ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ফিরে দেখা ২০২১: করোনায় ব্যস্ত প্রশাসন, ছিলো দুর্নীতি-অনিয়ম

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ০৮:৫৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১
ফিরে দেখা ২০২১: করোনায় ব্যস্ত প্রশাসন, ছিলো দুর্নীতি-অনিয়ম

আজই (৩১ ডিসেম্বর) বিদায় নেবে আলোচিত ২০২১ সাল। এই এক বছরে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে দিনরাত ব্যস্ত ছিল দেশের মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন। মহামারিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ডিসি-ইউএনওসহ প্রশাসন ক্যাডারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে গেছেন। এসময় স্থানীয় প্রশাসনের অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন অনেকেই। তবুও থেমে নেই তাদের কর্মযজ্ঞ। করোনার পাশাপাশি এখন নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ঠেকাতেও প্রস্তুত।

পড়ুন: ফিরে দেখা ২০২১: কূটনীতিতে এসেছে সাফল্য

করোনারোধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে রাতদিন পরিশ্রম করছেন তারা। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, স্থানীয় নির্বাচনে সহযোগিতাসহ নানা বিষয় তো আছেই। আর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শতভাগ জনবান্ধব জনপ্রশাসন গড়তে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। এক বছরে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্যার নয়, জনগণের সেবক এই মানসিকতা নিয়ে যাতে কাজ করেন সেজন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরপরও ইউএনও, এসিল্যান্ডদের বিরুদ্ধে এই এক বছরে সেবাগ্রহীতা জনগণের সঙ্গে অসদাচরণের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের বদলি করে জনহিতকর কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া, দুর্নীতিবাজ ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের ভালো জায়গায় পদায়ন, দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে লঘুদণ্ড দেওয়াসহ জনপ্রশাসনে অস্বাভাবিক পদোন্নতির অভিযোগ আছে।

ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স ঘোষণা থাকলেও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে থেমে নেই ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম। সেই সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নারী কেলেঙ্কারিসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এই বছর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের বিষয়টিও ছিল আলোচিত। স্থানীয় প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, এমনকি মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে তাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় শেষ পর্যন্ত সরকারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য তথা আনসার নিয়োগ দিতে হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ বছর অসহায় দরিদ্রদের জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ উঠে। সমালোচনার ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে। এ প্রকল্প নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি-অনিয়ম বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

অনিয়মে জড়িত বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যে শাস্তির আওতায় আনা হলেও অনেকে এখনও অধরা রয়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিসি, ইউএনও এসিল্যান্ডদের নানান বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। বিভাগীয় মামলা, লঘু শাস্তিতেও যেন থামানো যাচ্ছে না কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বরং প্রশাসন ক্যাডারের মাঠ পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে বিদায়ী জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুনের সাহসী বক্তব্য প্রশাসনজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অতীতে কোন জনপ্রশাসন সচিব এরকম সত্য উচ্চারণ করেননি। বরং তার সাহসী বক্তব্যে মাঠ পর্যায়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠেছে।

পড়ুন: শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাঙ্গনের চ্যালেঞ্জের বছর ছিল ২০২১

সাংবাদিক নিপীড়নের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনের দণ্ড মওকুফের ঘটনা, প্রশাসনে ঢালাও পদোন্নতি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার নির্দেশনা, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সে ছাড় দেওয়াসহ ভালো-মন্দ মিলিয়ে কেটে গেছে এই একটি বছর।

বছরের আলোচিত যত কাণ্ড:

জনগণের সঙ্গে অসদাচরণসহ মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল। বিশেষ করে ৮ জুলাই মানিকগঞ্জের সিংগাইরের বল্লা ইউনিয়নের জায়গীর বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলাকালে ‘স্যার না ডেকে আপা’ বলায় স্থানীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসের ওপর ক্ষুব্ধ হন ইউএনও রুনা লায়লা। পরে তার নির্দেশে উক্ত ব্যবসায়ীকে লাঠিপেটা করে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

৪ অক্টোবর কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ইউএনও সাবিনা ইয়াছমিনকে আপা না ডাকায় জামাল উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীকে ‘মা’  ডাকতে বলেন ওই ইউএনও। ভুক্তভোগী জামাল উদ্দিন বিষয়টি ফেসবুকে শেয়ার করলে মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়।

৩০ মে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাশও একই আচরণ করেন। এক সাংবাদিক ‘স্যার না ডেকে ভাই’ সম্বোধন করায় আপত্তি তোলেন তিনি।

গত বছর বিধিনিষেধের মধ্যে গত ২ জুলাই চেম্বারে যাওয়ার পথে ডা. ফরহাদ কবির সাতকানিয়ার ইউএনও নজরুল ইসলামের চেকপোস্টে তল্লাশির মুখে পড়েন। ইউএনও ডা. ফরহাদের পরিচয় জেনেও জরিমানা করায় ভুক্তভোগী চিকিৎসক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে আলোচনার ঝড় ওঠে। পরে ইউএনও নজরুল ইসলামকে ওএসডি করা হয়।

ফুল গাছ খাওয়ার অভিযোগে ১৭ মে বগুড়ার আদমদীঘির ইউএনও সীমা শারমিন একটি ছাগলের মালিককে ২ হাজার টাকা জরিমানা করেন। জরিমানার নয় দিন পর মালিক সাহারা বেগমকে না জানিয়ে সেটি বিক্রি করার অভিযোগ ওঠে। পরদিন ২৭ মে সেই জরিমানার টাকা নিজে পরিশোধ করে ছাগলটি মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেন ইউএনও। পরে ইউএনওকে বদলি করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম:

মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দেশের হতদরিদ্র গৃহহীন ব্যক্তিদের জন্য ঘর প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক এই প্রকল্পে সারা দেশে পৌনে ৯ লাখ গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে ঘর দেওয়ার লক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীনকে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘর নির্মাণে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠে। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে নির্মাণের কারণে উদ্বোধনের আগেই অনেক জায়গায় ঘর ভেঙে যায়, কিছু ঘরে ফাটল দেখা দেয়। ঘর নির্মাণের বেলায় নীতিমালা মানা হয়নি। অনেক ঘরে নির্মাণে ক্রুটি রয়েছে, গুণগত মান ঠিক হয়নি। ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে, পিলার ভেঙে গেছে। দেয়াল ধসে পড়েছে। নিচু এলাকায় ঘর নির্মাণ করায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আবার ভূমির মালিকরাও ঘর বরাদ্দ পেয়েছে- এমন সব ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। অনিয়মে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত হয়। তদন্তে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, বরগুনার আমতলী, বগুড়ার শেরপুর, শাজাহানপুর, হবিগঞ্জের মাধবপুর, সুনামগঞ্জের শাল্লা ও মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলা, বগুড়ার আদমদীঘি, কুমিল্লার দেবীদ্বার, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, মাদারীপুরের কালকিনি, লালমনিরহাট সদর, গাজীপুরের শ্রীপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, জামালপুরের ইসলামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, ময়মনসিংহ সদর, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, ভোলার লালমোহন, পাবনার সাঁথিয়া, মানিকগঞ্জের ঘিওর, নাটোর সদর, কুড়িগ্রামের রৌমারী, বরিশাল সদর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।

পড়ুন: ২০২১ সালে উন্নত দেশের অবকাঠামো তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে

তদন্তে প্রাথমিক পর্যায়ে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জড়িত ইউএনও ও এসিল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী পাঁচ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। কর্মকর্তারা হলেন- বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত আলী সেখ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম, বরগুনা আমতলী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবায়েত হায়াত শিপলু ও একই উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি শেখ মেজবাহ উল সাবেরিন। এদের মধ্যে দু’জনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধেও মামলা প্রক্রিয়াধীন। এ ঘটনায় তদন্ত শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা, আনসার নিয়োগ:

চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর মাসে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর দুর্বৃত্তদের নৃশংস হামলার ঘটনা ঘটেছে। রাতের আঁধারে বাসায় ঢুকে তাকে ও তার বাবা ওমর আলীকে কুপিয়ে জখম করে। মুমূর্ষু অবস্থায় প্রথমে তাকে রংপুর মেডিক্যালের আইসিইউতে, এরপর হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে তার অস্ত্রোপচার করা হয়। দীর্ঘদিন তিনি চিকিৎসা শেষে বর্তমানে সুস্থ আছেন। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়। সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয় এ ঘটনায়। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এ ঘটনার বিচার দাবি করে কড়া বিবৃতি প্রদান করে।

একই বছরে ১৯ আগস্ট বরিশালে পোস্টার-ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সরকারি বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশ-আনসার ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ওসি ও প্যানেল মেয়রসহ সাত জন গুলিবিদ্ধ এবং ২৫ জন আহত হয়। এ ঘটনা কেন্দ্র করে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় মেয়র ও তার কর্মী সমর্থকরা।

দেশের বিভিন্নস্থানে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনায় সরকার তাদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় আনসার নিয়োগ দেয়।

ডিসি সুলতানার লঘু দণ্ড মওকুফ:

মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে সাজা দেওয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনের বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। সেই দণ্ড বাতিল করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।  জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৩ নভেম্বর এই বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বলা হয়, সুলতানা পারভীনের আবেদনের ভিত্তিতে আগের দেওয়া ‘দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা’র দণ্ড বাতিল করে রাষ্ট্রপতি তাকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

একজন সাংবাদিককে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে জনপ্রশাসনের লঘু দণ্ড দেওয়া, পরবর্তী সেই লঘু শাস্তিও মওকুফের ঘটনায় দেশজুড়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠে।

জামালপুরের সেই সাবেক ডিসির শাস্তি:

নারী অফিস সহকারীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় জামালপুরের সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরের বিরুদ্ধে ২৮ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাকে নিম্ন পদে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার বেতন কমিয়ে প্রায় অর্ধেক করা হয় এবং তিনি চাকরি জীবনে কোন পদোন্নতি পাবেন না। তিনি উপসচিবই থাকবেন।

জামালপুরের তৎকালীন ডিসি আহমেদ কবীরের সঙ্গে তার অফিসের এক নারী সহকর্মীর অন্তরঙ্গ অবস্থায় ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ভিডিও প্রকাশের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আহমেদ কবীরের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

দুই স্বাস্থ্য সচিবের বদলি:

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে জুন মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন তোলে। তাকে বদলি করে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব করা হয়।

সচিব আসাদুল ইসলামকে সরিয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নানকে এ পদে আনা হয়েছিল। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতে আবদুল মান্নানকেও বদলি করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিয়াকে। স্বাস্থ্য বিভাগে দুই সচিবের এমন বদলির ঘটনা এই বছরের আলোচিত ঘটনা।

প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে অস্বাভাবিক পদোন্নতি:

জনপ্রশাসন বিভাগে গত এক বছরে অস্বাভাবিক পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ধরণের পদোন্নতিতে উচ্চ পর্যায়ে লোকবল অনেক বেড়ে গেলেও নিচের দিকের পদ ফাঁকা থাকছে। এতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে এবং অ্যাডমিন ক্যাডারের বাইরের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা এতটাই বেশি যে শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের সংখ্যা অনুমোদিত পদের তিন গুণেরও বেশি, যেখানে কয়েক হাজার পদ শুধু কাগজে কলমেই বিদ্যমান।

গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রশাসনের ৯২ জন যুগ্ম সচিবকে একসাথে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদের সংখ্যা ১৩০টি। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা হলো ৫০৮ জনের বেশি। নিয়মিত পদ না থাকায় পদোন্নতিপ্রাপ্ত এসব অতিরিক্ত সচিবদের বেশিরভাগকেই পদোন্নতির আগে যেখানে ছিলেন, সেই কর্মস্থলেই থাকছেন অর্থাৎ ইন-সিটু রাখা হয়েছে। এসব ইন-সিটু কর্মকর্তারা আগের অফিস ও একই দায়িত্ব পালন করলেও পদের দিক থেকে তারা উচ্চপদে আছেন এবং সেই অনুযায়ী বেতনও পাচ্ছেন। এই ধরনের পদোন্নতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে।

শুধু অতিরিক্ত সচিব পদে নয়, গত মার্চ মাসে প্রশাসন ক্যাডারের ৩২২ সিনিয়র সহকারী সচিবকে একসাথে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এভাবে মোট পদের বিপরীতে প্রশাসন ক্যাডারের উচ্চ পর্যায়ে ইন-সিটু পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মোট ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে কেবল প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের পদোন্নতির সুবিধা পেয়ে আসছে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এটিকে বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন-সিটু প্রমোশনের জন্য কোন নির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। এতে তদবির ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ‘পিক অ্যান্ড চয়েজ’র সুযোগ তৈরি করে।

সর্বশেষ সরকারি ‘সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফ ২০২০’ এর পরিসংখ্যান গত ১৫ জুন প্রকাশিত হয়। সেখানে ৩৭০টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৪৯০ জন কর্মকর্তা যুগ্ম-সচিব (গ্রেড-৩) পদে আছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ১৩৫টি পদের বিপরীতে ১৬৫ জন কর্মকর্তা গ্রেড-৪ (সিলেকশন গ্রেড) পদে আছেন। এগুলো যুগ্ম-সচিব ও উপসচিবের (গ্রেড ৫) মাঝামাঝি স্তরে পড়ে।

বরিশালে ইউএনও-মেয়র মুখোমুখি:

বরিশালে ইউএনও-মেয়র দ্বন্দ্বের বিষয়টি ছিল চলতি বছর প্রশাসনের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। গত ১৮ আগস্ট বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ডে শোক দিবসের ব্যানার অপসারণ কেন্দ্র করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে রাতভর সংঘর্ষ হয়। এসময় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে হামলা হয়। এ ঘটনার মামলায় সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে হুকুমের আসামি করা হয়। কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।

তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তার দুর্বৃত্ত বাহিনী সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন এবং সমস্ত জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। অ্যাসোসিয়েশন এমন কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানায় এবং বরিশালের মেয়র যার অত্যাচারে সমগ্র বরিশালবাসী অত্যন্ত অতিষ্ঠ সেই সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর হুকুমেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করে। অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে তার গ্রেপ্তার দাবি করছে এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।’

বিবৃতির পরপরই পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায় রাজনৈতিক দলগুলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলে এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি আলোচনা-সমালোচনা। বিবৃতিকে কেন্দ্র করে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন কর্মকর্তারা মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা হলে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয় অধিকাংশ সচিবই এ বিবৃতির সঙ্গে একমত নন। এ ঘটনায় এ বছর সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেয়ার নির্দেশনা:

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী, পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল করার কথা থাকলেও সেই নির্দেশনা মানছেন না সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ বিষয়ে সরকারের কোন তদারকিও ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে বিধিমালাটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্পদ বিবরণী দাখিল ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির নিয়ম মানতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিবদের কাছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চলতি বছরের ২৪ জুন চিঠি পাঠানো হয়। এ বছর থেকে বিষয়টি মানার কথা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও অনেকেই বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। তাই সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বললে চলে।

করোনায় ব্যস্ত প্রশাসন, কর্মকর্তাদের মৃত্যু:

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ফের উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় চলতি বছরের ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা পর্যন্ত লকডাউন (বিধিনিষেধ) দেওয়া হয়। তবে গণপরিবহন, মার্কেট খোলা রাখায়, সেটা ছিল অনেকটাই অকার্যকর। পরে ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে আট দিনের কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হলে কয়েক দফায় শিথিলতাও আনা হয়। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের মাধ্যমে করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যকর্মীদের পর প্রশাসনই ছিল অগ্রগামী। মাঠে কাজ করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণও করেন তাদের অনেকেই। আক্রান্ত হয়েছেন সহস্রাধিক। কাজ করতে গিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের অসংখ্য কর্মকর্তার আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুর খবর এ বছরের আলোচিত বিষয় ছিল।

করোনা আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৬ এপ্রিল মারা যান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই প্রথম করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার এক বছর পর ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান একই ব্যাচের কর্মকর্তা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল খায়ের মো. মারুফ হাসান।

কর্মরত থাকা অবস্থায় করোনায় মারা যান প্রতিরক্ষা সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী, বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) ফখরুল কবীর, পরিকল্পনা কমিশনের যুগ্ম প্রধান লুৎফর রহমান তরফদার, তথ্য কমিশনের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম খান, যুগ্ম সচিব খন্দকার অলিউর রহমান, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লিয়াকত আলী, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এ কে এম মোয়াজ্জেম হোসেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহম্মদ এবং যুগ্ম সচিব শামস ই আরা বিনতে হুদা।

উপসচিব আবুল খায়ের মো. মারুফ হাসান ছাড়াও পিআরএল অবস্থায় মারা যান অতিরিক্ত সচিব তৌফিকুল আলম, অতিরিক্ত সচিব নূর হোসেন তালুকদার ও যুগ্ম সচিব খুরশীদ আলম। অবসরে থাকা অবস্থায় করোনায় মারা যান সাবেক সচিব বজলুল করিম চৌধুরী, সাবেক যুগ্ম সচিব সামছুল কিবরিয়া চৌধুরী, আ. রশিদ, মোহাম্মদ আলী (১৯৭০ ব্যাচ), ইসহাক ভূঁইয়া (১৯৭৩ ব্যাচ), সরওয়ারী আলম (১৯৭০ ব্যাচ), ওয়াজেদ আলী খান (৮১ ব্যাচ) এবং তপন কুমার সরকার (৮৫ ব্যাচ)।

তাছাড়া গত আগস্টে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সাবেক সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক, ২১ জুলাই আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব নরেন দাস।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়