ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ: একটি পর্যালোচনা (সূচনা পর্ব)

মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৩, ৩১ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৫:৫৪, ৩ এপ্রিল ২০২১
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ: একটি পর্যালোচনা (সূচনা পর্ব)

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ বলতে বর্তমান নিবন্ধে আমরা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ব্যাকরণগুলি বোঝাচ্ছি। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলি রচিত। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত, বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত কয়েকটি ব্যাকরণ বাজারে পাওয়া যায়। এই অনুমোদিত ব্যাকরণগুলি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না, আমরা আলোচনা করছি বোর্ড প্রকাশিত ব্যাকরণগুলি নিয়ে।

এখানে উল্লেখ করা দরকার, মাধ্যমিক স্তরের  শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাকরণের সঙ্গে নির্মিতির নানা প্রসঙ্গ জুড়ে চারটি বই প্রকাশ করেছে বোর্ড। এগুলির মধ্যে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই তিনটির নাম অভিন্ন— ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ আর নবম-দশম শ্রেণির বইটির নাম ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি’। বইগুলির (শিক্ষাবর্ষ ২০২১) প্রথমাংশ অর্থাৎ ব্যাকরণ অংশ আমাদের বর্তমান নিবন্ধের উপজীব্য। আমরা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ চারটির বিভিন্ন অংশের ওপর আলোকপাত করব এবং চেষ্টা করব এগুলিতে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সমাধানের পথ নির্দেশ করার। আমাদের লক্ষ্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করা এবং এই ব্যাকরণগুলি ত্রুটিমুক্ত করার উদ্যোগকে স্বাগত জানানো।

ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ক ধারণা

‘‘ব্যাকরণ রচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ‘ভাষা’ কাকে বলে আর ‘ব্যাকরণ’ কাকে বলে।’’ (শিশির ভট্টাচার্য্য, যা কিছু ব্যাকরণ নয়, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ১৫৩)। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণ পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রথম ব্যাকরণ। কিন্তু প্রথম ব্যাকরণ হলেও এতে ব্যাকরণ কী তা বলা হয়নি। ভাষা কী তা বর্ণিত হয়েছে চার ব্যাকরণেই—  ব্যাকরণগুলির প্রথম পরিচ্ছেদেই। সপ্তম ও অষ্টম  শ্রেণির ব্যাকরণের এই পরিচ্ছেদে ভাষা, বাংলা ভাষা, ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্য, প্রমিত বা মান ভাষা, সাধু ও চলিত রীতির পার্থক্য এসব প্রসঙ্গের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের প্রথম পরিচ্ছেদে প্রাগুক্ত প্রসঙ্গগুলির পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে ভাষার প্রধান তিন (বর্ণভিত্তিক, অক্ষরভিত্তিক ও ভাবাত্মক) লিখন-ব্যবস্থা, প্রকাশমাধ্যম ও ভাষা, ব্যক্তিভাষা, সামাজিক ভাষা, পেশাগগত ভাষা প্রভৃতি বিষয়ও। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, ব্যাকরণের প্রথম পাঠ যারা নিচ্ছে, এতো কিছু তাদের কেন শেখাতে হবে?

বোর্ডের ব্যাকরণগুলির শুরুর দিকে, ভাষার প্রাথমিক পরিচয় সম্পর্কিত আলোচনায়, এমন কিছু তথ্য-বর্ণনা-বক্তব্য স্থান পেয়েছে যেগুলি শিক্ষার্থীদের ভাষাবোধকে আলোকিত করে না বরং বিভ্রান্ত করে। যেমন, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে দাবি করা হয়েছে, ‘‘সাধুরীতির জন্ম হয়েছে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আর চলিতভাষার সৃষ্টি হয় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে।’’ (পৃ. ৭)। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে সাধু রীতির উদ্ভবকাল হিসেবে উনিশ শতককে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের যে লিখিত রূপ গড়ে ওঠে, তার নাম দেওয় হয় সাধু ভাষা।” (পৃ. ৩)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণেও বলা হয়েছে যে, সাধু গদ্যরীতির জন্ম হয় “উনিশ শতকের সূচনায়।” (পৃ. ৫)। প্রকৃতপক্ষে, সাধু কিংবা চলিত রীতির উদ্ভবের সুনির্দিষ্ট সাল-সময় জানা যায় না। এ প্রসঙ্গে দু’জন ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকার ও হুমায়ূন আজাদের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। পবিত্র সরকার জানিয়েছেন, ‘‘বাংলা সাধুভাষা ঊনবিংশ শতাব্দীতে উদ্ভূত হয়েছে, একথা ভ্রান্ত। বস্তুতপক্ষে শিক্ষিত বাঙালি কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই সাধুভাষায় চিঠিপত্র লিখে এসেছে।’’ (মাধ্যমিক ভাষা-সন্ধান, গ্রন্থতীর্থ, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ২৬)।

হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন: ​​​​‘বাঙলা মানভাষা অর্জন প্রক্রিয়ার দুটি পরিণতি হচ্ছে সাধু ও চলিত রীতি;— প্রথমটির বিকাশ ঘটতে থাকে মধ্যযুগ থেকেই, এবং উনিশশতকে লাভ করে সুস্থিত মানরূপ; দ্বিতীয়টিরও ধীর- বিকাশ লক্ষ্যে পড়ে মধ্যযুগ থেকে উনিশশতকব্যাপী; এবং বিশশতকে অর্জন করে নমনীয় সুস্থিতি।’ (বাঙলা ভাষা, প্রথম খণ্ড, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ৮১)।

ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে আদর্শ বা প্রমিত ভাষার পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, “একই ভাষার উপভাষাগুলো অনেক সময় বোধগম্য হয় না। এজন্য একটি উপভাষাকে আদর্শ ধরে সবার বোধগম্য ভাষা হিসেবে তৈরি ভাষারূপই হলো প্রমিত ভাষা।” (পৃ. ৫)। প্রমিত বাংলা কোন উপভাষাকে আদর্শ ধরে তৈরি হয়েছে, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে তা বলা হয়নি, বলা হয়েছে সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে। এতে জানানো হয়েছে, “ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী এলাকা এবং কলকাতার ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষাটিকে অল্প-বিস্তর পরিমার্জিত করে একটি সর্বজনবোধ্য আদর্শ কথ্য ভাষা গড়ে তোলা হয়। এটাই হলো বাংলার আদর্শ চলিত ভাষা।”(পৃ. ৩)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে যে, প্রমিত ভাষা “এই চলিত রীতিরই নতুন নাম।” (পৃ. ৭)। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে প্রমিত রীতি আর চলিত রীতি অভিন্ন নয় বরং ভিন্ন দুই ভাষারীতি। ব্যাকরণটিতে প্রমিত আর চলিত রীতির পৃথক সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, “বিভিন্ন ভাষারীতি কালক্রমে পরিমার্জিত হয়ে” প্রমিত ভাষার রূপ লাভ করেছে আর চলিত ভাষা গড়ে উঠেছে “ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানসমূহের মৌখিক ভাষারীতি মানুষের মুখে মুখে” রূপান্তরিত হয়ে। শুধু সংজ্ঞা নয়, সংজ্ঞার সাথে প্রমিত আর চলিত ভাষারীতির উদাহরণও দেওয়া হয়েছে—
প্রমিত ভাষারীতির উদাহরণ: একজনের দুটো ছেলে ছিল। 
চলিত ভাষারীতির উদাহরণ: একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল। (পৃ. ৪)।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত ব্যাকরণগুলি মূলত প্রথাগত ধারার ব্যাকরণ। এসব ব্যাকরণে, ব্যাকরণ পাঠের আবশ্যকতা সম্বন্ধে বলা হয়, ধারণা দেওয়া হয় ব্যাকরণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে। এক্ষেত্রে সাধারণত দাবি করা হয় যে, ব্যাকরণ আয়ত্ত করলে ভাষা শুদ্ধভাবে লেখা ও বলা সম্ভব হবে। বোর্ডের সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণেও অনুরূপ দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ব্যাকরণ পাঠ করে লেখায় ও কথায় ভাষা প্রয়োগে শুদ্ধতা রক্ষা করা যায়।” (পৃ. ১১)। প্রকৃতপক্ষে, ব্যাকরণ, লিখিত ব্যাকরণ যা বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় তা, লেখার শুদ্ধতা রক্ষায় মোটামুটি কার্যকর হলেও বলার শুদ্ধতা রক্ষায় তেমন কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। পবিত্র সরকার যথার্থই বলেছেন:
‘ব্যাকরণ বই পড়ে কেউ ভাষা বলতে শেখে না, শিখতে পারেও না। বলতে শেখা উক্তি-প্রতিবেশ বা spoken context ছাড়া সম্ভব নয়, ব্যাকরণ তাতে একটু সহায়তা করতে পারে মাত্র। অর্থাৎ ব্যাকরণ একক ও স্বাধীনভাবে, অভিজ্ঞ ও ভাষাদক্ষ শিক্ষক, যান্ত্রিক শ্রবণের সরঞ্জাম, শ্রুতিগম্য সাহিত্য ইত্যাদির সহযোগিতা ছাড়া, ভাষা বলতে শেখাতে পারে না। পারে এই দাবি যে অতিরঞ্জিত দাবি তার প্রমাণ এই যে, এ পর্যন্ত শুধু ব্যাকরণ অর্থাৎ স্কুলের ব্যাকরণ পাঠ করে কেউ মান্য ভাষা বলতে সমর্থ হয়েছেন তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় না।’ (‘স্কুল-পাঠ্য বাংলা ব্যাকরণ : ব্যাধি ও প্রতিকার’, আকাদেমি পত্রিকা, প্রথম সংখ্যা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৩৯৫, পৃ. ৩৯-৪০)।

সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে, ‘ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা’র আলোচনায়, “ব্যাকরণ পাঠের মাধ্যমে ছন্দ-অলংকার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায়” — এমন দাবিও করা হয়েছে। (পৃ. ১১)। এরকম কথা প্রথাগত ধারার অনেক ব্যাকরণেই আছে। তবে তা গ্রহণ-অযোগ্য। কারণ, এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই যে, “ছন্দ ও অলঙ্কার ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় নয়।” (হুমায়ুন আজাদ, শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ১০০)।

ধ্বনি বিষয়ক আলোচনা

ধ্বনি কী, কাকে বলে ধ্বনি? বোর্ডের সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে ধ্বনির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে— “মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে তৈরি আওয়াজকে ধ্বনি বলে।” (পৃ. ১২)। “গলনালি, মুখবিবর, কণ্ঠ, জিভ, তালু, দাঁত, নাক প্রভৃতি প্রত্যঙ্গ দিয়ে… ধ্বনি তৈরি”র কথা নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণেও আছ। (পৃ. ১)। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, “ভাষার ধ্বনি শুধু বাগযন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদিত হলে চলবে না, তাকে অবশ্যই অর্থপূর্ণ হতে হবে।” (পৃ. ৩)। এ বিষয়ে অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের বক্তব্য হলো— “কোনো ভাষার উচ্চারিত শব্দকে বিশ্লেষণ করলে যে উপাদানসমূহ পাওয়া যায় সেগুলোকে পৃথকভাবে ধ্বনি বলে। ধ্বনির সঙ্গে সাধারণত অর্থের সংশ্লিষ্টতা থাকে না। ধ্বনি তৈরি হয় বাগযন্ত্রের সাহায্যে।” (পৃ. ৯)। অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলি থেকে ধ্বনি সম্পর্কে তিন রকমের ধারণা মেলে।

স্বর আর ব্যঞ্জনধ্বনি সম্পর্কেও অভিন্ন ধারণা পাওয়া যায় না বোর্ডের ব্যাকরণগুলি থেকে। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে স্বরধ্বনির যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা এরকম— “যে-বাগধ্বনি উচ্চারণের সময় ফুসফুস-আগত বাতাস মুখের মধ্যে কোনোভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় না সেগুলোই হলো স্বরধ্বনি।” (পৃ. ১৩)। এর সঙ্গে মেলে নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে দেওয়া সংজ্ঞা— “যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে বায়ু মুখগহ্বরের কোথাও বাধা পায় না, সেগুলোকে স্বরধ্বনি বলে।” (পৃ. ১২)। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, “যেসব ধ্বনি অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে পূর্ণ ও স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হয়, তাকে স্বরধ্বনি বলে।” (পৃ. ১৩)। আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে আছে, “যে ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের ভেতরে কোথাও বাধা পায় না এবং যা অন্য ধ্বনির সাহায্য ছাড়া নিজেই সম্পূর্ণরূপে উচ্চারিত হয় তাকে স্বরধ্বনি বলে।” (পৃ. ৯)। ষষ্ঠ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে প্রদত্ত সংজ্ঞা আধুনিক ধ্বনিবিজ্ঞানসম্মত আর সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞা প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে গৃহীত। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞায় প্রাচীন আর আধুনিক ধারণাকে এক জায়গায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে।

ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রেও একই রকম কাজ করা হয়েছে বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতে। ষষ্ঠ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞায় আধুনিক ধ্বনিবিজ্ঞান এবং সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞায় প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকরণের ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞায় যথারীতি এক জায়গায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে প্রাচীন আর আধুনিক ধারণাকে। বলা হয়েছে, “যে ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের ভেতরে কোথাও না কোথাও বাধা পায় এবং যা স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হতে পারে না তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে।” (পৃ. ৯)। এভাবে প্রাচীন আর আধুনিক ধারণাকে সব সময় মেলানো যায় না। ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞার কথাই ধরা যাক। স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারিত হতে পারে না, এরকম কথা কয়েকটি ব্যঞ্জন সম্বন্ধে খাটলেও সব ব্যঞ্জন সম্বন্ধে খাটে না। “মান্য চলিত বাংলার (Standard Colloquial Bengali) র্  , ল্ , শ্ , ঙ্ , ম্ , ন্  ইত্যাদি ব্যঞ্জন স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়াই উচ্চারিত হতে পারে।” (পবিত্র সরকার, পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, পৃ. ৫৩)।

ধ্বনির সংজ্ঞা সম্পর্কে যেমন তেমনি বাংলা মূল ধ্বনির সংখ্যা সম্বন্ধেও বোর্ডের ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকগণ একমত হতে পারেননি। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে প্রদত্ত বিবরণ অনুসারে বাংলা ভাষার মূলত সাঁইত্রিশটি ধ্বনি আছে। এগুলির মধ্যে মূল স্বরধ্বনি সাতটি আর মূল ব্যঞ্জনধ্বনি ত্রিশটি। (পৃ. ১২)। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে এবিষয়ে ভিন্ন রকম তথ্য মেলে। এই ব্যাকরণে ধ্বনির যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তাতে ব্যঞ্জনধ্বনি বাংলায় ত্রিশ নয়, বত্রিশটি। (পৃ. ২৪-২৫)। মতের এই ভিন্নতা অন্তস্থ য় আর অন্তস্থ ব-কে নিয়ে। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে যে-ত্রিশটি ব্যঞ্জনকে মূল ধ্বনি বলা হয়েছে, অন্তস্থ য় আর অন্তস্থ ব-ধ্বনি সেগুলির মধ্যে নেই। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে ঐ ত্রিশটি ব্যঞ্জনের সাথে অন্তস্থ য় আর অন্তস্থ ব-কে যুক্ত করে বত্রিশটি ব্যঞ্জনধ্বনির তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

বোর্ডের চার ব্যাকরণের তিনটিতে — ষষ্ঠ, সপ্তম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে — বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিসমূহের শ্রেণিকরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বিধৃত ধ্বনির শ্রেণিকরণ বিষয়ক আলোচনা অপর দুই ব্যাকরণের তুলনায় গভীর ও ব্যাপক। ব্যাকরণটিতে স্বরধ্বনির শ্রেণিকরণের কাজে জিভের উচ্চতা, জিভের অবস্থান, ঠোঁটের আকৃতি, কোমল তালুর অবস্থা এসব মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়েছে। ধ্বনিবিজ্ঞানে উচ্চারণ দৈর্ঘ্য অনুসারেও স্বরধ্বনি বিচারের রীতি আছে। কিন্তু স্বরের দীর্ঘতা-হ্রস্বতা বাংলা ভাষায় শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটায় না। তাছাড়া, বাংলায় উচ্চারণের দিক থেকেও সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একক স্বরের হ্রস্ব-দীর্ঘ ভেদ নেই। বানানে যা হ্রস্ব তাও বাংলায় কখনো-কখনো দীর্ঘ উচ্চারিত হয়। তাই উচ্চারণ দৈর্ঘ্য বাংলা স্বরধ্বনির শ্রেণিকরণের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে এই মানদণ্ডের কথা উল্লেখের পর “লিখিত ভাষায় যা-ই থাকুক, আমাদের সব স্বরই হ্রস্ব” (পৃ. ১৫) বলে আলোচনা শেষ করা হয়েছে। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে “উচ্চারণের সময়ের তারতম্য” অনুসারে স্বরধ্বনিগুলিকে  হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বর এই দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে — অ, ই, উ, ঋ হলো হ্রস্বস্বর আর আ, ঈ, ঊ, এ, ঐ, ও, ঔ হলো দীর্ঘস্বর। (পৃ. ১৩)। স্বরধ্বনির এরকম শ্রেণিকরণ প্রথাগত সংস্কৃত ব্যাকরণে পাওয়া যায়। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলী তারই অনুসরণ করেছেন।

স্বরধ্বনির মতো ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রেও ষষ্ঠ আর সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে অভিন্ন তত্ত্ব-কৌশল অনুসরণ করা হয়নি। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের ব্যঞ্জনধ্বনির শ্রেণিকরণ সম্বন্ধেও একথা বলা চলে। তত্ত্ব-কৌশল অভিন্ন না হওয়া শ্রেণিকরণও হয়েছে বিভিন্ন রকম। ব্যাপারটা সহজে-সংক্ষেপে বোঝানোর জন্য আমরা বোর্ডের ব্যাকরণ তিনটিতে উচ্চারণস্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জনধ্বনির যে-শ্রেণিকরণ করা হয়েছে তার কথা বলতে পারি। উচ্চারণস্থান বিবেচনায় বাংলা ব্যঞ্জনধ্বনিসমূহকে ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে দ্বি-ওষ্ঠ্য, দন্ত্য, দন্তমূলীয়, প্রতিবেষ্টিত, তালব্য-দন্তমূলীয়, তালব্য, জিহ্বামূলীয় এবং কণ্ঠনালীয় ব্যঞ্জন — এই আট ভাগে (পৃ. ১৭-২০), সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে  ওষ্ঠ্য, দন্ত্য, মূর্ধন্য, তালব্য এবং কণ্ঠ্য বা জিহ্বামূলীয় ব্যঞ্জন — এই পাঁচ ভাগে (পৃ. ১৪-১৫), আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ওষ্ঠ্য, দন্ত্য, দন্তমূলীয়, মূর্ধন্য, তালব্য, কণ্ঠ্য এবং কণ্ঠনালীয় ব্যঞ্জন — এই সাত  ভাগে (পৃ. ১৮-১৯) ভাগ করা হয়েছে।

সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে ট্ ঠ্ ড্ ঢ্ ণ্ র্ ড়্ ঢ়্ ষ্ — এই নয়টি ব্যঞ্জনধ্বনি মূর্ধা থেকে উচ্চারিত হয়। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে নয়টি নয় বরং ছয়টি বাংলা ব্যঞ্জন উচ্চারিত হয় মূর্ধা থেকে । এগুলি হলো — ট্ ঠ্ ড্ ঢ্ ড়্ ঢ়্ । ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে প্রাগুক্ত ধ্বনি ছয়টির চারটি অর্থাৎ ট্ ঠ্ ড্ ঢ্ –কে তালব্য-দন্তমূলীয় আর দুটি অর্থাৎ ড়্ ঢ়্ –কে প্রতিবেষ্টিত ব্যঞ্জন বলা হয়েছে । আবার, সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে ক্ খ্ গ্ ঘ্ এবং ঙ্-এর মতো হ্ ধ্বনিরও উচ্চারণস্থান কণ্ঠ্যনালির উপরিভাগ বা জিহ্বামূল। কিন্তু ষষ্ঠ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ অনুসারে ক্ খ্ গ্ ঘ্ এবং ঙ্-এর উচ্চারণস্থান জিহ্বামূল হলেও হ্ ধ্বনির উচ্চারণস্থান জিহ্বামূল নয়, হ্-এর উচ্চারণস্থান কণ্ঠনালি।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রাগুক্ত ব্যাকরণগুলিতে — ষষ্ঠ, সপ্তম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে — ধ্বনির শ্রেণিকরণের বিবরণে শ্রেণিগুলির সংজ্ঞাও পাওয় যায়। তবে সব ক্ষেত্রে অভিন্ন সংজ্ঞা মেলে না। কোনো কোনো শ্রেণির সংজ্ঞা তিন ব্যাকরণে তিন রকম। যেমন ঘোষ আর অঘোষ ব্যঞ্জনধ্বনির সংজ্ঞা। ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, “কিছু ব্যঞ্জন উচ্চারণে স্বরতন্ত্র কম্পিত হয়। এগুলো হলো ঘোষ ব্যঞ্জন আর যেগুলোর উচ্চারণে স্বরতন্ত্র কম্পিত হয় না, সেগুলো হলো অঘোষ ব্যঞ্জন।” (পৃ. ২৩)। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে আছে, “যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ধ্বনিদ্বারের কম্পন অপেক্ষাকৃত বেশি, সেসব ধ্বনিকে বলা হয় ঘোষ ধ্বনি।” আর, “যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ধ্বনিদ্বারের কম্পন অপেক্ষাকৃত কম, সেসব ধ্বনিকে বলা হয় অঘোষ ধ্বনি।” (পৃ. ২১)।

সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, যেসব ধ্বনির উচ্চারণকালে “আঘাতজনিত ঘোষ বা শব্দ সৃষ্টি হয় না” সেগুলি অঘোষ আর যেসব ধ্বনির উচ্চারণকালে “আঘাতজনিত ঘোষ বা শব্দ সৃষ্টি হয়” সেগুলি ঘোষধ্বনি। (পৃ. ১৫-১৬)। ষষ্ঠ আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের সংজ্ঞা অভিন্ন না হলেও, স্বরতন্ত্র বা ধ্বনিদ্বারের কথা আছে দুটিতেই। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণে সেরকম কিছু নেই, আছে আঘাতজনিত শব্দ হওয়া না হওয়ার প্রসঙ্গ। কিন্তু কিসের আঘাত, কোথায় আঘাত তার উল্লেখ নেই।    

অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ(‘ধ্বনি ও বর্ণ’ শীর্ষক)-এর দুটি অংশের শিরোনাম এরকম — ‘বর্ণের উচ্চারণ-স্থান’ ও ‘বর্ণের উচ্চারণ প্রকৃতি’। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের একটি পুরো পরিচ্ছেদেরই শিরোনাম ‘বর্ণের উচ্চারণ’ (৮ সংখ্যক পরিচ্ছেদ)।প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ বর্ণ উচ্চারণ করে না ধ্বনি উচ্চারণ করে? নিঃসন্দেহে ধ্বনিই উচ্চারণ করে মানুষ। অষ্টম আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের উল্লিখিত স্থানগুলিতে ‘বর্ণ’ কথাটি আসলে ‘ধ্বনি’ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথাগত ধারার অনেক বাংলা ব্যাকরণে এমনটা লক্ষ্য করা যায়। এসব ব্যাকরণের প্রণেতা-রচয়িতাগণ প্রায়ই ‘বর্ণ’ শব্দ দিয়ে ‘ধ্বনি’ বোঝান। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই কাজটা করেন তারা। পবিত্র সরকারের ভাষায়— ‘‘এই ভ্রান্তি ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইয়োরোপে চলেছে, সেখানকার তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীরা letter বলতেই ধ্বনি বুঝিয়েছেন। পরে আধুনিক ধ্বনিবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে এই বোধ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, letter হল ধ্বনিটির লিখিত প্রতীক-রূপ মাত্র, আসল ধ্বনিটি উচ্চারিত বায়ুকম্পনসমষ্টি।” (পবিত্র সরকারের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, পৃ. ৫১)।

ইয়োরোপে letter শব্দটি ধ্বনি অর্থে এখন আর ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে প্রথাগত ধারার অনেক ব্যাকরণে, এমন কি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণেও, ধ্বনি বোঝাতে বর্ণ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। (চলবে)


লেখক পরিচিতি: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ
 

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব: পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ : একটি পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব)

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়