ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

দোলনায় স্বপ্নাদের স্বপ্ন

রফিক সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩১, ৫ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৩:৪৯, ৫ নভেম্বর ২০২১

‘বির্তুল’ গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের একটি গ্রাম। ওই গ্রামের বাসিন্দা স্বপ্না বেগম (৬০)। কিশোরী বয়স থেকেই স্বামীর সংসার শুরু করেন তিনি। ৫ মেয়ে আর ৩ ছেলে নিয়ে তার পরিবার। ভালোই চলছিল জীবন। কিন্তু হঠাৎ স্বামী মারা যাওয়ায় পড়ে যান বিপাকে।

সংসারের হাল ও সন্তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে শুরু করেন সুতা, রঙ ও বাঁশ দিয়ে দোলনা, শিকেসহ গৃহস্থালী নানা পণ্য তৈরির কাজ। আর এই দোলনাতেই স্বপ্ন বোনেন স্বপ্না। শুধু স্বপ্না নয়, তার মতো এই দোলনাকে ঘিরে হাজারো স্বপ্ন দেখেন একই ইউনিয়নের ধনুন গ্রামের রেনু বেগম (৭৫), ফজিলা বেগম (৫০), বাগদী গ্রামের উর্মি বেগম (৩৫), লতিফা বেগম (৪০), গাড়ারিয়া গ্রামের শাহনাজ বেগম (৪৫) ও বিন্দান গ্রামের শাহানা আক্তার (৫৫)। দোলনাকে ঘিরে তাদের এত স্বপ্ন থাকলেও বর্তমানে বেশি ভালো নেই তারা। সুতা, রঙ, বাঁশ ও এই শিল্প সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকটা বিপাকে পড়েছেন এই শিল্পীরা।  

জানা গেছে, উপজেলার নাগরী ইউনিয়নটি নানা কারণেই ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এলাকাটিকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। গ্রামগুলোকে দোলনার গ্রামই বলা হয়ে থাকে। এখানে প্রায় ৩ শতাধিক নারী-পুরুষ এই পেশায় জড়িত। ওই গ্রামগুলোর তৈরি দোলনা দেশের অভিজাত শ্রেণির ঘরে আদরণীয় সামগ্রী হিসেবে গণ্য হচ্ছে। নামিদামি মার্কেটগুলোতেও শোভা পাচ্ছে। অপরূপ বুনন কৌশল আর বাহারি কারুকাজের কারণে কোনো কোনো উদ্যোক্তা বিদেশেও পাঠাচ্ছেন।

বাগদী উত্তরপাড়া গ্রামের কারিগর পারভীন আক্তার (৪৫) জানান, করোনার কারণে তারা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে, ঘুরে দাঁড়াতে যারপর নেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগে সুতা, রঙ ও বাঁশের দাম ছিল কম, এখন এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সব জিনিসের দাম বেশি। তাদের যে মূলধন, তা দিয়ে ঐতিহ্যের এই পেশাকে চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই শিল্পের জন্য সরকার যদি কোনো প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেন, তাহলে পেশাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে জানান তিনি।

একই গ্রামের শাহিনুর বেগম (৩৫) বলেন, দুই ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে খুবই কষ্টে জীবনযাপন করছি। করোনার আগে নিজ উদ্যোগে দোলনা তৈরিক ব্যবসা করতাম। কিন্তু করোনাকালীন সময় দেশের পরিস্থিতির কারণে এই ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সহযোগিতা পেলে আবার ভালোভাবে শুরু করবো।

দোলনা ব্যবসায়ী আইয়ূবুর রহমান (৪২) বলেন, আগে এই দোলনার ব্যবসা করে কারিগরদের নিয়মিত মজুরি দিতে পারতাম। কিন্তু ২/৩ মাস ধরে সেটা পারছি না। তবে, এটা খুবই সম্ভাবনাময় পেশা। করোনার আগে অনেক লাভ হতো, এখন সেটা তেমন করতে পারছি না।

আরেকজন ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন মির্জা (৫০)। তিনি জানান, তাদের তৈরি দোলনা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে রাজধানী ঢাকাসহ বগুড়া, নওগাঁ, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রাইকারি দোকানগুলোতে নিয়মিত সরবরাহ করা হয়। পাইকারির চেয়ে খুচরা মূল্যে বিক্রি করলে তাদের বেশি মুনাফা হয়। তবে স্থানীয়ভাবে হাতে তৈরি এই দোলনার জন্য একটি বাজার সৃষ্টির জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।

ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন জানান, একসময় দাপটের সাথে চালিয়ে নিলেও এ শিল্প সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে ভালো নেই দোলনার কারিগররা। করোনা তাদের একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে। তবে সম্ভাবনাময় শিল্প টিকিয়ে রাখতে তিনি সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করছেন। একই কথা বলেন দোলনার কারিগর আলমগীর হোসেন (৪৮)।   

বাগদী গ্রামে দোলনা কিনতে আসেন আবুল হাসনাত (৩৫)। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, সরাসরি দোলনার গ্রাম থেকে দোলনা কিনলে বাজারের তুলানায় একটু কম দামে কেনা যায়। তাছাড়া অনেক দোলনা থেকে ভালোটা বেছে নেওয়া যায়। তবে আগের মতো এখানে জৌলুশ নেই বলেও জানান তিনি।   

জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শিবলী সাদিক বলেন, নাগরী কৃষিপ্রধান এলাকা হলেও দোলনার সাফল্য ও সম্ভাবনার কারণে অনেকেই এই শিল্পের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে বিষয়টি জেনেছি। আশা করছি সমাধান হবে।

তাদের ক্ষতিটাকে পুশিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয়ভাবে সমিতি গঠন, ক্ষুদ্র ঋণ এবং বাজার সৃষ্টির আশ্বাস দিলেন উপজেলার এই নির্বাহী কর্মকর্তা।

/মাহি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়