ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

শুক্রবার রমনায় ‘বই পড়ার নীরব বিপ্লব’

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১২ আগস্ট ২০২৩   আপডেট: ১১:১২, ১৮ আগস্ট ২০২৩
শুক্রবার রমনায় ‘বই পড়ার নীরব বিপ্লব’

‘বই পড়ার নীরব বিপ্লব’ এ পড়ছেন পাঠক

শুক্রবার বিকেল ৩টা। শ্রাবণের শেষ দিনগুলোতে টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। রমনা পার্কের গাছপালা সেজেছে অপরূপ রূপে। বর্ষার শুনশান নীরবতা। এই নীরবতা ভেঙে একজন দু’জন করে তরুণ-তরুণীরা আসছে। হাতে তাদের বসার বা শোয়ার মাদুর আর বই। কেউবা এনেছে হুমায়ুন আহমেদ কেউ বিভূতিভূষণ কেউ সমরেশ, আবার কেউ পাওলো কোয়েলহো বা কলিন হুভা। কেউ কেউ আবার নিয়ে এসেছিলেন ইতিহাসের বই। আবার কেউ এনেছে নন ফিকশন বই। দেখতে দেখতে চলে এলো প্রায় ২০-২২ জন তরুণ-তরুণী। তাদের সবার বয়স ১৮ থেকে ৩০ এর মধ্যে। তারা এসেছে ‘বই পড়ার নীরব বিপ্লব’ কর্মসূচিতে। 

উন্মুক্ত জায়গায় পড়ার এমন বিপ্লবের শুরুটা চলতি বছর জানুয়ারির ৭ তারিখ। ভারতের অন্যতম ব্যস্ত শহর বেঙ্গালুরুর কাবোন পার্কে। বই পড়ার উদ্দেশ্যে দুই বন্ধু মিলে খোলেন একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট। নাম দেন ‘কাবোন রিডস’। একই রকমভাবে জড়ো হওয়ার স্থানের নামের সাথে রিডস যোগ করে অন্য বড় বড় শহরগুলোর জন্যও খোলা হয়েছে পৃথক পৃথক অ্যাকাউন্ট। রমনার এই কর্মসূচিও ঢাকা রিডস নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। 

‘বই পড়ার নীরব বিপ্লব’ এ পড়ছেন পাঠক

রমনায় শুরু হওয়া বই পড়ার নীরব বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী পাঠকের সাথে কথা হলো। তারা নিজেকে এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে পেরে বেশ আনন্দিত। এই কর্মসূচির সাথে প্রথম থেকে জড়িত রউফুন নবী জানালেন, মূলত আমাদের সংগঠন ‘ভলান্টিয়ার অপরচুনিটি’ সারা বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত কাজ করে থাকে। আমরা মূলত ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে ‘সাইলেন্ট বুক রিডিং ইনিশিয়েটিভ’ বা বই পড়ার নীরব বিপ্লব কর্মসূচি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। ভেবেছি এমন চমৎকার উদ্যোগ তো আমরা বাংলাদেশেও নিতে পারি। সেই সুবাদেই আমরা ৭ জুলাই (শুক্রবার) থেকে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ছোটবড়, বয়স্ক সকলেই এসে বই পড়তে পারেন। 

রমনা পার্ক বেছে নেওয়ার কারণে হিসেবে তিনি বলেন, এখানকার পরিবেশ বেশ চমৎকার। এখানকার মতো পরিবেশ ঢাকায় আর কোথাও নেই বললেই চলে। পরিবেশের সাথে প্রকৃতির সাথে মিশে থেকে বই পড়ার যে বিষয়টি সেটিকেই আমরা উৎসাহিত করছি। কেননা এখানে এসে তারা বইও পড়তে পারবে, প্রকৃতির অনুভব করতে পারবে। প্রতি শুক্রবার ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত বই পড়া হয়। এরপর পঠিত বই নিয়ে আলোচনা, অনেক সময় গঠনমূলক বিতর্কও হয়। 

রউফুন নবী জানালেন, প্রথম দিন থেকেই ব্যাপক সাড়া মিলেছে। যেহেতু এই কনসেপ্ট নিয়ে বাংলাদেশে আর কোথাও কাজ হয়নি। আমাদের লক্ষ্য হলো, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ৪৯৫টি উপজেলার অত্যন্ত প্রত্যন্ত এলাকাতেও বই পড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা। তারাও যেন নিজে থেকে শুরু করতে পারে। যেমন সারা বাংলাদেশ থেকে ফোন পাচ্ছি। কুমিল্লাতে আজকে করা হয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে বগুড়া, গাজীপুরে শুরু হয়েছে। এ ছাড়া, বেশকিছু জেলা থেকে পরামর্শ নিচ্ছে। হয়তো তারাও দ্রুত শুরু করবে। যারা এখানে আসবেন তারা কী পড়বেন তা নির্ধারিত করা কিনা জানতে চাইলে জানালেন, নির্ধারিত নেই। গল্প, উপন্যাস, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ক্লাসের বই কিংবা গবেষণাপত্র যেকোনও কিছুই পড়তে পারবে। মূলত পড়াকে উৎসাহিত করতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান।

আজকে কী বই পড়ছেন জানতে চাইলে রওফুন জানালেন, আমি গত সপ্তাহে ইন্দ বালা ভাতের হোটেল বইটি শুরু করেছি। যেহেতু আমার ইতিহাস নিয়ে বেশি আগ্রহ তাই এটি পড়ছি। 

নীরবে বই পড়ার এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এক পাঠক বলেন, কর্মব্যস্ততার চাপে ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার একসময় সপ্তাহে দুটো বই শেষ করার অভ্যাস ছিল। কাজের চাপে যেটা প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ রমনায় এই উদ্যোগ দেখে তাই ছুটে চলে এলাম।

‘বই পড়ার নীরব বিপ্লব’ এ পড়ছেন পাঠক

বই পড়তে আসা মাইশা জানালেন, আমি অনেকদিন ধরেই ভলান্টিয়ার অপরচুনিটি গ্রুপের কর্মকাণ্ড দেখে আসছি। যদিও আজকেসহ তিন সপ্তাহ হলো বই পড়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার। কিন্তু আমি আজকে প্রথম আসলাম। আসলে প্রথম থেকেই থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সময় সুযোগ হচ্ছিল না। তাই আজকে থেকে শুরু করলাম। আমি আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাইকে বলেছে যে, তারাও যেন চলে আসে এই কর্মসূচিতে। ভলান্টিয়ারিং কাজের কথার যে একটি মূল্য আছে, এই কর্মসূচিতে তা প্রমাণ হয়েছে। আমরা ইন্ডিয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যখন বাংলাদেশে কাজটি করা শুরু করেছি। তখন সফলভাবে শুরু করতে পেরেছি। তরুণরা চাইলে যে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারে, বই পড়ার নীরব বিপ্লবই তার প্রমাণ।

বই পড়তে লাইব্রেরি আছে, সেখান থেকে বাদ দিয়ে কেন রমনা পার্ক প্রশ্নের জবাবে মাইশা বলেন, আমাদের চারপাশে পড়ার জায়গাগুলা লাইব্রেরিগুলো অনেক দূরে হয়। তাছাড়া সেখানে নিজের ইচ্ছেমত বই পড়া যায় না। বাইরে থেকে বই নিয়ে গিয়েও পড়া যায় না। আর এখন বেশিরভাগ লাইব্রেরিতে চাকরিপ্রার্থী পড়ুয়াদের কারণে জায়গা পাওয়া যায় না। এজন্য রমনা পার্ক সব দিকে থেকে আরামদায়ক। প্রকৃতির সাথে বই পড়ার যে আনন্দ তা যে পায়নি, সে বুঝবে না।

নীরবে বই পড়া উদ্যোগের নেপথ্যে আছেন মিথুন দাস কাব্য। ভলান্টিয়ার অপরচুনিটিজ সংগঠনের কাণ্ডারিও তিনি। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া এ সংগঠনটি মূলত তরুণদের নিয়ে কাজ করে। 

কথা হয় রমনা পার্কে বই পড়ার নীরব বিপ্লবের প্রধান সমন্বয়ক মিথুন দাস কাব্যের সাথে। তিনি জানালেন, যদিও আমাদের অনুপ্রেরণা ভারতের হায়দ্রাবাদের কাবোন পার্কে বই পড়ার বিপ্লব থেকে। তবে আমার ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বিষয় জড়িত। তিনি বলেন, আমরা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের সংবাদ জানতে পারি বইয়ের মাধ্যমে। একসময় আমি প্রচুর বই পড়তাম। কিন্তু কর্ম জগতে প্রবেশের পর দেখা গেলো বই পড়া আর হয়ে উঠছে না। এক বই শেষ করতেই অনেক সময় লাগছে। আমার মধ্যে বই পড়ার বিষয়টি ব্লক হতে শুরু করল। বিষয়টি আমাকে ভাবায়। এটা হয় এ কারণে যে, আমি যান্ত্রিকতার মধ্যে ঢুকে গেছি। ফলে বই পড়ার নেশা কমে গেছে। আমার মতো অনেকেই এমন যান্ত্রিকতার ভিড়ে রিডার্স ব্লকে আক্রান্ত। এই ব্লক কাটানোর উপায় খুঁজছিলাম। এমন সময় পেয়ে গেলাম ভারতের সেই স্টোরিটি। ফলে এটিকে ঢাকাতেও ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করছি। এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে নিজ সংগঠন ভলান্টিয়ার অপরচুনিটির সদস্যদের সম্পৃক্ত করা হলেও দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। 

হায়দ্রাবাদের কাবোন পার্কে ‘বই পড়ার নীরব বিপ্লব’

তিনি উল্লেখ করে বলেন, প্রতিনিয়ত আমাদের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। সবাই উৎসাহিত করেছে। ইতোমধ্যে অনলাইনে বই বিক্রির একটি প্ল্যাটফর্ম বই দিয়েছে। আমি আশা করছি না যে সারা বাংলাদেশের সকল জেলায় উপজেলায় এমন বই পড়ার বিপ্লব হবে। তবে এটা আশা করি সারা দেশের কিছু শহরের কিছু পার্কে এমন বই পড়ার বিপ্লব হবে। তরুণরা যান্ত্রিকতা, মাদক ছেড়ে বইয়ের আড্ডা দেবে। একজন মানুষকে চায়ের দাওয়াত দেওয়া সহজ কিন্তু তাকে বই পড়ার দাওয়াত দেওয়া কঠিন।

সার্বিকভাবে তার অনুভূতি জানতে চাইলে মিথুন বলেন, আমি খুব খুশি। আমাদের নেওয়া উদ্যোগে একজন মানুষও যদি নতুন করে বই পড়তে আগ্রহী হয় তবুও নিজেকে সফল ভাবব। আমরা আশাতীত রেসপন্স পেয়েছি। এখন বর্ষার দিন বিধায় পাঠক কম। তবে আমাদের থেকে আইডিয়া নিয়ে অনেকে শুরু করতে চাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বগুড়া, গাজীপুর কুমিল্লাতে শুরু হয়েছে। রংপুর, জামালপুরেও শিগগিরই শুরু হবে। আমাদের আহ্বানে মানুষ বই পড়ছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে? 

ঢাকা/এনএইচ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়