ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বেদনাবিধুর কালরাত ও আমার নির্বাসনের দিনগুলি (শেষ পর্ব)

শেখ ফজলে শামস পরশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ১৫ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৬:৩৬, ২৮ আগস্ট ২০২০
বেদনাবিধুর কালরাত ও আমার নির্বাসনের দিনগুলি (শেষ পর্ব)

বাবা শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে শিশু পরশ ও তাপস

দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আমরা বর্ডার পাড়ি দেই। এবার আমরা মেহেরপুর দিয়ে যাই। মেহেরপুরের সাবেক এমপি সহিউদ্দিন সাহেবের বাসায় আশ্রয় নেই। তার ছেলে, ফরহাদ হোসেনের (বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) সঙ্গে আমি দুটি কুকুরের বাচ্চা লালু-ভুলুকে নিয়ে খেলা করি। ফরহাদ আমাদের বয়সি ছিল।

সব ধরনের যানবাহনেই চলতে হয়েছিল বর্ডার পার হতে গিয়ে। গরুর গাড়ি, নৌকা, এমনকি রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে ডোবানালাও অতিক্রম করতে হয়েছিল। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল গরুর গাড়িতে চড়া; ছাউনিঅলা গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে অনেক ঝাঁকি খেতে হয়; মাথায় আঘাত লাগে। আমি কান্নাকাটি করছিলাম; সহ্য করতে পারছিলাম না। দাদি আর রেখা ফুফু (ছোট ফুফু) আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন- ‘আর একটু পথ, এই তো চলে এসেছি।’ কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। সহ্য করেছিলাম শুধু একথা জেনে যে, ওপারে পৌঁছালে বাবা-মাকে পাবো। তখনো আমরা জানি না যে, বাবা-মা নেই। আমাদের বলা হয়েছিল বাবা-মা আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছে। ওপারে পৌঁছালে সেলিম কাকা আর মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে। এমনকি ছোট্ট তাপসও আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। বলছিল, ‘পরশদাদা আরেকটু কষ্ট করো। ওপারে গেলেই সেলিম কাকা, মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে।’ ওটাই ছিল আমার আর তাপসের একমাত্র ভরসা, একমাত্র আশার সম্বল।

ঠিক বর্ডারের কাছেই আমরা একটা চরের মতো জায়গায় আশ্রয় নিলাম। চারদিকে থইথই পানি; ঘন অন্ধকার রাত। আমরা অনেক ভয় পেয়েছিলাম। জায়গাটা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমাদের সঙ্গে সেলিম কাকা নজরুল নামে একটা লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করেছেন। তিনি না থাকলে হয়তো-বা আমরা আসতেই পারতাম না। একটা সময় ইঙ্গিত এলো যে এখন ফাঁকা আছে, আমাদের দৌড় দিতে হবে। তাপসকে কোলে নিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারে দৌড় দিলাম। হাঁটু পর্যন্ত পানি অতিক্রম করে আমরা বিএসএফ বর্ডারে পৌঁছলাম।

বিএসএফ বর্ডারে একটা অফিসে আমাদের বসানো হলো। ওখানে উর্দি পরা মানুষজন ঘোরাফেরা করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অনেকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। তবে ওরা অনেক আদর-যত্ন করেছে। আমাদের নাস্তাও খেতে দিয়েছিল। সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাকে দেখে আমাদের আনন্দ আর ধরে না! আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আমাদের সকল কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং আমাদের বাবা-মার কাছে নিয়ে যাবে। আমাদের আর পায় কে! সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাও আমাদের বুকে জড়িয়ে ভীষণ কান্না করছিলেন। তাদের কান্না দেখে আশপাশের সবার চোখেই পানি এসেছিল সেদিন।

তারা আমাদের কলকাতার বাঙ্গর নামক এলাকায়, সিন্ডারেলার বাসায় নিয়ে এলো। বাসাসংলগ্ন সিন্ডারেলা নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। এ কারণেই বাসাটা ‘সিন্ডারেলার বাসা’ নামে পরিচিত। ঐ বাসায় আমরা দুই ভাই বাবা-মাকে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি সেখানে চাচি, মামি, কান্তা আপু ও শিশু সাদেকও (বর্তমান বরিশালের মেয়র) আছে। কান্তা আপু আমাদের থেকে দুই-তিন বছরের বড়। এছাড়া ওখানে ততদিনে বেশ কিছু আমাদের বাংলাদেশি আত্মীয়স্বজন যাদের হয়রানি করছিল মোশতাক সরকার বিভিন্নভাবে তারাও পালিয়ে এসেছিল। সেখানে অনেকেই ছিল কিন্তু বাবা-মা ছিল না।

আস্তে আস্তে আমাদের না পাওয়ার যন্ত্রণা সয়ে আসছিল কিনা জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে এক ধরনের বিরক্তি কাজ করছিল। আমি যেন বাবা-মাকে চাইতে চাইতে, আর না পেয়ে পেয়ে অতিষ্ঠ। জিদ করে বাবা-মার কাছে যেতে চাওয়াও কমিয়ে দেই এক সময়। তবু অবচেতন মনে একটা আশা ছিল হয়তো-বা বাবা-মা আসলেই লন্ডনে আছেন। কারণ আমাদের সেকথা বলেই সান্ত্বনা দেওয়া হতো। আমি মনে হয়, ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আশা করতাম বাবা-মাকে কোনো একদিন ফেরত পাব। এক সময় বুঝতে পারলাম যে বাবা-মা লন্ডনে থাকার কথাটা একটা অবাস্তব কল্পনা।

যেহেতু এক বাসায় বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছিল, কয়েক মাস পরে আমরা বাসা বদলি করে আরেকটা বাসায় উঠি। ছোট্ট একটা তিন রুমের একতলা বাসা। পাশেই দুই কামরার অন্য একটা বাসা। সেখানে আরেকটা পরিবার থাকতেন। দুই বাসার মাঝখানে শুধু কলাপসিবল গেটের একটা দেয়াল। ওখানে এক সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করতেন। ভদ্রলোক চাকরিজীবী ছিলেন, নিয়মতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। মৃদুভাষী ঐ ভদ্রলোকের নামটা আমার মনে নাই, তবে তার স্ত্রী, তন্দ্রা কাকি আমাদের পড়াতেন এবং অনেক আদর করতেন। তাদের দুই সন্তান- নান্টু আর মালি। মালি আমার বয়সি হবে, আর নান্টু আমার থেকে দুই-এক বছরের বড়। শিগগিরই ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদের প্রতি মাসেই কোনো-না-কোনো ধর্মীয় উৎসব থাকত। প্রথমটাতে যাওয়ার পরে আমার লোভ হয়ে গেল। আমি তারপর থেকে সবগুলো পূজার উৎসবে যেতে বায়না ধরতাম। দাদি ভয় পেতেন, যেতে দিতে চাইতেন না। আমিও জিদ করতাম। চাচি দাদিকে বুঝিয়ে ব্যবস্থা করে দিতেন। পূজা উৎসবগুলোর গানবাজনা আর আনন্দমুখর পরিবেশ আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগত। কান্তা আপুও মাঝে মাঝে আসত। আমরা একসঙ্গে খেলতাম।

একদিন আমি, কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু একটা অভিযানে বের হলাম। আমরা চিরাচরিত গণ্ডি পেরিয়া দূরে যে দমদম বিমানবন্দর দেখা যায় সেখানে যাবো ঠিক করলাম। আমরা মাঠঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমি সবার আগে দৌড়াচ্ছিলাম। সামনে দেখি কালো চকচকে নিচু একটা পিচঢালা জায়গা। পা দিতেই হঠাৎ অনুভব করলাম যে, আমি কাদায় পা দিয়েছি। কিন্তু কাদা থেকে পা ওঠাতে পারছি না। দেখলাম যত চেষ্টা করছি, আমি কাদার ভেতরে আরও ঢুকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এসে দেখে আমি প্রায় কোমর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছি। তাপস আমার এই অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না দেখে আমিও কান্না শুরু করলাম। কান্তা আপু আর নান্টু আমাদের মধ্যে বড়। এরা দুজন আমাকে উঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু আমরা অভিযানের জন্য শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিলাম, জায়গাটা ভীষণ জনশূন্য ছিল। অনেক কসরত করে ওরা আমাকে চোরাবালি থেকে উদ্ধার করল। আমাকে তুলতে গিয়ে নান্টুর একটা পাও চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছিল। পা উঠাতে গিয়ে ওর স্যান্ডেলটা খোয়া যায়। এই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিযানের ফল, আর দাদির কথার অবাধ্য হওয়ার শাস্তি।

ফেরার পথে আমরা সবাই খুবই ভীত এবং মন খারাপ করেছিলাম। স্যান্ডেল হারিয়ে নান্টুর কি পেরেশানি! স্যান্ডেলজোড়া গত মাসে পূজার সময় ওর বাবা কিনে দেন এবং সামনের বছরের পূজার আগে ওকে আর স্যান্ডেল কিনে দেওয়া হবে না। এই হচ্ছে ওর ডিলেমা। কথাটা শুনে আমি বুঝতে পারি নাই প্রথমে। পরে বুঝলাম যে, ওর বাবা চাকরিজীবী; সীমিত আয়। তাই আরেক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে ওর সামনের বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই নিয়মটা আমাকে ভাবায় এবং অবাকও করে।

আমরা একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে সামনের ঘরে খেলছি। হঠাৎ দেখি কে যেন বাইরের দরজায় করা নাড়ছে। শুনলাম পাশের ঘরে কান্নার আওয়াজ। দৌড়ে দাদির ঘরে গিয়ে দেখি, দাদি একটা দাড়ি ও লম্বা চুলঅলা অল্প বয়সি লোককে ধরে কাঁদছে। আমার বেশ খানিকটা সময় লাগল চিনতে যে লোকটা আমার মারুফ কাকা। ১৫ আগস্টের পরে মারুফ কাকার সঙ্গে মনে হয় ঐ প্রথম আমার দেখা। মারুফ কাকাকে চেনাই যাচ্ছিল না- যে জংলি অবস্থা! সারাশরীরে তার দাগ আর ক্ষত। পরে শুনলাম মারুফ কাকা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীতে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মারুফ কাকা ’৭১ আর ’৭৫-এ মোট দুবার যুদ্ধ করেছেন। শুধু ’৭৫-এ তিনি দুবার তার বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। দুর্ভাগ্যবশত দুবারই সেই প্রচেষ্টা বিফল হয়।

চাচি আমাদের বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন। চাচির প্রধান লক্ষ্য ছিল আমাদের যেন মন খারাপ না হয়; কান্নাকাটি না করি। সুভাষ (শেখ ফাহিম, এফবিসিসিআই’র প্রেসিডেন্ট) তখন ছয় মাসের হবে। সেলিম কাকা আর দাদির কাছে সুভাষকে রেখে আমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সার্কাস দেখতে, অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে, আর শিশুপার্কে নিয়ে যেতেন। আমরা কোনো কিছুতেই ‘না’ করতাম না। চাচি আমাদের মায়ের মতোই ভালোবাসতেন। কারও বোঝার উপায় ছিল না যে আমরা চাচির সন্তান না। ২৪ ঘণ্টা চাচি আমাদের পেছনে সময় দিতেন। শুধু রাতে ঘুমাতাম দাদি আর রেখা ফুফুর সঙ্গে। চাচি সারাক্ষণ আমাদের আগলে রাখতেন। মা’র শেষ কথাটা: ‘আমার পরশ-তাপসকে তুমি দেইখো’ চাচি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।

একদিন চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের নিয়ে বের হয়েছেন। ব্যস্ত রাস্তাঘাট। রেখা ফুফুও তখন ছোট, ১৫ বছর বয়স হবে। চাচি আর রেখা ফুফু আমাদের দুই ভাইয়ের হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অস্থির আমি, চাচির হাত থেকে ছুটে দৌড় দেই একটা বাসের সামনে দিয়ে রাস্তার ওপারে যাওয়ার জন্য। বাসটা বিকট শব্দ করে কষে ব্রেক করে। চাচি আর রেখা ফুফু সেদিন বড্ড ভয় পেয়েছিলেন! চাচি তো রীতিমতো কাঁপছিলেন। তিনি কেঁদে বলছিলেন, ‘আমার শাশুড়িকে আমি কি জবাব দিতাম, যদি কিছু হইত!’

তখন বুঝলাম যে আমার এমন করা উচিত হয় নাই। দেখতে দেখতে এভাবে প্রায় বছরখানেক পেরিয়ে যায়। আমাদেরও বাসা পরিবর্তন করার সময় চলে আসে। বাসা পরিবর্তন করা মানেই মায়ার টানাপড়েন। আমার তন্দ্রা কাকী, আর নান্টুকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিল। আমরা বাঙ্গরের আর একটা এলাকায় বাসা নেই। নতুন বাসাটা দোতলা বাসা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আর নতুন এলাকা। আশপাশের প্রতিবেশীরা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে আমাদের গ্রহণ করল। আমাদের মা-বাবা না থাকার ঘটনাটা মনে হয় ওরা জানত। যদিও আমরা নিজেরাই তখনো সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নই ব্যাপারটাতে। আমি শুধু এটুকু বুঝতাম যে, মানুষজন আমাদের একটু আলাদা চোখেই দেখত, আর আমাদের একটু বেশি মায়া করত। ওখানে আশপাশে অনেকগুলো পরিবার, বেশিরভাগই অল্প বয়স্ক মেয়েরা। চাচি ও রেখা ফুফুর সঙ্গে ওদের ভালো সখ্য হয়ে গেল। আমার বয়সি মনে হয় তেমন ছেলেপেলে ছিল না। বা থাকলেও ওদের সঙ্গে আমার নান্টুর মতো বন্ধুত্ব হলো না। তবে ওখানে পেলাম অন্যরকম আকর্ষণ। আমাদের ঠিক সামনের বাসাটা একটা বহুতল বিশিষ্ট ফ্ল্যাট বাড়ি। এই বাসায় একটা তেজি সেবেল জার্মান সেপারড কুকুর ছিল, নাম মিকি। মিকিকে ঠিক সন্ধ্যার সময় বের করে রাস্তায় ছাড়ত। মিকি আমাদের গেটের সামনে আসতো আর আমি ওকে বাসা থেকে এনে পাউরুটি খাওয়াতাম। আমার দারুণ ভালো লাগত। মিকিকে বল ছুড়ে মারলে ও বল নিয়ে আসতে পারত।

মিকিদের পাশের বাসাটা একটা দোতলা বাসা। ঐ বাসায় একজন বয়স্ক মহিলা থাকতেন। তারও একটা জার্মান সেপারড কুকুর ছিল। ওর নামটা আমার মনে নাই। সাদা আর হালকা বাদামি এই সেপারডটার মধ্যে একটা আভিজাত্য ছিল। ও কারও সঙ্গে খেলত না। ও বাসায় থাকতে আমি দুটি খরগোশ পালতাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি যে, খরগোশ দুটির রক্তাক্ত অর্ধাংশ; উপরের অংশটা শুধু আছে। বড়রা বুঝালো যে, বিড়াল এসে খাঁচা ভেঙে আমার খরগোশ দুটি খেয়ে গেছে। আমি বিস্মিত হলাম আর সারাদিন কাঁদলাম। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শিক্ষা নিলাম যে আমাকে আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল; ওদের ঘরের ভিতরে আরও নিরাপদে রাখা দরকার ছিল। এটা তখন আমার কল্পনার বাইরে ছিল যে, বাইরের বিড়াল খরগোশ খাবে।

শেখ ফজলে শামস পরশ

ছোটবেলা থেকেই আমার পশুপাখির প্রতি অনেক ঝোঁক। একবার আমি টুঙ্গিপাড়া থেকে আসার সময় বায়না করে কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এসেছিলাম লঞ্চে করে ঢাকায়। ওরাও ১৫ আগস্টের শিকার হয়েছিল। আমার নানা, আবদুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায়ও দুটি লাল গরু ছিল। একবার আমি গরুগুলোকে ঘাস খাওয়াতে কাছে গিয়েছি। হঠাৎ একটা গরু ছুটে আমাকে তাড়া করেছিল এবং গুঁতাও মেরেছিল। মা’র কি পেরেশানি! তিনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন।

দাদার (বঙ্গবন্ধু) বাসায় যেতে পছন্দ করার অন্যতম কারণ ছিল, ওখানে অনেক ধরনের জীবজন্তু ছিল। কবুতর, কুকুর, মোরগ-মুরগি এবং অন্যান্য। একবার ঐ বাসায় গিয়ে দেখি যে, একটা মুরগি অনেকগুলো বাচ্চা দিয়েছে। আমি ওদের নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে গেলাম এবং ওদের ছাড়া আসতে চাচ্ছিলাম না। আমি বায়না ধরলাম যে আমারও ওগুলো লাগবে। মা তো মহামুসিবতে পড়লেন। আমি কিছুতেই ওদের পিছ ছাড়ি না। মা আমাকে একরকম জোর করে নিয়ে এসেছিলেন সেদিন।

আমি কাঁদতে কাঁদতে ও-বাসা থেকে চলে এলাম। বাসায় আসার পর, বিকালে দেখি আপন দাদি (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) মুরগি আর মুরগির বাচ্চাগুলো আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঐ বাসায় আমি আপন দাদির অনেক ভক্ত ছিলাম। তিনি আমাকে সব কিছুতে প্রশ্রয় দিতেন। আমার নিজের দাদিকে বাদ দিয়ে তাকেই ‘আপন দাদি’ ডাকতাম। এই ছিল আমাদের মধুর সম্পর্ক।

আর একজনের আমি খুব ভক্ত ছিলাম, তিনি হলেন হাসুমণি (জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনা)। তিনি আমার মা’র শুধু মামাতো বোনই ছিলেন না, মার বান্ধবীও ছিলেন। তাই হাসুমণির কোলে জয়কে (সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য) দেখলে আমি অভিযোগের সুরে জিজ্ঞাস করতাম, ‘হাসুমণির কোলে জয় কেন?’

হাসুমণির যে গুণটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত, তা হচ্ছে তার মমত্ববোধ। প্রান্তিক মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ সমবেদনা ছিল। শিশুদের থেকে শুরু করে গৃহকর্মীদের প্রতি, এমনকি পশুপাখি এবং জীবজন্তুর প্রতিও হাসুমণির প্রচণ্ড মায়া ছিল। এই মানবিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় তিনি সবার থেকে আলাদা। তিনি শিশুদের সঙ্গে অত্যন্ত সদয় ছিলেন। শিশুদের তিনি অনেক সময় দিতেন এবং সত্যিকার অর্থে যত্নশীল ছিলেন। শিশুদের মতামতের প্রতিও তিনি গুরুত্ব দিতেন।

একবার আমরা দিল্লি গেলাম। দাদি-নানি (আমার দাদি আর নানি দুই বোন), রেখা ফুফু আর আমরা দুই ভাই। হাসুমণি, রেহানা ফুফু আমাদের পেয়ে প্রচণ্ড আদর-যত্ন করলেন। তারা মনে হয় আমাদের পেয়ে তাদের নিজ শোক সংবরণ করার শক্তি পেলেন। আমার সব দুষ্টুমি তারা মেনে নিতেন। জয় অনেক ঠাণ্ডা প্রকৃতির এবং সৃষ্টিশীল ছিল। সারাক্ষণ প্লেডো দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানাত। ওর ধৈর্য দেখে আমি অস্থির হয়ে যেতাম। আমি ওর সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি বা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে চাইতাম। কিন্তু ওর ওসব খেলার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। অনেক শৃঙ্খলার সঙ্গে জীবনযাপন করত। আমি অস্থির হয়ে ওর তৈরি করা সবকিছু ভেঙে দিতাম। ও রাগ করে আমার পিছে দৌড়াত, এতে আমার উদ্দেশ্যও হাসিল হতো। আমি পালাতাম। দাদি আর নানি আমাদের গোলমাল ঠেকাতে এসে মাঝেমধ্যে ব্যথা পেতেন। জয় তাতে অনেক বিচলিত হয়ে আমার নানিকে বলত, ‘আপনে কেন মাঝখানে এসে ব্যথা পেলেন?’ দাদিকে দেখিয়ে বলত, ‘তিনি তো ঠেকাতে আসেন না!’ হাসুমণি, রেহানা ফুফু কিছুই বলত না। আমাদের এসব কাণ্ডকলাপ দেখে মনে হয় মজা পেতেন। তাঁদের অনেক ধৈর্যশক্তি।

এভাবে প্রায় বছরতিনেক হয়ে গেল। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম বাবা-মা ছাড়া জীবনে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। আবার সীমানা পেরিয়ে ফিরে আসা। আমাদের বাঙ্গরের প্রতিবেশীরা অনেক মন খারাপ করল। ওদের সঙ্গে আমাদের খুব আন্তরিকতা হয়ে গিয়েছিল; পরিবারের মতো। ঠিক হলো আমি, তাপস, রেখা ফুফু, দাদি আগে ফিরব। পরে চাচারা আসবে। ফিরে আসতে আসল কষ্টটা ছিল কঠোর বাস্তবতার অনুধাবন যে, বাবা-মা আসলে লন্ডনেও নেই; তারা আকাশে হারিয়ে গেছেন অজস্র তারার মাঝে। এই বাস্তবতায় মন মানতে না চাইলেও আমাদের কোনো কিছু করার ছিল না। কাকে কী বলব? কেউ তো ভালো নেই। খামাখা সবাইকে এ ব্যাপারে বিরক্ত করে লাভ কী? তারা তো বাবা-মাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না, পারলে তো আগেই দিত।

আমার মা গান গাইতে অনেক ভালোবাসতেন। আমাদের ঘুম পাড়ানোর সময় গাইতেন আঞ্জুমান আরা বেগমের সেই বিখ্যাত ঘুমপাড়ানি গান: ‘খোকন সোনা বলি শোনো, থাকবে না আর দুঃখ কোনো- মানুষ যদি হতে পারো। এই কথাটি মনে রেখ দুঃখীজনের সহায় থেকো।’ আমরা দুই ভাই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ হওয়ার সেই নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যেন ঘুমপাড়ানি এই গানের মধ্য দিয়ে, মা জীবনের সকল উপদেশ দিয়ে গেছেন। শুধু আফসোস মা দেখতে পারলেন না! দেখতে পারলেন না যে, আমরা পড়াশোনা শিখে তার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি। মা’র লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল। মৃত্যুর পর তাঁর এমএ পরীক্ষার ফল বের হয়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেছিলেন।

আগস্ট মাস এলে মানুষ জানতে চায়, বাবা-মা হারা আমাদের ছোটবেলা কীভাবে কেটেছে? কেমন ছিল আমাদের বেড়ে ওঠা? তাদের জন্যই আমার এই লেখা। অবশ্যই আমাদের বেড়ে ওঠা আর দশটা বাচ্চাদের মতো ছিল না। অত্যন্ত কোমল বয়সেই আমরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। আমি এও জানি যে, নির্বাসিত শিশু হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা একটি আকর্ষণীয় একাডেমিক আলোচনা হিসেবে জায়গা পেতে পারে। তবুও বলব, তুলনামূলকভাবে অনেক এতিম বাচ্চাদের তুলনায় আমাদের শৈশব কেটেছে পরিবার-পরিজনের মায়া-মমতায়। আমার আত্মীয়-স্বজনদের আমাদের প্রতি মমত্ববোধ আর ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। বরং আমরা একদিক দিয়ে ভাগ্যবান যে বাবা-মা’র ভালোবাসায় বঞ্চিত হলেও, অন্যান্য স্বজনদের স্নেহ-মমতা আমরা অনেক বেশিই পেয়েছি। যেটা কেউ পায় না। তবে এত আদর-যত্ন, ভালোবাসার মধ্যেও আমি অবশ্যই বাবা-মাকে খুঁজেছি।

মা’র গাওয়া নির্মলা মিশ্রার আর একটি গানের কথা মনে হয়: ‘ও তোঁতা পাখীরে, শিকল খুলে উড়িয়ে দেব, আমার মাকে যদি এনে দাও...ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে, কখন যে মা গেল চলে? সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও।’ যতই অনুভূতি রুদ্ধ করে রাখি, যতই খেলাধুলায় মেতে থাকি, শিশুরা যে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াবে এটাই প্রকৃতির রীতি।

[বি. দ্র. : লেখাটা সম্পূর্ণরূপে আমার শিশুকালের স্মরণশক্তির ওপর ভিত্তি করে লেখা। তাই আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই মর্মে যদি ভুলবশত কাউকে আমি ভুলে গিয়ে থাকি। এখানে অনেক ঘটনা অসম্পূর্ণ ও আংশিক সত্য হতে পারে। কারণ অপরিপক্ব একটা ছয় বছরের শিশুর খণ্ড খণ্ড- স্মৃতির ওপর এই কাহিনি গাঁথা। তাই পরিপূর্ণ সত্যতার কোনো দাবি এখানে আমি করছি না।]

লেখক পরিচিতি:

অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতি ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির জ্যেষ্ঠ সন্তান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কালরাতে শেখ ফজলে শামস পরশের বাবা-মা শহীদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নেওয়ার পর দেশে ফিরে শেখ ফজলে শামস পরশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

পড়ুন প্রথম পর্ব: * বেদনাবিধুর কালরাত ও আমার নির্বাসনের দিনগুলি

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়