ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বন্দরের যুদ্ধে এগিয়ে বাংলাদেশ

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৭, ২১ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৮:৩৮, ২১ জানুয়ারি ২০২১
বন্দরের যুদ্ধে এগিয়ে বাংলাদেশ

মাতারবাড়িতে হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর

বিশ্বজুড়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নীরব একটা যুদ্ধ চলছে। সে যুদ্ধের নাম ‘বন্দরের যুদ্ধ’। কে কত কৌশলগত সুবিধাজনক বন্দরের দখল নিতে পারে- এই হলো মূল উদ্দেশ্য। বন্দরের দখল নেওয়াই মানে বাণিজ্যের দখল নেওয়া। পরবর্তী সময়ে যা সামরিক স্থাপনা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই যুদ্ধে বাংলাদেশও জড়িয়ে পড়েছে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে।

বাংলাদেশে দুটি সমুদ্র বন্দর আছে। আরো দুটি তৈরি হচ্ছে। তাহলে দেশটি নতুন করে কিভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল- প্রশ্নটি থেকে যেতেই পারে। এর আগে বাংলাদেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রামে কিভাবে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়; একটু জেনে নেওয়া যাক।

চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। কেন পারে না, সেটা পরে লিখছি। বন্দরের বহিঃনোঙরে বড় জাহাজগুলো পণ্য নিয়ে আসে। সেখান থেকে লাইটার বা হালকা জাহাজে পণ্য বন্দরে আসে। এজন্য প্রতিদিন বন্দর ব্যবহারকারীদের ১৫ হাজার ডলার বাড়তি অর্থ দিতে হয় বলে ২০১৮ সালে ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ জানায়। 
মজার ব্যাপার বহিঃনোঙরে যে বড় জাহাজগুলো আসে সেসবও পণ্য প্রেরক দেশ থেকে আসে না। সেসব আসে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা শ্রীলঙ্কার বন্দর থেকে। অবশ্য সিঙ্গাপুরের বন্দর থেকেই বেশি আসে। এসব বন্দর হয়ে আসে কেন? এই প্রশ্নটির উত্তরের মধ্যে বন্দরের যুদ্ধের রহস্য লুকিয়ে আছে।

বর্তমানে পণ্য পরিবহনের জন্য সাধারণত এক হাজার ফুটের বেশি লম্বা জাহাজ ব্যবহার করা হয়। এদের এক কথায় ‘পানাম্যাক্স ভ্যাসেল’ বলে। অর্থাৎ পানামা খালে চলাচলের হিসাব করে তৈরি করা জাহাজ। এসব জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বন্দরে ন্যূনতম ১৪ মিটার গভীরতার প্রয়োজন হয়। অথচ আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের গভীরতা ৯ মিটারের একটু বেশি। মংলা বন্দরের গভীরতা সাড়ে ৭ মিটারের মতো। প্রতিবেশী কলকাতা শ্যামাপ্রসাদ বন্দরের গভীরতা ৮ মিটারের একটু বেশি।

শুধু নাব্য সমস্যা নয়, চট্টগ্রাম বন্দরে আরো সমস্যা আছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলি নদীর ওপর হওয়ায় এখানে শুধু জোয়ারের সময়ই জাহাজ ঢুকতে বা বেরুতে পারে। এছাড়া কর্ণফুলি নদীতে দু'টি বাঁক থাকায় ১৯০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ বন্দরে ঢুকতে পারে না।

এই নাব্যতা সংকটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি পণ্য আসতে অন্তত ৫ বার ওঠানো-নামানো করতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে পানাম্যাক্স ভ্যাসেল আসতে পারলে এক জাহাজেই রপ্তানিকারক দেশ থেকে পণ্য আনা সম্ভব। এই সমস্যার সহজ সমাধান গভীর সমুদ্র বন্দর। দুনিয়াজুড়ে পরাশক্তিগুলো এখন বিভিন্ন দেশে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন ও এর নিয়ন্ত্রণ দখলের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বন্দরের বার্ষিক কন্টেইনার ওঠা-নামানোর পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায় বন্দরের ড্রাফট বা পানির গভীরতা এর অর্থনৈতিক গুরুত্বের সঙ্গে কেমন জড়িত।

এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর সিঙ্গাপুর। ছোট্ট একটি দেশ। যার আমদানি-রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ খুবই নগণ্য হওয়ার কথা। অথচ এটি কন্টেইনার হ্যান্ডেলিঙে পৃথিবীর দ্বিতীয়। কারণ এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো গভীর সমুদ্র বন্দর এটি। এর ড্রাফট ১৬ মিটার। কন্টেইনার পরিবহনের একককে TEUs বলে। twenty-foot equivalent units. অর্থাৎ বিশ ফুট দৈর্ঘের একটি কন্টেইনারকে এক ইউনিট ধরা হয়। ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুর বন্দর ৩৬,৬,৬০,০০০ টিইইউ কন্টেইনার হ্যান্ডেল করেছে। এরপর রয়েছে মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্লেং (১২তম) ও তেনজান পিলিপাস বন্দর (১৮ তম), থাইল্যান্ডের চ্যাবং বন্দর (২১তম) ও ইন্দোনেশিয়ার তেনজান প্রিয়ক বন্দর (২২তম)। বন্দরগুলোর ড্রাফট যথাক্রমে ৮ মিটার, ১৭ মিটার, ৮.২ মিটার ও ১৪ মিটার। লক্ষ্যণীয়, মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্লেং থাকার পরও তেনহজানের মতো দুটো গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করেছে। একটি পরিকল্পনাধীন। কোনভাবেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া যাবে না।

প্রতিবেশী সব দেশের তুলনায় খুব ছোট একটি দেশ শ্রীলঙ্কা তার প্রতিবেশীদের টেক্কা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে (২৪তম)। সেখানে ভারতের মতো বড় দেশের সবচেয়ে বড় বন্দর মুম্বাই জহরলাল নেহেরু বন্দর (৩১তম) তার থেকে অনেক পিছিয়ে। ভারত এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ৩টি গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করেছে যথাক্রমে মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র ও উড়িষ্যায়। শেষেরটি বেসরকারি অর্থায়নে নির্মিত। আরো একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ করছে ভারত। চীন নিজের দেশেই ৬০টি গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন করেছে। সোমালিয়ার মতো একটি অরাজক দেশে চীন ২টি গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করেছে। এছাড়া কেনিয়া, সুদান, মোজাম্বিকের মতো দেশগুলোতে চীন বন্দর তৈরি করে দিয়েছে।

২০১৬-এ পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে গাউদারে ডিপ সি পোর্ট করে দিয়েছে চীন। এতে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের অবরুদ্ধ প্রদেশগুলো সহজে বন্দর সুবিধা পাচ্ছে। এই বন্দরের যাতায়াতের পথ নির্বিঘ্ন রাখার লক্ষ্যেই চীন লাদাখে বারবার আক্রমণ চালায়। এদিকে ভারত তার আঞ্চলিক আধিপত্য ধরে রাখতে ইরানের ছাবাহার বন্দরের উন্নয়ন সাধন করেছে। সেটাকে ভারত আফগানিস্তানের করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।

যে দেশ যত আগে গভীর সমুদ্র বন্দরের যুগে পা রেখেছে সেই এগিয়ে গেছে অর্থনীতির যুদ্ধে। এমন একটা ধারণা এখন প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রনায়কদের মাথায়। তাই সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে এগিয়ে আসছে। এই লোভ কাজে লাগিয়ে চীন দরিদ্র দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে ফেলছে। বন্দর নির্মাণের পর দেখা যাচ্ছে পূর্বাভাস অনুসারে আয় হচ্ছে না। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা ও কেনিয়াকে তাদের বন্দর ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে হয়েছে চীনকে। পাকিস্তানও সে পথেই এগুচ্ছে।

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় অবস্থিত। বাংলাদেশের বন্দরগুলো থেকে ভারতের উত্তরপূর্বের প্রদেশগুলো খুব কাছে। চীনেরও দক্ষিণভাগের স্থলবেষ্টিত অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের বন্দরগুলো সুবিধাজনক। এছাড়া নেপাল, ভুটান তো আছেই। এদিকে বাংলাদেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। Goldman Sachs-এর হিসাবে বাংলাদেশ ১১ উদীয়মান অর্থনীতির দেশের একটি। ২০২১ নাগাদ এর আমদানী-রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর আঞ্চলিক চাহিদা তো দূর, অভ্যন্তরীণ চাহিদাই মোকাবিলা করতে পারবে না।

এমন বাস্তবতায় ২০১২ সালে কক্সবাজারের সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি কক্সবাজার মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন-২০১১’র খসড়া অধ্যাদেশ গঠন অনুমোদন করে মন্ত্রীসভা। বন্দরটি বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের মুনাফা ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু প্রথম থেকেই এই বন্দর স্থাপনের জন্য চীন আগ্রহ দেখায়। ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চীন সফরকালে ১৪ বিলিয়ন ডলারের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ এ নিয়ে ভীষণ উৎকণ্ঠায় পড়ে। উৎকণ্ঠা ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরও। ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’র প্রতিবেদনে জানা যায়, ভারত একে তার নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। আর চীনের ঋণের ফাঁদে পড়তে বাংলাদেশ আগ্রহী ছিল না।

এদিকে সোনাদিয়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মাতারাবাড়িতে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ করছিল জাপানি কোম্পানি। তারা জেটি নির্মাণের সময় সমীক্ষা করে দেখে সেখানে গভীর সমুদ্র বন্দর করা সম্ভব। সোনাদিয়ার চেয়েও ভালো বন্দর হতে পারে। ২০১৬ সালে জাইকা সমীক্ষা চালিয়ে জানায়, ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রায় সাড়ে ১৮ মিটার গভীরতার একটি চ্যানেল তৈরি করা যাবে। জাপান সরকার এ প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ দেখায়। গত বছরের জুলাই মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প বাদ দিয়ে দেয়। এর আগে মার্চ মাসে ১৭ হাজার ৭শ ৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ০.১ শতাংশ সূদে ৩০ বছরের জন্য ঋণ দিচ্ছে জাপান। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর সুদমুক্ত। গত ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার ‘পেলাভুবন সিলেগন’ বন্দর থেকে স্ট্রিম জেনারেটরের যন্ত্রাংশ নিয়ে মাতারাবাড়ির ক্যানেলে প্রবেশ করে একটি জাহাজ। আশা করা যায় ২০২৬ সালে এ বন্দরের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।

এ বন্দর নির্মিত হলে বাংলাদেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে। আর সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর বন্দরের উপর বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হবে না। বরং কলকাতা বন্দরের মালামাল এ বন্দর থেকে খালাস করা যাবে। এতে ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ দুই সাশ্রয় হবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে বন্দর নিয়ে যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতেও পারবে। ইতোমধ্যেই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বাংলাদেশ এ যুদ্ধে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ না চীনের ঋণের ফাঁদে পা রেখেছে, না শক্তিশালী প্রতিবেশীর রোষাণলে পড়েছে। অধিকন্তু সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে গেছে তার শান্তিপ্রিয় পরীক্ষিত বন্ধুর কাছ থেকে। বন্দরের যুদ্ধে বাংলাদেশের এ সাফল্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

সূত্র: দেশি-বিদেশি পত্রিকা

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়