ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ : একটি পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব)

মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২১, ৩ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৫:৫৫, ৩ এপ্রিল ২০২১
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ : একটি পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব)

চার. রূপ ও শব্দ বিষয়ক আলোচনা

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের তৃতীয় পরিচ্ছেদ রূপতত্ত্ব। কিন্তু ‘রূপ’ কী তা এর কোথাও বলা হয়নি। পরিচ্ছেদটিতে আলোচিত হয়েছে ‘শব্দ’, ‘শব্দের গঠন’, ‘শব্দের শ্রেণিবিভাগ বা সংবর্গ’, ‘শব্দের শ্রেণি বা সংবর্গ পরিবর্তন’, ‘লিঙ্গ’, ‘বচন’, ‘পক্ষ বা পুরুষ’ এসব প্রসঙ্গ। এগুলির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে শব্দের শ্রেণিবিভাগের আলোচনা। বাংলা শব্দরাজিকে এতে বিশেষ্য, সর্বনাম, অব্যয়, বিশেষণ ও ক্রিয়া এই পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে এই শ্রেণিগুলিকে, প্রথাগত ধারার আর সব বাংলা ব্যাকরণের মতোই, শব্দ-শ্রেণি নয় বরং পদ-শ্রেণি বলা হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণেও এগুলি পদ-শ্রেণি হিসাবে বর্ণিত। তবে পদ-শ্রেণির সংখ্যা সেখানে পাঁচটি নয়, আটটি — বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া, ক্রিয়াবিশেষণ, অনুসর্গ, যোজক ও আবেগ। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে শব্দ-শ্রেণির বা পদ-শ্রেণির পরিচিতিমূলক আলোচনা না থাকলেও শব্দগঠন ও পদগঠনের আলোচনা আছে। অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণেও শব্দগঠন ও পদগঠন-প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। তফাৎ এখানে যে, শেষোক্ত অর্থাৎ নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে পদগঠন সম্পর্কিত আলোচনা আছে শব্দগঠন বিষয়ক আলোচনার পরে। কিন্তু সপ্তম আর অষ্টম  শ্রেণির ব্যাকরণে পদগঠন বিষয়ক আলোচনার পরে ‘শব্দগঠন’-পরিচ্ছেদ যুক্ত হয়েছে।

ইতিপূর্বে, ‘ধ্বনি বিষয়ক আলোচনায়’, আমরা উল্লেখ করেছি যে, ধ্বনি সম্পর্কে বোর্ডের ব্যাকরণগুলি থেকে অভিন্ন ধারণা পওয়া যায় না। শব্দের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে আছে, “দুই বা তার চেয়ে বেশি ধ্বনি মিলে শব্দ তৈরি হয়। যেমন —  ম্ এবং আ মিলে হয় মা; আ +ম্ +আ র্+ = আমার। একটি ধ্বনি দিয়েও একটি শব্দ তৈরি হতে পারে। যেমন— ই, উ, আ।” (পৃ. ৪০)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, “এক বা একাধিক ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি অর্থবোধক ও উচ্চারণযোগ্য একককে বলা হয় শব্দ।” (পৃ. ৪৩)। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে শব্দের দুটি সংজ্ঞা আছে। একটি এরকম — “এক বা একাধিক ধ্বনির সম্মিলনে যদি কোনো নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ পায় তবে তাকে শব্দ বলে।” (পৃ. ২৫)। অন্য সংজ্ঞাটি হলো, “এক বা একাধিক অর্থপূর্ণ ধ্বনির সমষ্টিকে শব্দ বলে।” (পৃ. ৫২)। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞা অনুসারে শব্দ কেবল ধ্বনি দিয়ে তৈরি। শব্দের সঙ্গে অর্থের কোনো যোগ আছে কি না তা ঐ সংজ্ঞা থেকে বোঝার উপায় নেই। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞানুযায়ী শব্দ ধ্বনির সমন্বয়ে তৈরি এমন একক যা একইসঙ্গে অর্থবোধক ও উচ্চারণযোগ্য। উচ্চারণযোগ্য নয় এমন ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি আছে কি? অষ্টম শ্রেণির শেষোক্ত সংজ্ঞানুসারে শব্দ অর্থপূর্ণ ধ্বনির সমষ্টি। ধ্বনি কি অর্থপূর্ণ হয়? হুমায়ুন আজাদ জানিয়েছেন, “এটা একটি গৃহীত সত্য যে, ধ্বনির কোনো অর্থ নেই।” (শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, পৃ. ১০২)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের প্রাগুক্ত সংজ্ঞা আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের শেষোক্ত সংজ্ঞাটি আছে ঐ দুই ব্যাকরণের ‘শব্দগঠন’ শীর্ষক (যথাক্রমে ষষ্ঠ আর পঞ্চম) পরিচ্ছেদে। সংজ্ঞা দেওয়ার পর পরিচ্ছেদ দুটিতে মৌলিক ও সাধিত শব্দের গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, ‘‘মৌলিক শব্দ গঠনের প্রথম উপায় বর্ণের সঙ্গে বর্ণ যোগ।” এছাড়াও, “সরল বর্ণের সঙ্গে ‘কার’ বা ‘ফলা’ যোগ করে শব্দ গঠন করা যায়।” (পৃ. ৪৩)। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেও আছে, “ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে ‘কার’ যোগ করে” এবং “ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে ‘ফলা’ যোগ করে” শব্দগঠন করা যায়। “এগুলো হচ্ছে শব্দগঠনের প্রাথমিক উপায়।” (পৃ. ৫২)। ব্যাকরণ দুটিতে ধ্বনি দিয়ে শব্দ তৈরি হয় একথা যে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে তার ঠিক পরের অনুচ্ছেদেই বর্ণের সঙ্গে বর্ণ আর বর্ণের সঙ্গে কার বা ফলা যোগকে শব্দগঠনের উপায় বলা হয়েছে। ব্যাপারটা বিস্ময়কর।

বিস্ময় জাগানিয়া ব্যাপার আরও আছে বোর্ডের ব্যাকরণগুলোর শব্দগঠন সম্পর্কিত আলোচনায়। যেমন, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের ‘রূপতত্ত্ব’ পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যে,  প্রত্যয়, উপসর্গ আর সমাসের মতো বিভক্তিও শব্দগঠনের ‘ভাষিক উপাদান’ ।(পৃ. ৪০)। কিন্তু ‘বাক্যতত্ত্ব’ পরিচ্ছেদে জানানো হয়েছে, “শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যোগ করলেই পদ তৈরি হয়।”(পৃ. ৪৮)। একই রকম কাণ্ড লক্ষ্য করা যায় অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেও। এই ব্যাকরণে, শব্দ আর পদের পার্থক্যের আলোচনায় আছে, “শব্দে বিভক্তি যুক্ত হলেই তাকে পদ বলা হয়।” (পৃ. ২৫-২৬)। আর, শব্দের গঠন সম্পর্কিত আলোচনায়, ‘শব্দের শেষে বিভক্তি যোগ’-কে ‘শব্দগঠনের নানা উপায়ে’র একটি বলা হয়েছে।(পৃ. ৫৩)। অষ্টম শ্রেণির এই ব্যাকরণ অনুসারে ‘বিভিক্তি যোগ’ ছাড়া আরও যেসব ‘উপায়ে বা প্রক্রিয়ায়’ শব্দ গঠিত হতে পারে সেগুলি হলো — ‘মৌলিক শব্দ যোগে’, ‘শব্দের আগে উপসর্গ যোগ করে’, ‘শব্দের পরে প্রত্যয় যোগ করে’, ‘সন্ধির সাহায্যে’, ‘সমাসের সাহায্যে’ এবং ‘শব্দ দ্বৈতের মাধ্যমে’।(পৃ. ৫২-৫৪)। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে শব্দগঠনের এতো প্রক্রিয়া পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই নেই। ব্যাকরণটিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, “যে কোনো ভাষার শব্দগঠন প্রক্রিয়া দুইটি।” এদুটি হলো — “প্রত্যয়ের সাহায্যে শব্দগঠন” এবং “সমাসের সাহায্যে শব্দগঠন”। উপসর্গ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “উপসর্গ শব্দগঠনের প্রক্রিয়া নয়, উপাদান মাত্র। কারণ, উপসর্গযুক্ত সকল শব্দই সমাস-সাধিত শব্দ; হয় অব্যয়ীভাব সমাস নয় প্রাদি সমাস।” একইভাবে, সন্ধিও “শব্দগঠনের প্রক্রিয়া নয়। কেননা সন্ধিবদ্ধ শব্দ মাত্রই হয় প্রত্যয়-সাধিত শব্দ, নয় সমাস-সাধিত শব্দ।” (পৃ. ৪৪)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে বাংলা শব্দগঠনের প্রক্রিয়া দুটি মাত্র নয়, আরও বেশি। এই ব্যাকরণের ‘শব্দ ও পদের গঠন’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে —  উপসর্গ ও প্রত্যয় দিয়ে তৈরি শব্দকে সাধিত শব্দ বলা হয়। উপসর্গ ও প্রত্যয়  ছাড়া শব্দ গঠনের আরো কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রক্রিয়া হলো সমাস, যার মাধ্যমে একাধিক শব্দ এক শব্দে পরিণত হয়।… এছাড়া কোনো শব্দের দ্বৈত ব্যবহারে নতুন শব্দ গঠিত হলে তাকে বলে শব্দদ্বিত্ব …। (পৃ. ২৬)।
দেখা যাচ্ছে, শব্দ গঠনের উপাদান আর উপায়-প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বোর্ডের ব্যাকরণগুলির লেখক-সম্পাদকেরা একমত নন। আর তা নন বলেই এক ব্যাকরণে যেগুলি শব্দগঠনের ‘উপাদান’, অন্য ব্যাকরণে সেগুলি শব্দগঠনের ‘উপায় বা্ প্রক্রিয়া’, আরেক ব্যাকরণে সেগুলির কোনোটি শব্দগঠনের ‘উপদান’ আর কোনোটি শব্দগঠনের ‘প্রক্রিয়া’।

প্রথাগত ধারার বাংলা ব্যাকরণে সন্ধির আলোচনা থাকেই। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতেও তা আছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে সন্ধির আলোচনা ধ্বনিতত্ত্বের অংশ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে তা অংশ হয়েছে রূপতত্ত্বের। শেষোক্ত ব্যাকরণে সন্ধির সংজ্ঞা দিয়ে  বলা হয়েছে — “পৃথিবীর বহু ভাষায় পাশাপাশি শব্দের একাধিক ধ্বনি নিয়মিতভাবে সন্ধিবদ্ধ হলেও বাংলা ভাষায় তা বিরল।” (পৃ. ৪১)। অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য জানিয়েছেন, বহু নয়, সব মানব ভাষাতেই “সন্ধি আছে, কিন্তু ভারত আর বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশেই সম্ভবত আধুনিক ভাষার ব্যাকরণ-শিক্ষার্থীদের ওপর ‘সন্ধি’ নামক একটি অধ্যায় অকারণে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।” এই চাপিয়ে দেওয়ার কাজটা কোন যুক্তিতে করা হয়েছে? অধ্যাপক ভট্টাচার্য্যের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, যুক্তি এখানে দুটি — “এক সংস্কৃত ব্যাকরণের ঐতিহ্য আর বহুচর্চিত অভ্যাসের অজুহাত।” (বাংলা ব্যাকরণের রূপরেখা, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৬, পৃ. ২৩৬-২৩৭)।দুটি যুক্তিই দুর্বল। হতাশার বিষয় হলো, এরকম দুর্বল যুক্তির ওপর ভর করে, বাংলা ভাষার এক বিরল ব্যাপার সন্ধি বোর্ডের চার ব্যাকরণেই ঢুকে পড়েছে এবং বর্ণিত-ব্যাখ্যাত হয়েছে। প্রসঙ্গত সমাসের কথা বলা যায়। বাংলা ভাষায় সন্ধি বিরল কিন্তু সমাস বিরল নয়। অথচ সমাসের বিবরণ-বিশ্লেষণ বোর্ডের চার ব্যাকরণের একটিতে, শুধু নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে, আছে।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের দুটি ব্যাকরণে, সপ্তম ও নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে, কারক-বিভক্তির বিবরণ মেলে। এই বিবরণ সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে আছে একসঙ্গে, একটি অভিন্ন পরিচ্ছেদে, রূপতত্ত্ব অংশে। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে কারক-বিভক্তির আলোচনা একত্রে করা হয়নি— কারকের আলোচনা করা হয়েছে বাক্যতত্ত্বে আর বিভক্তির আলোচনা করা হয়েছে রপতত্ত্ব অংশে। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে, ‘বিভক্তির প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে দাবি করা হয়েছে, বাংলা বাক্য কারক-প্রধান নয়, বিভক্তি-প্রধান। যুক্তি দেখানো হয়েছে — 
... ক্রিয়াহীন অনেক বাক্য বাংলায় রয়েছে। ক্রিয়া নেই বলে এই বাক্যগুলোর অন্তর্গত নাম শব্দগুলোর কারকও নেই। সে জন্য বলা হয় বাংলা বাক্য কারক প্রধান নয়। কিন্তুবিভক্তি ছাড়া বাংলা বাক্য ঠিকভাবে গঠিত হতে পারে না এবং বাক্যও অর্থগ্রাহ্য হয় না। ... সে জন্য বাংলা বাক্য বিভক্তি-প্রধান। (পৃ. ২৮-২৯)।

এটা ঠিক যে, ক্রিয়াপদের উল্লেখ নেই এমন বাক্য আছে বাংলায়। এটাও কিন্তু ঠিক যে, বিভক্তির উল্লেখ নেই এমন পদও ব্যবহৃত হয় বাংলা বাক্যে। প্রশ্ন হলো, ক্রিয়াপদের উল্লেখ নেই এরকম বাংলা বাক্যের সংখ্যা কি সত্যিই অনেক? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বাংলা কি আসলেই বিভক্তি-প্রধান বা বিভক্তি-বহুল ভাষা? প্রশ্ন দুটির মীমাংসা হওয়া দরকার। প্রথম প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ক্ষেত্রে নবম-দশম শ্রেণির বিগত শিক্ষাবর্ষের (২০২০) ব্যাকরণ আমাদের সাহায্য করতে পারে। এতে বলা হয়েছে —
ক্রিয়াপদ বাক্যগঠনের অপরিহার্য অঙ্গ। ক্রিয়াপদ ভিন্ন কোনো মনোভাবই সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায় না। তবে কখনো কখনো বাক্যে ক্রিয়াপদ উহ্য বা অনুক্ত থাকতে পারে। (বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, শিক্ষাবর্ষ ২০২০, পৃ. ১১২)।

ক্রিয়াপদের উল্লেখহীন বাংলা বাক্য ব্যবহৃত হয় ‘কখনো কখনো’। ক্রিয়াপদ উহ্য রেখে বাংলায় বেশিক্ষণ আলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই কারণে, ‘ক্রিয়াহীন অনেক বাক্য বাংলায় রয়েছে’ — শিক্ষার্থীদের এরকম ধারণা দেওয়া অনুচিত। একইভাবে অনুচিত বাংলা বিভক্তি-প্রধান বা বিভক্তি-বহুল ভাষা এরকম ধারণা দেওয়াও। কারণ, বাংলায় ক্রিয়াপদের উল্লেখ নেই এমন বাক্যের চেয়ে বিভক্তির উল্লেখ নেই এমন পদ যুক্ত বাক্য বহুগুণে বেশি। বিভক্তির উল্লেখ নেই এমন পদের ক্ষেত্রে প্রথাগত ধারার বাংলা ব্যাকরণবিদগণ, সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসরণে, বিভক্তি (শূন্য বিভক্তি) অনুমান করে নেন এবং বাংলাকে সংস্কৃতের মতোই ‘বিভক্তি-প্রধান’ ভাষা বলেন। প্রকৃতপক্ষে, সংস্কৃত ভাষায় পদের বিভক্তিহীনতা “ব্যতিক্রমী ঘটনা” আর “বাংলায় বিভক্তিহীনতাই স্বাভাবিক…।” (পবিত্র সরকার, বাংলা ব্যাকরণ প্রসঙ্গ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ১২৭)। আরও সহজ করে বলতে গেলে, সংস্কৃত “বিভক্তিবহুল” আর বাংলা “বিভক্তিবিরল” ভাষা। (রফিকুল ইসলাম ও পবিত্র সরকার, ‘রূপতত্ত্বের ভূমিকা’, বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যকরণ, প্রথম খণ্ড, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৬২)।

বচন কী? ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে বচন হলো সংখ্যার ধারণা। (পৃ. ৪৩)। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণেও আছে, “বচন অর্থ সংখ্যার ধারণা।” এতে বচনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে, “যে শব্দ দিয়ে ব্যাকরণে কোনো কিছুর সংখ্যার ধারণা প্রকাশ করা হয়, তাকে বচন বলে।” (পৃ. ২৯)। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে, “একের বেশি সংখ্যা বোঝাতে যেসব লগ্নক বিশেষ্য বা সর্বনামের সঙ্গে যুক্ত হয়, সেগুলোকে বচন বলে।” (পৃ. ৭২)। এই সংজ্ঞা আছে ব্যাকরণটির ‘বচন’ পরিচ্ছেদে। ‘শব্দ ও পদের গঠন’ পরিচ্ছেদেও উদাহরণসহ বচনের অনুরূপ সংজ্ঞা পাওয়া যায় — “যেসব শব্দাংশ পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদের সংখ্যা বোঝায়, সেগুলোকে বচন বলে। ‘ছেলেরা’ বা ‘বইগুলো’ পদের ‘রা’ বা ‘গুলো’ হলো বচনের উদাহরণ।” (পৃ. ২৬)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ‘রা’, ‘গুলো’-কে বচন বলা হলেও অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে এগুলিকে বিভক্তি বলা হয়েছে। (পৃ. ৩০)। আর ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে ‘বচনের চিহ্ন’। (পৃ. ৪৩)। (চলবে)

 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ

 

আরো পড়ুুন: পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ: একটি পর্যালোচনা (সূচনা পর্ব)

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়