙালির চিরায়ত কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
লেখক: সাংবাদিক, ছড়াকার ও লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক
/তারা/