ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

কোরআনে বর্ণিত মানব জীবনে সফলতার সূত্র

মাওলানা শেখ ফজলুল করীম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৮, ১১ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৫:০৫, ১১ এপ্রিল ২০২৩
কোরআনে বর্ণিত মানব জীবনে সফলতার সূত্র

সফলতা মানব জীবনের পরম আরাধ্য বিষয়। আমরা জীবনের শুরু থেকেই সফলতার পেছনে ছুটি। সাধনা করে আমরা যে সফলতা পাই আদতে দেখা যায় সেটাও সফলতা না। বরং মরীচিকা। এভাবে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একদিন আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি হই। তখন আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। কোরআন বিষয়টিকে সুন্দর করে বর্ণনা করেছে, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও!’ (সুরা তাকসুর- ১,২)

মাগফিরাতের শেষ দিকে এসে আপনাদের সামনে কোরআনে বর্ণিত সফলতার সূত্রগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো যাতে আমরা সত্যিকারের সফলতায় পৌঁছাতে পারি।
পবিত্র কোরআনের ১৮তম পারা শুরু হয়েছে সুরা মুমিনুন দিয়ে। এই সুরার শুরুতেই সফলতার সূত্রগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

আরো পড়ুন:

মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে,
যারা নিজেদের নামাযে বিনয়ী-নম্র;
যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত,
যারা জাকাত দান করে থাকে
এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গ সংযত রাখে।
তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না।
অতঃপর কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমা লঙ্ঘনকারী হবে।
এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে।
এবং যারা তাদের নামাযসমূহের খবর রাখে।
তারাই উত্তরাধিকার লাভ করবে।
তারা শীতল ছায়াময় উদ্যানের উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা তাতে চিরকাল থাকবে।

এখানে সফলতার চাবিকাঠি বলে দেয়া হয়েছে। এই কয়েকটা কাজ করলেই মানুষ সফল হতে পারবে। সেই কাজগুলো হলো:

সফলতার সূত্র- ১

ঈমান আনতে হবে। এখানে প্রথম আয়াতেই মুমিনদের সফল বলা হয়েছে। এ ছাড়াও কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সফলতার জন্য ঈমানকে প্রধানভিত্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা গায়বের প্রতি ঈমান আনে, নামায কায়েম করে এবং আমি যে জীবনোপকরণ তাদের দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।

আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে। আর আখিরাতের প্রতি তারা ইয়াকীন রাখে।
তারা তাদের রবের পক্ষ থেকে হিদায়াতের উপর রয়েছে এবং তারাই সফলকাম। সুরা বাকারা-৩, ৪ 

সফলতার সূত্র- ২

যারা নামাজ আদায়ে বিনয়ী ও নম্র। নামাজে এই গুণটাকে আরবী পরিভাষায় ‘খুশু-খুজু’ বলা হয়। নামাজে ‘খুশু-খুজু’ অর্জন করাকে সফলতার সূত্র হিসেবে বলা হয়েছে। চার নামাজের মধ্যে চারটি গুণ পাওয়া যাবে তার নামাজ ‘খুশু-খুজু’র স্তর স্পর্শ করেছে বলা যাবে। গুণগুলো হলো:
ক. কোন নামাজ পড়ছি সেই সম্পর্কে নামাজজুড়ে অনুধাবন থাকতে হবে
খ. নামাজের মাসয়ালাগুলো মনে হাজির থাকা
গ. নামাজের প্রতিটি কার্যক্রম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মতো করে আদায় হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে সতর্ক থাকা
ঘ. ‘আমি নামাজে আদায় করছি, আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন’ এমন অনুভূতি জাগ্রত রাখা। আমরা যখন কোনো সম্মানিত মানুষের সামনে দাঁড়াই তখন আমাদের মধ্যে যে সতর্কতা, যে আজমত এবং যে ভয় কাজ করে তার তুলনায় কোটিগুন সতর্কতা, ভয় ও আজমত আমাদের মধ্যে কাজ করবে যদি আমরা এই গুণ অর্জন করতে পারি। 

নামাজে এই গুণ অর্জন করা যে কোনো ইবাদাতের একেবারে প্রাথমিক স্তর। বিখ্যাত হাদিসে জিব্রাইলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত জিব্রাইল আলাইহিস সালামের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছো। আর তুমি যদি তাকে না-ও দেখো, তিনি তোমাকে অবশ্যই দেখছেন।’

আমরা আল্লাহকে দেখছি এমন অবস্থা তৈরি করা খুবই সাধনা ও প্রচেষ্টার বিষয়। কিন্তু আল্লাহ আমাকে দেখছেন এমন স্তর অর্জন করা তুলনামূলক সহজ ও আবশ্যক।
হজরত আলী রাদি. নামাজের অজু করার সময় তার মুখমণ্ডল লাল হয়ে যেতো। তিনি স্তম্ভিত হয়ে থাকতেন। কারণ হিসেবে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি। একবার তার পায়ে তীর বিদ্ধ হলে ব্যথায় কোনোভাবেই তীর বের করতে দিচ্ছিলেন না। নামাজের সময় হলে তিনি যখন নামাজে দাঁড়ালেন তখন তার পা থেকে তীর বের করে নেয়া হলো। তিনি বুঝতেও পারলেন না।

এই হলো নামাজে ‘খুশু-খুজু’র অবস্থা। এই অবস্থা অর্জন করা সহজ হলেও নিজের আমলের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে, আপনি আপনার জীবনের দীর্ঘকাল এভাবে ইবাদাহ করতে পারেন নাই। আসলে এ জন্যও সাধনার দরকার। আত্মশুদ্ধির পথ অবলম্বন করতে হয়। শরীয়ায় আত্মশুদ্ধির অনেক পন্থা অনুমোদিত আছে। এর মধ্যে কোরআন তেলাওয়াত করা, বেশি বেশি জিকির করা, উলামায়ে কেরামের সংস্পর্শে থাকার কথা বলা আছে। এবং সহিধারার কোনো পীর-মাশায়েখের সাথে সুলুকের সম্পর্ক রাখার কথাও বলা আছে। আপনার জন্য সহজ হয় বা আপনার তবিয়তের সাথে যায় এমন কোনোভাবে সুলুকের সাধনা করলে এই অবস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে। আর এটা করতেই হবে কারণ এটাকেই আল্লাহ তায়ালা সফলতার সূত্র হিসেবে বলেছেন।

সফলতার সূত্র- ৩

‘আর যারা অনর্থক কথা-কর্ম থেকে বিরত থাকে’। অনর্থক বলতে যে কথা-কাজে দুনিয়া ও আখেরাতে কোনো উপকার হয় না এমন কিছু বলা বা করা। আমাদের সমাজে চিত্তবিনোদনের নামে প্রচুর অনর্থক কথা ও কাজের প্রচলন ঘটানো আছে। সমাজে সেগুলোকে আয়োজন করে পালন করা হয়। যেমন ক্রিকেট-ফুটবল, বক্সিংসহ নানা ধরনের খেলা দেখা। বিশ্বকাপগুলোর সময় দেশে যে অবস্থা তৈরি হয় তা আর নতুন করে বলার কিছু নাই। সবাই বুঝতে পারে যে, এসব উম্মাদনার মধ্যে কোনো ধরনের লাভ নাই। বসে বসে আড্ডা দেয়া, উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো, নানা ধরনের পার্টি করা, নাটক-সিনেমা দেখাসহ আরো হাজারো রকমের অনর্থক-বেহুদা কাজ সমাজে প্রচলিত আছে। এগুলো ত্যাগ করাকে সফলতার সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে মনে রাখতে হবে, একটু খেয়াল করে নিয়ত শুদ্ধ করে করলে মুমিনের কোনো কাজই অনর্থক না। আল্লাহ তায়ালা একান্ত ব্যক্তিগত কাজগুলোকেও অর্থবহ করে নেবেন; শুধু তাই না বরং সেগুলোর জন্য আপনাকে নেকিও প্রদান করবেন। স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোকে ইসলাম নেকির কাজ বলে গণ্য করেছে। সন্তান-বাবা-মা-স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, স্ত্রীকে মুখে তুলে খাওয়ানোকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। তবে সর্বক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, আমি এগুলো করছি কারণ আল্লাহ আমাকে এগুলো করতে বলেছেন বা করার অনুমোদন দিয়েছেন। তাহলে এগুলোও অর্থবহ কাজে পরিণত হবে।

সফলতার সূত্র- ৪

‘যারা জাকাতের ক্ষেত্রে সক্রিয়’। জাকাত ইসলাম নির্দেশিত অন্যতম প্রধান ইবাদাহ। কোরআনে প্রায় প্রতিটি জায়গায় নামাজের সঙ্গে জাকাতের উল্লেখ করা হয়েছে। জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে হজরত আবু বকর রাদি. এর মতো নরমদিলের মানুষ যুদ্ধও করেছেন। জাকাত আদায় না করলে তার ভয়াবহ শাস্তির কথা আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করে বলেন, ‘আর যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেওয়া হবে। (আর বলা হবে) এটা তাই যা তোমরা নিজদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ করো।’ [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৫, ৩৬]

এর বিপরীতে সক্রিয় হয়ে জাকাত আদায় করাকে সফলতার সূত্র হিসেবে বলা হয়েছে। জাকাত আদায় করার ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
ক. আধুনিক জটিল অর্থনীতিতে জাকাতের হিসাব খুবই সতর্কতার সাথে করতে হবে। সেজন্য দক্ষ কোনো উস্তাদ বা একাডেমি থেকে শিখে নিতে হবে।
খ. বিনয় ও সম্মানের সঙ্গে রিয়ামুক্ত জাকাত আদায় করতে হবে।
গ. জাকাতগ্রহিতার সঙ্গে কোনো ধরনের খোঁটামূলক আচরণ করা যাবে না।

সফলতার সূত্র- ৫

‘যারা তাদের নিজদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী’। জৈবিক চাহিদা মানব প্রজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম জৈবিক চাহিদাকে স্বীকার করে এবং এই চাহিদা পূরণের জন্য চমৎকার পথ নির্দেশ করে। ইসলাম নির্দেশিত সেই পন্থা ছাড়া অন্যসকল উপায় থেকে লজ্জাস্থানকে হেফাজত করা সফলতার অন্যমত সূত্র। ইসলাম বিয়ে করাকে খুবই সহজ করেছে। আর জিনাকে গুরুতর অপরাধ ঘোষণা করেছে। বর্তমান সমাজে বিয়েকে কঠিন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা ক্যারিয়ার বিল্ডআপ করার মতো ঠুনকো অজুহাতে বিয়েকে পিছিয়ে দেয়া সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং মানুষকে সফলতার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা এই বিষয়ে সতর্ক হবো। জিনা এবং জিনার দিকে ধাবিত করে এমন সকল কিছু থেকে ফিরে থাকবো ইনশাআল্লাহ।

সফলতার সূত্র- ৬

‘যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে’। এটা সফলতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। মুসলমানদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো এই আমানত রক্ষা করা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে রক্ষিত কাফেরদের আমানত রক্ষায় নিজের চাচাতো ভাইকে মৃত্যুর হুমকি নিয়েও দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় মুসলমানদের কিংবদন্তিতুল্য সুনাম ছিলো। এর প্রতিদান মুসলমানরা পেয়েছে। অথচ আজকে আমাদের আমানত রক্ষা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার অবস্থা কতটা খারাপ তা প্রত্যেকে নিজের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আসুন! পবিত্র রমজানে আমাতন ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

সফলতার সূত্র- ৭

‘আর যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে যত্নবান’। প্রথমটা ছিল নামাজে ‘খুশু-খুজু’ আনার ব্যাপারে। আর শেষটা হলো নামাজে যত্নবান হওয়া। সময়মতো নামাজ আদায় করা। মনোযোগ সহকারে নামাজ আদায় করা। জামাতে নামাজ আদায় করা। অনেক সময় কাজের চাপে নামাজের সময় পেছাতে পেছাতে একেবারে শেষ মুহূর্তে আদায় করা হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখা যায়। এমনকি রমজান মাসেও ইফতারের আয়োজন করতে করতে আছরের নামাজ শেষ ওয়াক্তে পড়া এবং ইফরাতির পরে গোছাতে গোছাতে মাগরিবের নামাজ শেষ মুহূর্তে পড়ার মতো ঘটনা দেখা যায়। এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সব কাজের আগে নামাজকে প্রধান্য দিতে হবে।

কোরআনে বর্ণিত সফলতার এইসব সূত্র যদি আমরা আমাদের নিজেদের জীবনে অনুসরণ করতে পারি তাহলে আশা করা যায় আমরা সফলকাম হবো। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তৌফিক দান করুন।

শাহেদ/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়