ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা: গুচ্ছ না সমন্বিত?

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা: গুচ্ছ না সমন্বিত?

২০১৮ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বৈঠককালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা চালু করার তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে ঐ বছর তা করা হয়নি। জানা যায়  এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসিকে কাজের অগ্রগতি জানতে কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু  তার অগ্রগতি কিংবা আগ্রহ কোনো কিছুই জানা যায়নি।

২০০৮ সালে প্রথম  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৯ সালে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি বিভাগে মেধা ও পছন্দক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার কথা। ভর্তিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী কোন কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা দেবেন, তাও তাদের পছন্দের ভিত্তিতে ঠিক করা হয়েছিল।

২০২০ সাল থেকে নাকি পুরো দেশেই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় গুচ্ছ না হয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। স্বায়ত্বশাসন খর্বের দোহাই দিয়ে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নিয়েছে এবারও। ২০১৯ সালে  শুধু কৃষি ও কৃষির প্রাধান্য থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে একটিমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। ইউজিসির এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, প্রতি বছর ভর্তির মৌসুমে  একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়া, ভর্তি কোচিংসহ আনুষঙ্গিক খাতে একজন শিক্ষার্থীর গড়ে ৯৬ হাজার টাকা খরচ হয়। অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর পক্ষে এই অর্থের যোগান সম্ভব হয় না। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা না হলেও গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য খুবই প্রয়োজন। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া ভীষণ কষ্টকর। তারা কোথায় থাকবে, কী খাবে, কী হবে তাদের নিরাপত্তা? নারী শিক্ষার্থীরা তো এখনও দেশের এক জায়গা থেকে আরেক  জায়গায় যেতে পারে না নিরাপত্তার কারণে। তাদের সাথে থাকেন বাবা-মা, না হয় বড় ভাই বা বড় বোন কিংবা কোন নিকটাত্মীয়। তাদের সকলের জন্যই দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া কষ্টকর। অর্থনৈতিক ও শারীরিকভাবেও ক্ষতিকর। শিক্ষামন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, ‘ছেলেরা অনেক সময় মসজিদে ঘুমিয়ে থেকে পরীক্ষা দেয়। কিন্তু মেয়েরা কোথায় গিয়ে থাকবে? মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা সমন্বিত করতে পারলে অন্যরা কেন পারবে না ‘

জানা যায়, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে গেলে স্বায়ত্বশাসন ক্ষুণ্ন হওয়ার যে কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলে আসছে সেটি মানতে নারাজ বেশ কিছু শিক্ষক। এখানে আসলে আর্থিক বিষয়টিই মুখ্য। বিষয়টি যদি তাই হয়ে থাকে তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য জাতির বিবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককুল ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর ব্যবস্থা করবেন এটি মেনে নেয়া যায় না। দেশের পরিবহন ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা, নারীর নিরাপত্তা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে অস্থাস্থ্যকর খাবার, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি বাস্তবিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো ধোপে টেকে না। ভর্তি পরীক্ষার ফি-বাবদ নাকি প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ কিছু টাকা আয় করে। এই অঙ্ক কোন কোন ক্ষেত্রে দশ কোটিও ছাড়িয়ে যায়। ভর্তি পরীক্ষা থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিতে হয়। পত্রিকায় দেখলাম সেটি নাকি আসলে  করা হয় না। আয়ের বেশির ভাগই নানা কাজের সম্মানীর নামে, ভাগবাটোয়ারা করা হয়। ভিসি থেকে শুরু করে এই অর্থ পিওন দারোয়ান পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।

কিছু ভিসির অভিমত হচ্ছে, সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হলে প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জটিলতা হবে, গোপণীয়তা রক্ষা করা কঠিন হবে, মাইগ্রেশন পদ্ধতি কীভাবে থাকবে সেগুলো বিবেচনায় আনার জন্য প্রথমত একটি স্বচ্ছ নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, একটি আনন্দের সংবাদ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য কয়েকটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছে যেমন ইউজিসি বা কেন্দ্রীয় সেলের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, এমসিকিউর পরিবর্তে লিখিত পরীক্ষা, ফলাফলের ভিত্তিতে আসন সংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো এবং ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। তবে, এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা সহজ কিন্তু সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন। ফলে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে উঠতে পারে নানা  প্রশ্ন। অনেক শিক্ষার্থী উপযুক্ত হলেও ভর্তির বিবেচিত নাও হতে পারে। কয়েক লাখ ভর্তি পরিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়ার  জন্য প্রয়োজন শিক্ষক, কর্মকতা ও সহায়ক কর্মচারীর সমন্বিত একটি কার্যকরী পরিকল্পনা। ইউজিসি বা সেন্ট্রাল সেলের এরকম একটি পরিকল্পনা এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি যেটি অনুসরণ করে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা নিজ জেলা বা বিভাগে বসে পরীক্ষা দিতে পারে।

কেউ কেউ বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীরা এসে যখন কেন্দ্রে কাজ করবেন তাদের সমন্বয়ের  ব্যাপারটি হবে কঠিন। তবে, একেক বিশ্ববিদ্যালয়কে একেক বছর সমন্বয়ের দায়িত্ব দিলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে। যদিও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, প্রুফ রিডিং, তিন সেট প্রশ্ন বাছাই দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে এক ধরনের সমস্যায় ফেলে দিবে। দ্বিতীয়ত, কয়েক লাখ প্রশ্ন তৈরি, প্রিন্টিং, প্যাকেট  করা, সংরক্ষণ করা এবং সারা দেশে প্রেরণ কিংবা ইলেকট্রনিকভাবে প্রেরণ সব জায়গায় কিন্তু নিরাপত্তহীনতার একটি বিষয় থেকে যাচ্ছে। সে রকম দক্ষ ব্যবস্থাপনা কিন্তু গড়ে ওঠেনি। সুষ্ঠুভাবে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার মতো দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি একক কোন বিশ্ববিদ্যালয়, কিংবা ইউজিসির। আবার একটি বিশ্ববিদ্যালয় কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব নিলেও লজিস্টিক সাপোর্ট এবং একযোগে পুরো দেশে কাজটি করার মতো সক্ষমতা কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়তো নেই। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যখন ভিন্ন ভিন্নভাবে খাতা মূল্যায়ন করবেন তখন দেখা যাবে আরেক ধরনের সমস্যা অর্থাৎ উত্তরপত্র সঠিকভাবে ও ইউনিফরমলি মূল্যায়িত নাও হতে পারে। মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় একই ধরনের প্রশ্ন হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিভাগ ও ফ্যাকাল্টি। ভর্তিচ্ছুদের ভর্তির ও পছন্দের বিষয়টি কীভাবে যাচাই করা হবে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।

কেউ কেউ অবশ্য মত প্রকাশ করেছেন, গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে অনেক শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধও হয়ে যেতে পারে। কারণ একমাত্র ভর্তি পরীক্ষা কোন কারণে খারাপ হলে তার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ আর থাকছে না যা বর্তমান পদ্ধতিতে খোলা রয়েছে। অর্থাৎ রাজশাহীতে চান্স না পেলে চিটাগাং, চিটাগাং না পেলে ময়মনসিংহ ইত্যাদি। আবার দুর্নীতির সুযোগও প্রসারিত হবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা একই প্রশ্নপত্রে হলেও কেন্দ্র থাকবে আলাদা। বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় তখন কড়া নজরদারির মধ্যে পরীক্ষা নেওয়া হয়। সে বিষয়টি আর থাকবে না যখন পরীক্ষা দেশের আনাচে কানাচে অনুষ্ঠিত হবে। এত কিছুর পরেও শিক্ষার্থীদের কষ্টের কথা ভেবে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা হোক সমন্বিত পদ্ধতিতে আর না হলে অন্তত গুচ্ছ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ একই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা একসাথে গ্রহণ করতে হবে। গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে উপরোক্ত সমস্যাগুলো হতে পারে। তাই আগে ভাগেই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিষয়টি অসম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে তথা দেশের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা সমন্বিত কিংবা গুচ্ছ পদ্ধতিতে নেওয়াটাই উচিত হবে।

ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু হবে। ইউজিসি এ কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনে শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগের ব্যবস্থার বিপরীতে অবস্থান নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট তাদের সিদ্ধান্তের কথা এখনও সেভাবে জানায়নি।  ইউজিসি চেয়ারম্যান তাই বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে গোটা জাতির আকাঙ্খা অপূর্ণ থাকতে পারে না, কারও ইগো যেন অন্যদের প্রভাবিত করতে না পারে সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।’

লেখক: বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়