ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

এই কন্যা শিশুটি গাজায় তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২১, ২০ মে ২০২৫  
এই কন্যা শিশুটি গাজায় তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়ছে

গায়ে তার গোলাপি রঙের পাতলা একটি সোয়েটার। বয়স ১২ বছর। দুই হাতে পানিভর্তি দুটি বালতি নিয়ে সে গাজার এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তার চারপাশে ধ্বংসস্তূপ, ধুলো এবং ধুলোর স্তূপ। জানা নামের এই ১২ বছর বয়সী মেয়েটি একটি মিশনে রয়েছে: খাবার ও পানি খুঁজে বের করা।

জানা মোহাম্মদ খলিল মুসলেহ আল-স্কেফি জানিয়েছেন, এক বছরেরও বেশি সময় আগে একজন ইসরায়েলি স্নাইপার তার বড় ভাইকে হত্যা করে। এরপর থেকে সে তার পরিবারের জন্য খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছে। তার বাবা-মায়ের স্বাস্থ্য খারাপ, তাই এখন তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব তার উপর।

গাজা শহরের একটি পানি বিতরণ লাইনে অপেক্ষা করার সময় জানা সিএনএনকে বলেন, “আমি চাই না আমার বাবা ক্লান্ত হয়ে পড়ুক। এই কারণেই আমি শক্তিশালী। আমি শক্তিশালী থাকতে চাই, যাতে আমার বাবা কষ্ট না পান। আমার বাবা বয়স্ক এবং তার হৃদরোগ আছে। যদি তিনি বালতি বহন করার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি মারা যাবেন।”

বাবাকে কঠোর পরিশ্রম থেকে অবকাশ দিতে ছোট্ট মেয়েটি পুরো পথ ধরে পানি ভর্তি দুটি ভারী বালতি বহন করে বাড়ি ফিরে গেল। ভারী বোঝায় তার আঙুল লাল হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে গাজাবাসীর জন্য অতিমূল্যবান পানিতে জানার জিন্সের প্যান্টটি ভিজে গেছে।

৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে খাবার ও পানি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ১১ সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে ইসরায়েল গাজায় সব ত্রাণের প্রবেশের উপর সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করার পর থেকে পরিস্থিতি আরেো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। চলতি মাসের শুরুতে প্রকাশিত জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার প্রতি পাঁচজনে একজন মানুষ অনাহারের সম্মুখীন হচ্ছে। ২১ লাখ মানুষের আবাসস্থল এই অঞ্চলটি মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরায়েলকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অনাহারকে ব্যবহার করার অভিযোগ করেছে।

কয়েক মাস ধরে গাজায় পরিষ্কার পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ ইসরায়েল পানি পরিশোধন এবং লবণাক্তমুক্তকরণ সরঞ্জামের প্রবেশ সীমিত করেছে। ইসরায়েলের দাবি, এই জিনিসগুলো অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

জানা সিএনএনকে বলেছেন, “আপনার জন্য একটা বালতি ভরাই মুশকিল হবে। কারণ সেখানে কোনো সঠিক লাইনিং ব্যবস্থা নেই এবং অপেক্ষার পর আপনি কিছু নাও পেতে পারেন। কখনও কখনও আমাদের পানি ছাড়াই চলে যেতে হয়।। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা সেখানে বসে থাকি কেবল একটি বালতি ভরার জন্য। এটি একটি ভয়াবহ অনুভূতি।”

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অপুষ্টির প্রভাবে কমপক্ষে ৫৭ জন শিশু মারা গেছে। এদের মধ্যে জানার ভাইয়ের মেয়ে জানাতও ছিল।

জন্মের সময় জানাতের ওজন ছিল মাত্র ২ দশমিক ৬ কিলোগ্রাম।

তার মা আয়া সিএনএনকে জানান, শিশুটি বেড়ে উঠছিল এবং ওজনও বাড়িয়েছিল। কিন্তু জানাতের বয়স যখন ছয় সপ্তাহ তখন পরিস্থিতি বদলে যায়।

২ মার্চ ইসরায়েল গাজার উপর সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে, এমনকি শিশুর ফর্মুলা দুধ এবং ওষুধসহ সবচেয়ে মৌলিক সরবরাহও গাজায় প্রবেশে বাধা দেয়।

আয়া জানান, তিনি জানাতকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য সংগ্রাম করছিলেন। শিশুটির দীর্ঘমেয়াদী ডায়রিয়া হয়, পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং শিগগিরই তার অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

তিনি বলেন, “(হাসপাতালে) তারা বলেছিল, একটি বিশেষ চিকিৎসা দুধ আছে যা তার ওজন বাড়াতে এবং ডায়রিয়া বন্ধ করতে সাহায্য করবে- কিন্তু আমরা তা খুঁজে পাইনি। আমরা গাজাজুড়ে, হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল, ফার্মেসি থেকে ফার্মেসি পর্যন্ত অনুসন্ধান করেছি। এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও আমাদের বলেছে যে এটি পাওয়া যাচ্ছে না।”

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তোলা সিএনএন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ছোট্ট শিশুটিকে আয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। তার ছোট্ট মুখমণ্ডলের হাড়গুলো চামড়ার নিচে, এবং তাকে চার মাস বয়সী শিশুর চেয়ে নবজাতকের মতোই বেশি দেখাচ্ছে। তার পাতলা, লম্বা আঙ্গুলগুলো কম্বল থেকে বেরিয়ে আসছে, এবং তাকে ঘুমন্ত দেখাচ্ছে। তার বড় বাদামী চোখই তার ক্লান্ত শরীরের একমাত্র অংশ যা নড়াচড়া করতে সক্ষম বলে মনে হচ্ছে, তার দৃষ্টি তার চারপাশে ঘোরাফেরা করার সময় লোকেদের অনুসরণ করে।

খাবার ও পরিষ্কার পানির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়া জানাতের মাও বাঁচার জন্য লড়াই করছিলেন। এই পরিস্থিতিতে গাজার অনেক নতুন মায়ের মতো তারও বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। এর ফলে তিনি তার শিশুকে খাওয়াতে পারছিলেন না।

জানাতের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। শিশুটিকে তার শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে লড়াই করতে হচ্ছিল। ডাক্তাররা বলেছিলেন যে তার রক্তে শর্করার মাত্রা বিপজ্জনকভাবে কম ছিল। তার অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছিল। অপুষ্টির কারণে তার কিডনি ও লিভার অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং ফলস্বরূপ তার রক্ত ​​অ্যাসিডিক হয়ে যায়।

জানাতের মা বলেন, “আমি সারা বিশ্বের কাছে তাকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। আমি কেবল চেয়েছিলাম কেউ তাকে বাঁচাক, তার প্রয়োজনীয় দুধ সরবরাহ করুক। কিন্তু কেউ সাহায্য করতে পারেনি। সবাই কেবল দেখছিল।”

ঢাকা/শাহেদ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়