প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় : সূচনাপর্বের শক্তিশালী সাহিত্যিক
অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
অলাত এহ্সান
সূচনাপর্বেই বাংলা ছোটগল্পকে একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সমৃদ্ধ উন্মেষ ও বিপুল প্রাণশক্তিতে গল্পের ভাবনা, বিচিত্র বিষয় নির্বাচন, বিশ্বস্ত উপস্থাপন আর আঙ্গিক শৈলির জন্য এখনও তিনি অনন্য। গল্পে ব্যবহৃত উপকরণের প্রয়োজনীতা, চমৎকার পরিমিতিবোধ, বয়ানে নিপূণতা এবং ব্যাকরণ সিদ্ধতায় তার গল্প বিশিষ্ট্। গল্পসাহিত্যের সূচনাপর্বেই এমন সমৃদ্ধি যেকোনো দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে থাকে। প্রভাতকুমার উত্তর দীর্ঘ সময় বিভিন্ন লেখকের মধ্যে তার গল্পের প্রভাব এ কথা প্রমাণ করে।
কোনো না কোনো দিক দিয়ে তিনি এখনো মূর্ত-প্রাসঙ্গিক। তিনি যেমন অনাবিল হাসির গল্প লিখেছেন, তেমনি হৃদয় উন্মেলিত সামাজিক, বিরহ, প্রণয় কাহিনিও লিখেছেন। সব ক্ষেত্রেই তিনি অনবদ্য। মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতি উপস্থাপন করেছেন সরস ও সাবলীল ভঙ্গিতে। সমাজের কেরানি, উকিল, মালি, জেলারসহ নানান পেশার মানুষ নিয়ে চমৎকার সব গল্প লিখেছেন। তার গল্পে গভীর জীবনবোধের সঙ্গে হাস্যরস ও মানব হৃদয়ের স্নেহ ও প্রেমের চিরন্তন ধারা বহমান।
বাংলা গল্প সাহিত্যের ইতিহাস স্মরণ করতে গেলে প্রথমেই যে দু’জনের কথা মনে পড়ে তারা হলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সমসাময়িক। প্রভাতকুমারের জন্ম রবীন্দ্রনাথের জন্মের(৭ মে ১৮৬১খ্রি.) প্রায় একযুগ পরে, ১৮৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। আবার রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’র প্রথম গল্প ‘ঘাটের কথা’ ১৮৮৪ সালের দিকে লেখা। অন্যদিকে ১৮৯৫-৯৯ সালের মধ্যে প্রভাতকুমারের প্রথম গল্পসংকলন ‘নবকথা’ রচিত। অর্থাৎ অনেকটা কাকতালীয় হলেও তাদের জন্ম ও গল্পলেখার শুরু দুই-ই একযুগের ব্যবধানে। তবে প্রায় সমসাময়িক লেখক হয়েও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্র ধারার স্বার্থক উত্তর সাধক। প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য পেয়েছিলেন প্রভাতকুমার। তার ‘দেবী’ আখ্যান ভাগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তার একটি গল্পগ্রন্থের ‘গল্পাঞ্জলি’ নামকরণ থেকেও তা বোঝা যায়। কিন্তু দ্রুতই তিনি স্বকীয়তা তৈরি করতে পেরেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যেখানে তার কবি সত্তা থেকেই কল্পনা ও গীত প্রধান, প্রভাতকুমার সেখানে কথার বুননে বাস্তব-সত্যে নিষ্ঠাবান। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ ও প্রভাতকুমারের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি তুলনা করলে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এদিক দিয়ে প্রভাতকুমার অনেক বেশি গাল্পিক ও নিটোল। আমাদের মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্র মহীরূহের নিচে স্বকীয়তা তৈরি সে সময় মোটেও সহজ কাজ ছিল না। প্রথম জীবনে তিনি রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছিলেন। যে কারণে তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে ৪ খণ্ডে রবীন্দ্রজীবনী রচনা করার। যা এখনো যেকোনা রবীন্দ্র গবেষক ও জীবনী লেখকের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বস্ত ও প্রমাণিক। একথা সত্য, রবীন্দ্রনাথ প্রসিদ্ধি বহুমুখী, প্রভাতকুমারের প্রসিদ্ধি শুধু গল্পে।
প্রভাতকুমারের গল্পের শক্তি বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়কেও আকর্ষণ করেছিল। তিনি প্রভাতকুমারের ‘দেবী’ গল্প অবলম্বনে বিখ্যাত ‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। পৌত্তলিক বিশ্বাসের শিকার হয়ে একজন নারীর জীবন কীভাবে বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে এবং ট্রাজেডিতে রূপ নিতে বাধ্য হয়, তা এই গল্পে উঠে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি সমাজাচারের মানুষের বন্দিত্বের সমালোচনাও করেছেন, যা সে সময়ের অগ্রগামী মানসিকতা ও শক্তির পরিচয় বহন করে। গল্পটি সম্পর্কে সাহিত্য সামালোচক জগদীশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেবী’ গল্প রচনার পর পঞ্চাশ বৎসরের অধিক কাল ধরে বাংলা ছোটগল্প অনেক পথ অতিক্রম করেছে। কিন্তু ছোটগল্পের সর্বাঙ্গীণ বিচারে এর সাফল্য ও উৎকর্ষ এখনো অনতিক্রম্য বলে মনে হয়।’
এই মন্তব্য সম্ভবত তার সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় গল্প ‘ফুলের মূল্য’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ গল্পে তিনি দেখান, একটা বৈরি সময়েও মানুষের হৃদয় ভালবাসা-মানবিকতা শূন্য হয়ে যায়। কিংবা এটা ভারতীয় সংস্কৃতির শক্তিরও অংশ।
সাহিত্যের মতো প্রভাতকুমারের জীবনও কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। ভারতের বর্ধমান জেলার ধাত্রীগ্রামে নানার বাড়িতে তার জন্ম। পৈত্রিক বাড়ি হুগলি জেলার গুরুপে। জীবনের প্রথম বেলায় খানিকটা অর্থকষ্ট তাকে ভোগ করতে হয়। পাটনা কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তারপর সিমলা ও কলকাতায় সরকারি কেরানি পদে চাকরি করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ে সম্পর্কিত সামাজিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। পরে একান্ত নিজের প্রচেষ্টায় তিনি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যান। দেশে ফিরে সে পেশায় নিয়োজিতও ছিলেন অনেকদিন। ১৯১৬ সালে তিনি আইন কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। আমৃত্যু তিনি এখানেই ছিলেন। সমাজের মানুষের কষ্ট তুলে আনার ইচ্ছে থেকে তিনি পত্রিকা সম্পাদনার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় চৌদ্দ বছর তিনি ‘মানসী’ ও ‘মর্মবাণী’ সম্পাদনা করেন।
একটি ব্যঙ্গকবিতা দিয়ে সাহিত্য যাত্রা শুরু হলেও গল্পকার হিসেবেই প্রভাতকুমারের খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি। তিনি ১২টি গল্পগ্রন্থে মোট ১১৮টি গল্প লিখেছেন। যা যেকোন সাহিত্যের ভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ। তার গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে- নব-কথা, ষোড়শী, দেশী ও বিলাতী, গল্পাঞ্জলি, গল্পবীথি, পত্রপুষ্প, গহনার বাক্স, হতাশ প্রেমিক, বিলাসিনী, যুবকের প্রেম, নূতন বউ এবং জামাতা বাবাজী।
তবে এই গল্পকার পরিচয়ের আড়ালে তার ঔপন্যাসিক পরিচয় ঢাকা পড়ে যায়। তিনি ঔপন্যাসিক ও কবি। কবিতায় তার পথচলা তেমন না হলেও তিনি ১৩টি উপন্যাস লিখেছিলেন। এগুলো হলো-রমাসুন্দরী, নবীন সন্ন্যাসী, রত্নদীপ, জীবনের মূল্য, সিন্দুর কৌটা, মনে মানুষ, আরতি, সত্যবালা, সুখের মিলন, সতীর পতি, প্রতিমা, গরীব স্বামী, নবদূর্গা ও বিদায় বাণী। তবে এগুলো তেমন পাঠকপ্রিয় কিংবা কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠেনি। তবে গ্রন্থাকারে প্রকাশের বাইরে তার অনেক সাহিত্যকর্ম সে সময়ের পত্র-পত্রিকায় এখনো ছড়িয়ে আছে।
প্রভাতকুমারকে প্রায়ই ফরাসি প্রকৃতিবাদী লেখক গী দ্য মোপাসাঁ’র সঙ্গে তুলনা করা হয়। মোপাসাঁ নিঃসন্দেহে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার। তথাপি এই তুলনা অনেকটা ঔপনিবেশিকতা প্রভাবিত বলে মনে করা যেতে পারে। অর্থাৎ পাশ্চাত্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে তার সঙ্গে তুলনা করা। মোপাসাঁর সঙ্গে প্রভাতকুমারের পার্থক্যও ছিল। মোপাসাঁ শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিতে আশ্রয় নেন। অর্থাৎ একটা বিশেষ মুহূর্তে মানুষের ভেতরের পশুবৃত্তি বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রভাতকুমারের গল্পের চরিত্রে বিশেষ মুহূর্তে মানবিক বোধ ও হৃদয়বৃত্তের জয় হয়। এ ক্ষেত্রে ফরাসি সাহিত্যে পণ্ডিত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই প্রণিধান যোগ্য। ১৯১৩ সালের এক চিঠিতে তিনি প্রভাতকুমারকে লিখেছিলেন,‘বড় বড় ফরাসী গল্প-লেখকদের অপেক্ষা তোমার গল্প কোনো অংশে হীন নহে।’
সূচনাপর্ব কিংবা ঊনবিংশীয় বস্তবতার প্রভাব বা সীমাবদ্ধতা সত্যেও প্রভাতকুমারের গল্প নিঃসন্দেহে সে সময়ের যেকোনো মহান গল্পকারের সমপর্য়াভূক্ত করা যেত। এ কথা উল্লেখ্য যে, বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পকারদের মধ্যে প্রভাতকুমারের গল্পই প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। ১৯৩২ সালের ৫ এপ্রিল এই মহান সাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম