ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

অবহেলায় ঢাকার নবাবদের সমাধি

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২২, ১৫ এপ্রিল ২০২২   আপডেট: ১৩:২৫, ১৫ এপ্রিল ২০২২
অবহেলায় ঢাকার নবাবদের সমাধি

রাজধানী ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে নবাব পরিবারের নাম। বলা হয়ে থাকে তাদের হাত ধরেই আধুনিক ঢাকার সূচনা। 

এই নগরীর অনেক সৃষ্টি, উৎকর্ষ আর গোড়াপত্তনের সঙ্গে মিশে আছে নবাব খাজা আব্দুল গনি, নবাব খাজা আহছানুল্লাহ ও নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নাম। কিন্তু এই মানুষগুলো কোথায় চিরনিদ্রায় শায়িত, কেমন আছে তাদের সমাধিক্ষেত্র অনেকেই জানেন না। অনেকের ধারণা নবাবদের সমাধিক্ষেত্র আহছান মঞ্জিল বা তার আশপাশেই হবে। আসলে তা নয়। নবাব ও নবাব পরিবারের সদস্যদের সমাধিক্ষেত্র পুরান ঢাকার বেগম বাজারের কেএম আজম লেনে।

সরেজমিনে দেখা যায়, কেএম আজম লেনের রাস্তাটি এতটাই সরু যে, পাশাপাশি দুটো রিকশা চলাচল করতে কষ্ট হয়। যত্রতত্র আবর্জনা। সমাধিস্থলের মূল ফটকে ফলক পর্যন্ত নেই, ফলে নতুন কেউ জানতেও পারবেন না তাদের পরিচয়। চর্চা না থাকায় স্থানীয় তরুণরাও অনেকে জানেন না তাদের সঠিক নাম-পরিচয়।

জানা গেলো, এই লেনে মোট কবরস্থান আছে তিনটি। এর মধ্যে দুটি নবাব ও নবাব পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের। স্থানীয় প্রবীণের মাধ্যমে নবাবদের মূল সমাধিক্ষেত্রের খোঁজ পাওয়া যায়। এটি কেএম আজম লেনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। সর্ব সাধারণের সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। নবাব পরিবারের বংশধরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুমতি নিতে হয়। এই প্রতিবেদক অনেক চেষ্টা করে অনুমতি নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন। 

সরেজমিনে দেখা যায় সমাধিক্ষেত্রের পূর্বপাশে চারকোণাকৃতির স্থাপনার মধ্যে নবাব আহছানউল্লাহর কবর। তার পাশে গম্বুজ আকৃতির স্থাপনার ভেতরে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর কবর। কিন্তু হোঁচট খেতে হয় কবরের চারদিকে ময়লার স্তূপ দেখে। সধাধিক্ষেত্র অন্য আর দশটি কবরস্থানের মতোই সাদামাটা। 

কথা বলে জানা গেলো, নবাব পরিবারের বংশধররাই সমাধিক্ষেত্র দেখভাল করেন। এটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব গিয়াসউদ্দিন নামে এক ব্যক্তির। বিশ বছর ধরে তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানালেন, নবাবদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারসংশ্লিষ্টরা কবর জিয়ারত করতে আসেন বছরে কয়েকবার। নবাব ও তার পরিবারের সদস্যদের জন্য মূল সমাধিক্ষেত্র এটি। পাশের সামাধিক্ষেত্রটি নবাব পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশপাশের কিছু মানুষ ছাড়া পুরান ঢাকার অনেকেই জানেন না এখানেই সমাহিত আছেন ঢাকার নবাবরা। এলাকার এক সময়ের ফুটবল খেলোয়াড় মহির উদ্দীন বলেন, ৪০ বছর ধরে আমি পুরান ঢাকায় বসবাস করি। জন্মের পর থেকেই এখানে। এখানেই বেড়ে ওঠা। আরমানিটোলা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। এখানকার অলিগলির সঙ্গে মিশে আছে আমার অন্তরাত্মা, অলিগলি চষে বেড়িয়েছি, কিন্তু কখনোই চোখে পড়েনি এই সমাধিক্ষেত্র। কারণ কোথাও নামফলক বা দিকনির্দেশনামূলক চিহ্ন নেই। ঘটনাচক্রে সম্প্রতি সমাধিগুলো নজরে আসে। আমি মনে করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ই প্রবাদ পুরুষদের সমাধি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা। 

ইতিহাস জানাতে প্রচারও দরকার। পাশাপশি সমাধিক্ষেত্রের আশপাশের রাস্তা ও এলাকার উন্নয়ন জরুরি বলে মনে করেন মহির উদ্দীন। 

এলাকার প্রবীণ শিক্ষানুরাগী আহসান কবীর বলেন, ১৯০৫ সালে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা হয়। যদিও তার ৬ বছর পর ১৯১১ সালে বঙ্গ ভঙ্গ রদ হয়ে যায়! প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে এবং দেশের স্বনামধন্য সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এগুলোর প্রতিষ্ঠাকালীন প্রত্যক্ষ অবদান ছিল নবাব সলিমুল্লাহর। বলা হয়ে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে বড় লাটের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডার জেরে তাকে বিষ প্রয়োগে ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার চৌরঙ্গী রোডের ৫৩ নম্বর বাড়িতে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে হত্যা করা হয়। এগুলো বর্তমান প্রজন্মকে জানানো দরকার আর এ জন্যই সমাধিক্ষেত্রটির যথাযথ সংরক্ষণ করা উচিত। 

এদিকে পরিচারক গিয়াসউদ্দিন জানালেন নবাবদের সমাধিক্ষেত্র দেখভালের একটি কমিটি রয়েছে। এর প্রেসিডেন্ট খাজা মো. নাদের; ভাইস প্রেসিডেন্ট এস নাজমুল হক ও খাজা দিদার বখত; সেক্রেটারি সৈয়দ সাঈদ হোসেন; অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মোহসেন খাজা আহমেদ। কোষাধ্যক্ষ খাজা কালিম। খাজা মো. নাদের বলেন, ‘আমার দাদার নাম খাজা মো. সেলিম। তার কবর নবাব সলিমুল্লাহর কবরের পাশে। সে সময় পরিবেশ আসলে এখনকার মতো ছিল না। ছিল না এত ঘনবসতি আর বাড়িঘর।’ সমাধিক্ষেত্রসহ এলাকার উন্নয়ন প্রসঙ্গে খাজা নাদের বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলে নবাব পরিবারের সবাই বিষয়টি অবশ্যই ভেবে দেখবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের যত স্মারকচিহ্ন আছে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ আছে- প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। সেই বিভাগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এই নবাবরা আমাদের ইতিহাসের অংশ।’
 

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়