ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘প্রতি কেজি আলু থেকে ১৫টি পলিথিন ব্যাগ হবে’

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ২১ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘প্রতি কেজি আলু থেকে ১৫টি পলিথিন ব্যাগ হবে’

মাহবুব সুমন

পরিবেশ নিয়ে আমরা অনেকেই ভাবি। কিন্তু এ বিষয়ে উদ্ভাবনী চিন্তা এবং সেই চিন্তার সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে সবাই পারেন না। মাহবুব সুমন পেরেছেন। সম্প্রতি তিনি আলু থেকে দেশীয় পদ্ধতিতে আবিষ্কার করেছেন পলিথিন। যেটি পরিবেশবান্ধব। এর আগেও কাগজ থেকে গাছের চারা উৎপাদন করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। মাহবুব সুমনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদ সাদেক।

রাইজিংবিডি: আপনাকে অভিনন্দন। প্রথমেই জানতে চাই- আলু থেকে আবিষ্কৃত পলিথিনের নাম ‘পলকা’ কেন?

মাহবুব সুমন: পলকা বাংলা শব্দ। এর অর্থ পাতলা। আমাদের সব আবিষ্কারের নাম বাংলায় দেয়া। আমরা চেষ্টা করছি, আমাদের সব আবিষ্কারের নাম বাংলায় রাখার। 

রাইজিংবিডি: আলু থেকে পলিথিন তৈরির ধারণা কীভাবে পেলেন?

মাহবুব সুমন: প্রথম ধারণা পাই ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে। মুন্সিগঞ্জ এলাকায় আলুর অনেক কোল্ড স্টোরেজ আছে। কোল্ড স্টোরেজে সৌর বিদ্যুতের প্রস্তাব দিতে গিয়ে জানতে পারি তারা ভীষণ আর্থিক ক্ষতিতে আছেন। নতুন করে বিনিয়োগের সক্ষমতা নেই। আগে একচেটিয়া ব্যবসা করতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেশের উত্তরাঞ্চলে আলুর চাষ বাড়ায় ঢাকাসহ আশেপাশের আলু চাষী ও কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসায়ী উভয়েই আছেন মারাত্মক আর্থিক ক্ষতিতে। একজন কোল্ড স্টোরেজ মালিক জানালেন, গত দুই বছরেই তার ৩ থেকে ৮ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এরকম সময়ে আমার মনে হয়েছিল, যদি আমরা এই ব্যবসায়ীদের আলু থেকে কোনো সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি প্রোডাক্ট ডেভলপ করে দিতে পারি তাহলে আলু চাষী, ব্যবসায়ীরা বেঁচে যাবে। আর প্রযুক্তিসহ পণ্যটি যদি পরিবেশবান্ধব হয় তাহলে পরিবেশের দূষণ কমে বরং উপকার হবে। মাঝখান থেকে প্রচুর নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবার সম্ভাবনা তো থেকেই গেল। এভাবেই মূলত পলকার চিন্তা মাথায় আসে।

রাইজিংবিডি: আলু থেকে পলিথিনের ধারণার পেলেন কীভাবে?

মাহবুব সুমন: আমার এক জার্মান এনার্জি স্পেশালিস্ট বন্ধু প্রক্রিয়াটা আমাকে শিখিয়েছেন। তার নাম ইয়ান স্মিউট। তার সাহায্য নিয়ে একদম স্থানীয় যন্ত্রপাতি ও কমন সেন্স ব্যবহার করে আমরা এই পলিথিন বানিয়েছি। কোন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক এর মধ্যে নেই।

রাইজিংবিডি: পলকা সম্পর্কে বলুন?

মাহবুব সুমন: পলকা হলো আলু থেকে তৈরি পলিথিন। এক্সপেরিমেন্টাল শিট তৈরি করেছি ব্যাগ বানানোর জন্য। কিছু ব্যাগ আগেই বানিয়ে ভর ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রায় ৫ কেজি পর্যন্ত ভার অনায়াসে বহন করতে পারে। শীঘ্রই আরো বেশীসংখ্যক ব্যাগ নিয়ে আসছি বাণিজ্যিকভাবে। সবাই ঘরে ঘরে এই ব্যাগ বানালে দেশজুড়ে পলিথিন, প্লাস্টিকের দূষণ অনেক কমে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

রাইজিংবিডি: পলকা বাসায় কি নিজে বানানো সম্ভব?

মাহবুব সুমন: হ্যাঁ, সম্ভব।

রাইজিংবিডি: বাসায় কীভাবে বানাবো?

মাহবুব সুমন: পলকা কি জিনিস বুঝতে হলে, জানতে হবে প্লাস্টিক কী? অণুবীক্ষণ যন্ত্রে প্লাস্টিককে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে তাতে হাইড্রো কার্বনের খুব ছোট ছোট কণা বা মনোমার পরপর সজ্জিত হয়ে দীর্ঘ শেকলের পলিমার তৈরি করেছে। এরকম অনেক পলিমার একত্র হয়ে প্লাস্টিক তৈরি করে। পলকা বানানোর জন্য লাগবে আলুর স্টার্চ, পানি, হোয়াইট ভিনেগার, গ্লিসারিন। বাজার থেকে গোল আলু কিনে ভালো করে ধুয়ে ছিলে নিতে হবে। তারপর ছিলা আলু কুচিকুচি করে কেটে বা গ্রিটারে গ্রিট করে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে ১০ মিনিট। তারপর হাত দিয়ে চেপে বা অন্য যেকোন উপায়ে চেপে ভেতরের সমস্ত নির্যাস বের করে নিতে হবে। শেষে সেই পানিটা কোন পরিষ্কার পাত্রে রেখে দিলে তলায় স্টার্চ জমে যাবে। এই স্টার্চগুলো লালচে ময়লাযুক্ত। একে কয়েকবার পাতন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিলে ধবধবে সাদা পরিষ্কার স্টার্চ পাওয়া যাবে। প্রতি ১০ কেজি আলু থেকে ১৩শ গ্রাম স্টার্চ তৈরি করা যাবে। তৈরি হওয়া স্টার্চ জটলা পাকানো গাদা গাদা পলিমারের একটা দঙ্গল। এই দঙ্গলের সাথে পানি মেশালে তা মোটামুটি লাইনে চলে আসে। লংচেইন পলিমার যেমন হয় সেরকম হয় দেখতে। কিন্তু অনুবীক্ষণিক লেভেলে এতেও প্রচুর শাখা প্রশাখা থেকে যায়। এই শাখা প্রশাখা ছেটে ফেলে একে একটা সিঙ্গেল লং চেইন পলিমারে রূপান্তরের জন্য আমরা এতে প্রয়োগ করবো ভিনেগার। এই অবস্থায় ‘পলকা’ বানালে প্লাস্টিকের মত একটা কিছু হবে কিন্তু তা হবে খুবই শক্ত ও ভঙ্গুর। ভঙ্গুর প্রবনতা কমানো ও জিনিসটাকে নরম বা ফ্লেক্সিবল করার জন‌্য গ্লিসারিন প্রয়োগ করতে হয়। গ্লিসারিনের অণুগুলো লং চেইন পলিমারের ফাঁকে ঢুকে একে নরম করে। এই নরম পলকাকে কোন ফ্ল্যাট সারফেসে লেপ্টে দিলেই পেয়ে যাব কাঙ্ক্ষিত পলকা শিট। শিট থেকে পরে আমরা ব্যাগ বা পেপার বানাতে পারব সহজেই।

রাইজিংবিডি: পলকা তৈরির ব্যবহারিক বিষয়টি কেমন?

মাহবুব সুমন: পলকা তৈরির জন্য একটা পাত্রে ১০ গ্রাম স্টার্চ, ৫ মিলি ভিনেগার, ৫ মিলি গ্লিসারিন, ৬০ মিলি পানি ভালো করে মিশিয়ে গরম করতে হবে। কিছুক্ষণ গরম করলে এটি ঘন থিকথিকে হয়ে উঠবে। গরম অবস্থাতেই একে ফ্ল্যাট সারফেসে লেপে দিয়ে ওভেন বা ড্রায়ারে ৬৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১ ঘণ্টা শুকাতে হবে। শুকানোর পর হাতে নিয়ে দেখবেন পলকা তৈরি হয়ে গেছে। এখন তো বানানো শিখে গেলেন। সবাই মিলে পলকা বানান। পরিবেশ বাঁচান। পরিবেশ বাঁচলে আমরা সবাই ভালো থাকবো।

রাইজিংবিডি: খরচ ও দাম কেমন হবে?

মাহবুব সুমন: প্রতি কেজি আলু থেকে ১৫টা পলিথিনের ব্যাগ হবে। লেবার, ইলেকট্রিসিটি সব খরচ মিলে আমরা দেখেছি একটি পলিথিনের মূল্য ৩ টাকা করে পড়ে। আবার উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে আসবে। এটি ৩০ দিনের মধ্যে মাটিতে মিশে যাবে। এখন পর্যন্ত যা তৈরি করেছি তাতে গতানুগতিক সাইজের ব্যাগের ধারণ ক্ষমতা ৫ থেকে ৬ কেজি।

রাইজিংবিডি: এতে আলু সংকট তৈরি হবে কিনা?

মাহবুব সুমন: আলু থেকে পলিথিন ব্যাগ বানালে খাদ্য সংকট হবার আশঙ্কা নেই। কারণ দেশে যে আলুর উৎপাদন হয় তার শতকরা ৫ ভাগ দিয়েও যদি ব্যাগ বানানো হয় তাও লক্ষ লক্ষ। যখন আলুর দাম না পেয়ে কৃষক হতাশ হয়ে নদীতে আলু ফেলে দিচ্ছে তখন কিন্তু কৃষককে বাঁচাতে আমরা সবাই ভাতের বদলে আলু খাই না। আবার ব্যাগ বানালে আলু নষ্টও হয়ে যায় না। শুধু স্টার্চটা বের করে নেয়া হয়। আলুতে তারপরও প্রোটিন, ফাইবার থেকে যাচ্ছে। স্টার্চ বের করার পর বাকি আলু রান্না করে, ভাজি করে বা ময়দা বানিয়ে স্টোর করে খাওয়া যাবে।

রাইজিংবিডি: অনেকে বলছেন এটা নতুন কোন আবিষ্কার বা প্রযুক্তি নয়- আপনি কী বলবেন?

মাহবুব সুমন: প্রথমত, আমরা একটা আমদানি নির্ভর অনুন্নত দেশের মানুষ। আগামী ৫০ বছরেও আমরা যা কিছু বানাবো তা আপনারা গুগলে, ইউটিউবে বা দুনিয়ার কোন না কোন কোণায়, কোন এক প্রান্তে বা কোথাও না কোথাও দেখতে পাবেন। কারণ প্রযুক্তি নিয়ে আমরা কাজ করি না। বানাই না। আমরা প্রযুক্তি কিনে আনি। পশ্চিমা দেশ যেহেতু আমাদের চেয়ে উন্নত সেহেতু আমরা যা কিছুই বানাই না কেন, তারা সেটা আগেই করে বসে থাকে- এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে আমরা কী কাজ করবো না? দেশে কেউ কিছু করলেই পশ্চিমা দেশের উদাহরণ টেনে এনে দেশের লোকজনকে হেয় করার প্রবণতা উপনিবেশিক মাইন্ড সেট আপ থেকে আসে। মুক্ত স্বাধীনভাবে চিন্তা করা বা কাজ করার চর্চা করি না বলেই আমরা দাসত্বের মনস্তাত্ত্বিক গঠন থেকে বের হতে পারি না। এটা বাদ দিলে আমরা অনেক ভালো ভালো কাজ দেশেই করতে পারব। দ্বিতীয়ত, আমি বলব- আপনারা সবাই কাজ করেন। যদি ইউটিউবে, গুগলে, বিদেশে ঘুরতে গিয়ে ভালো কিছু দেখে আসেন তাহলে সেটা দেশের মানুষের হাতে কীভাবে পৌঁছে দেয়া যায় সেই চেষ্টা সবার করা উচিৎ।

রাইজিংবিডি: আপনার আরো কী কী আবিষ্কারের ইচ্ছে আছে?

মাহবুব সুমন: চারটা ইচ্ছে পূরণ হলে মরেও শান্তি পেতাম। এর মধ্যে ১ টাকায় পলকা ব্যাগ বাংলাদেশের মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়া। পাহাড় আর সমতলে পানিশূন‌্য কিছু জায়গা আছে। কিছু জায়গার পানি লোনা। সেই এলাকার জন্য কমপক্ষে খাবার পানির ব্যবস্থা করা। প্লাস্টিক প্রোডাক্টের অল্টারনেটিভ বানানো এবং বিদ্যুতের জন্য একটা নতুন রিনিউয়েবল ও পরিবেশবান্ধব এনার্জি সোর্স ডেভলপ করা।

কিন্তু আমি যে কথাটি বলতে চাই, বাংলাদেশে নাই, বিদেশে আছে বলে আমরা কি আমাদের প্রয়োজনীয়  জিনিসগুলা বানাবো না? আপনারাই বলেন, আমরা কি সারাজীবন আমদানী নির্ভর জাতি হয়েই থাকবো? এজন্য যেখানে যাই থাক না থাক, আমাদের দেশের দরকারে আমরা কাজ করতেই থাকবো। আহ্বান জানাই আপনারাও করেন। আলুর পলিথিন খুব বেশী পুরাতন কোন কিছু না। আগে ছিল কর্ন, কাসাভা থেকে ২০১৮ সালে জার্মানি বানিয়েছে। আমাদের দেশে আলু প্রচুর, সেজন্য আমরাও ট্রাই করি। একজনের হাত দিয়ে বা একটা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এদেশ বদলাবে না। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশটা উন্নত হবে। দরকার মানসিকতা বদলানো আর দরকারী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়