ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ই-অরেঞ্জ প্রতারণা মামলা: গ্রাহকদের পাওনা অনিশ্চিত

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৯, ১৮ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৭:৫৩, ১৮ আগস্ট ২০২১
ই-অরেঞ্জ প্রতারণা মামলা: গ্রাহকদের পাওনা অনিশ্চিত

চাহিদা মতো পণ্যের জন্য নগদ টাকা পরিশোধের পরেও মাসের পর মাস পণ্য না পাওয়ায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক গ্রাহক। 

আরও পড়ুন: ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা

মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) সকালে গুলশান থানায় মামলাটি হয়। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান।

তিনি বলেন, গ্রাহক মো. তাহেরুল ইসলাম বাদী হয়ে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে সোমবার (১৬ আগস্ট) রাতে অভিযোগ দায়েরের পর মঙ্গলবার সকালে এটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করে। বাদীর সঙ্গে প্রতারণার শিকার আরও ৩৭ জন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। 

মামলার এজাহারে তাদের স্বাক্ষরও রয়েছে। মামলায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের মোট ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার বিবাদীরা হলেন মাসুকুর রহমান, আমানউল্ল্যাহ, বিথী আক্তার, কাউসার আহমেদ, সোনিয়া মেহজাবিনসহ ই-অরেঞ্জের মালিকরা। মামলার এজাহারে এদের প্রত্যেককেই ই-অরেঞ্জের মালিক বলে দাবি করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম।

মামলার এজাহারে বাদী তাহেরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, গত ২১ এপ্রিল পণ্য কেনার জন্য ই-অরেঞ্জে অগ্রিম টাকা দেন। ই-অরেঞ্জ নির্ধারিত তারিখে পণ্য সরবরাহ করেনি, টাকাও ফেরত দেয়নি। নিজেদের ফেসবুক পেজে বারবার নোটিশ দিয়েছে, সময় চেয়েছে। কিন্তু পণ্য ও টাকা দেয়নি। সর্বশেষ তারা ১৬ আগস্ট গুলশান-১ এর ১৩৬/১৩৭ নম্বর রোডের ৫/এ নম্বর ভবনে অবস্থিত অফিস থেকে পণ্য ডেলিভারির কথা বললেও তারা তা করেনি। পণ্য ডেলিভারি না করে  প্রতিষ্ঠানটি এক লাখ ভুক্তভোগীর প্রায় ১১০০ কোটি টাকা প্রতারণামূলকভাবে আত্মসাৎ করেছে।

প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় জামিন নিতে গেলে ই-অরেঞ্জের মালিকদের মধ্যে দুজন সোনিয়া মেহজাবিন এবং তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম আবু বক্কর সিদ্দিকের আদালতে তারা আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা সর্বশেষ অর্ডারগুলোর পণ্য দ্রুত ডেলিভারি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ই-অরেঞ্জ গ্রাহকদের আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে এ দাবি ও অনুরোধ জানানো হয়। 

আরও পড়ুন: ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া ও তার স্বামী কারাগারে

মানববন্ধন থেকে গ্রাহকরা বলেন, ই-অরেঞ্জ শেষ কয়েকবার আমাদের বাইক ডেলিভারির সময় দিয়েও দেয়নি। বর্তমানে তাদের অফিস বন্ধ, কাস্টমার কেয়ার বন্ধ। তাদের সিইও বলছে, কোম্পানি বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউ আমাদের সামনে আসছেন না। তারা দেশে আছেন কিনা, তাও জানা নেই। গত ১৭ আগস্ট থেকে তাদের ডেলিভারি করার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন বেলা ১১টায় জানায়, তারা সাধারণ ডেলিভারি ১৯ আগস্ট থেকে করবে আর বাইক ডেলিভারির জন্য আরও ৪৫ দিন সময় নেবে। যেখানে তাদের ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেওয়ার কথা, সেখানে ইতোমধ্যে চার মাস হয়ে গেছে। সেখানে তারা আরও সময় চাচ্ছে।

তারা আরও বলেন, মাশরাফি যেদিন থেকে এ প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে এসেছেন, তখন থেকে প্রতিষ্ঠানটির অর্ডার ১০ গুণ বেড়ে গেছে। এখন তিনি (মাশরাফি) বলছেন, তার সঙ্গে চুক্তি জুলাই মাসে শেষ হয়েছে। কিন্তু উনি চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর মে মাসে থেকে এখন পর্যন্ত বাইকগুলোর ডেলিভারিও তো হয়নি। তাহলে ওই দায়টুকু তো মাশরাফিরও থাকছে। আমরা চাই মাশরাফি ভাইয়ের সহায়তায় আমাদের ডেলিভারিগুলো দ্রুত দেওয়া হোক।

এদিকে, ই-অরেঞ্জের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা থাকার কারণে গ্রাহকদের একটা অংশ মাশরাফির মিরপুরের বাসার সামনে অবস্থান করলে, মাশরাফি তাদের সঙ্গে দেখা করে, ই-অরেঞ্জের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় গ্রাহকদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দেন জাতীয় দলের সাবেক সফল এই অধিনায়ক। 

তিনি বলেন, ‘ই-অরেঞ্জের সঙ্গে আমার ছয় মাসের চুক্তি ছিল। সেটা শেষ হয়েছে। আমি এখন এটির সঙ্গে নেই। তবুও একজন গ্রাহক যেখান থেকে বলছে, তাদের পাশেই আমাকে থাকতে হবে। এটার তো আইনগত জায়গায় খুব বেশি কিছু করার নেই। তবুও সাধারণ মানুষের কারণে কথা বলেছি। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তাদের পাশে দাঁড়াবো।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘দুপুর থেকে আমি চেষ্টা করছি। মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি আমাকে বলেছে উনাদের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। ১৯ আগস্ট থেকে ডেলেভারি দেওয়া শুরু করবে। এরপর তো আর বেশি কিছু বলার থাকে না।’

১৬ আগস্ট বিকেলে গুলশান-১ এর সড়ক অবরোধ করেন ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা। সেখানে তারা স্লোগান দিয়ে মিছিল করছেন। এ সময় সড়কে যানচলাচলে বিঘ্ন ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করে গুলশান থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম বলেন, ৪০ জন গ্রাহক মোটরসাইকেল নিয়ে গুলশান-২ মোড়ে আসেন। পরে তারা সেখান থেকে তারা গুলশান-১ এর দিকে চলে যান।

সোহান নামের এক গ্রাহক জানান, আমরা ই-অরেঞ্জ নামের ই-কমার্স সাইট থেকে বাইক, মোবাইলসহ নানা পণ্য অর্ডার করেছিলাম। সরকারের ই-কমার্স নীতিমালা প্রকাশের আগে ই-অরেঞ্জের ডাবল টাকা ভাউচার কিনেছিলাম। কর্তৃপক্ষ গত ১৬ মে থেকে সব ডেলিভারি বন্ধ রেখেছে। ১৮ জুলাই ই-অরেঞ্জ একটি ডেলিভারি ডেট প্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে লকডাউনের দোহাই দিয়ে ডেলিভারি বন্ধ করে দেয়। পরে জানায় লকডাউন শেষ হলে ডেলিভারি কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে। লকডাউন শেষ হওয়ার আগের দিন ১০ আগস্ট তারা আবার নতুন করে ১৬ আগস্ট ডেলিভারির তারিখ প্রকাশ করে।

তিনি বলেন, ১৬ আগস্ট ই-অরেঞ্জ তাদের অফিসিয়াল পেজে জানায়, পূর্বের বাইক সেলারের সঙ্গে তারা চুক্তি বাতিল করেছে। নতুন সেলার পেতে বা নিজেরা বাইক ইমপোর্ট করতে ৪৫-৬০ কর্মদিবস লাগবে। তাই যারা বাইক নিতে চান, তাদের অপেক্ষা করতে হবে অথবা রিফান্ড রিকুয়েস্ট করতে হবে। বেশ কয়েকজন গ্রাহক রিফান্ড চেয়ে ফোন করায় তারা ২১ কর্মদিবসের কথা বলে। তখন সরকার নির্ধারিত ১০ দিনের কথা বলায় তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তাই আমরা গ্রাহকরা সড়কে অবস্থান নিয়েছি।

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম গত বছরের অক্টোবরে এক বন্ধুর পরামর্শে ই-অরেঞ্জে বিনিয়োগ করা শুরু করেন। শুরুতে ই-অরেঞ্জের বিভিন্ন ভাউচার অফারের মাধ্যমে কয়েকটি স্মার্টফোন অর্ডার করেন জাহিদ। অর্ডারের এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ফোনগুলোর ডেলিভারিও পেয়ে যান তিনি। ওই ফোনগুলো বিক্রি করে তার বেশ লাভও হয়। 

এরপর আবারও কয়েক দফায় ই-অরেঞ্জের ভাউচার কেনেন জাহিদ। সময়মতো ডেলিভারি পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তার বিশ্বাস বেড়ে যায়। এই বছরের জুনে ই-অরেঞ্জের 'সামার ডাবল অফার'-এর মাধ্যমে সারা জীবনের জমানো প্রায় ২০ লাখ টাকার ভাউচার কেনেন তিনি। এই ২০ লাখ টাকার ভাউচারে বেশকিছু মোটরসাইকেল কেনার ইচ্ছা ছিল তার।

এবার ভাউচার কেনার পরই ঘটে বিপত্তি। ই-অরেঞ্জ তাদের কার্যালয় ও সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এখন গ্রাহকদের না দিচ্ছে পণ্য, না দিতে পারছে টাকা রিফান্ড। এতে অনেকটা পথে বসে গেছেন জাহিদের মতো হাজারো গ্রাহক।

বাধ্য হয়েই অন্য গ্রাহকদের সঙ্গে রাস্তায় আন্দোলনে নামেন জাহিদ। তিনি বলেন, 'শুরুর দিকে কয়েক দফা ডেলিভারি পেয়ে ই-অরেঞ্জের প্রতি বিশ্বাস বাড়ে। মাশরাফি কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ায় বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। নিজের জমানো ১৬ লাখ টাকা এবং স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে আরও প্রায় ৪ লাখসহ মোট ২০ লাখ টাকায় সামার অফারের ভাউচার কিনি। ভাউচার অনুযায়ী ই-অরেঞ্জের মোটরসাইকেল ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। আর মোটরসাইকেল না দিতে পারলে লভ্যাংশসহ মূল টাকা রিফান্ড করার কথা ছিল। কিন্তু ভাউচারের টাকা দেওয়ার পর এখন তাদের কথা-কাজে মিল পাচ্ছিলাম না। আজ, কাল পরশু বলে কেবল ঘোরাচ্ছে।'

জাহিদ বলেন, সর্বশেষ ই-অরেঞ্জ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লকডাউন শেষে ১১ আগস্ট তাদের অফিস খুলবে। এর পরে আবার বলে ১৬ আগস্ট খুলবে। আজ না খুলে বলছে ১৯ আগস্ট খুলবে। এখন শুনছি কোম্পানি নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানের মালিক নাকি বিদেশে চলে যাবেন। তাই আমরা সড়কে নেমেছি।

ভাউচার কেনার এক মাসের মধ্যে পণ্য অথবা মূল টাকাসহ লভ্যাংশ পাওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিলাম, এখান থেকে পণ্য কিনে ব্যবসা করে লাভবান হবো।  তা না হয়ে তো উল্টো পথে বসে যেতে হচ্ছে। তারা যদি আমার টাকা না দেয়, তাহলে আমি শেষ হয়ে যাব।'

আন্দোলনকারী আরও কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ই-অরেঞ্জের কাছে সহস্রাধিক গ্রাহকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা আটকে আছে। তারা দিনের পর দিন গ্রাহকদের ঘুরিয়ে এখন এ অর্থ আত্মসাতের পাঁয়তারা করছে। তারা তাদের বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

ঢাকা/মেয়া/এমএম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়