ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মান্না দের সেই কফি হাউজে ৩০ মিনিট

রবিউল মিলটন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ১ জানুয়ারি ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মান্না দের সেই কফি হাউজে ৩০ মিনিট

মান্না দের সেই কফি হাউজে মিল্টন আহমেদ

মিল্টন আহমেদ
কলকাতা থেকে, ১ জানুয়ারি: কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই।

সেই সোনালি বিকেল হয়তো এখন আর নেই। কিন্তু কফি হাউজের সেই আড্ডাটার রেশ আজও আছে। কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দের সাড়া-জাগানো সেই  গান যে কফি হাউজকে ঘিরে, সেই হাউজে আমরা নিলাম কফির স্বাদ। চোখ ভরে দেখলাম স্বপ্নের কফিহাউজ। আমরা তিনজন। মধ্য কলকাতার যে হোটেলটিতে আমাদের আবাস, সেখান থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরেই কালের সাক্ষী সেই কফি হাউজ। যুগে যুগে যা ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে।  

তিন দিন ধরেই কফি হাউজে একবার ঢু মারার সুযোগ খুঁজছিলাম। কাজের চাপে সুযোগ করে উঠতে পারিনি। সেই সুযোগটাও অবশেষে পেয়ে গেলাম গতকাল মঙ্গলবার।  

সঙ্গে আমাদের দলের বড় ভাই জাকারিয়া কিরন আর সম্রাট। তিনজন মিলে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বের হলাম ঘুরতে। আমাদের সোজা গন্তব্য কফি হাউজ। কফি হাউজ নিয়ে মান্না দের সাড়া-জাগানো সেই গানটি যেন আমাদের তখন নাড়া দিচ্ছিল। হৃদয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল।
চলতে চলতে মনে হচ্ছিল, আমরাও যেন ইতিহাসকে ছুঁতে চলেছি। আমরা তখন অন্য অনভূতিতে মগ্ন। এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।  

কফি হাউজটির পুরো নাম ইন্ডিয়ান কফি হাউজ। আমরা যখন ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যা সাতটার কাছাকাছি। শীতের সময় বলে তখন রাতের আবহ সৃষ্টি হয়েছে। পায়ে হেঁটে অনেক মানুষ ফিরছে ঘরে। একটি বড় ভবনের দ্বিতীয় আর তৃতীয় তলা ঘিরে কফি হাউজ। অনেক বড় জায়গাজুড়ে এটির অবস্থান। ঝকঝকে তকতকে সবকিছু। শীতের সন্ধ্যায়  ভিড়টা তখন বেশি।  ঢুকেই আমাদের অপেক্ষা করতে  হলো বেশ কিছুক্ষণ। পরে বসার জায়গা জুটল। পুরো ফ্লোরেই মাঝারি আকারের সব টেবিল। টেবিল ঘিরে চারটি করে বসার চেয়ার।

এখানে শুধু কফিই নয়, নানা রকমের ফাস্টফুডও মেলে।  আমরা তিনজন শুধু কফি দিতে বললাম। তারপর অপেক্ষার পালা। কফি হাউজে কফি পান করতে পারার সুযোগ আমাদের তখন রোমাঞ্চিত করছিল।

কফি হাউজটা সব সময় সরগরম থাকে আগতদের ভিড়ে। সন্ধ্যাটাতে ঠাসা ভিড়। কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। কেউ কফি পান করছেন, সঙ্গে সিগারেট। কেউ বা শুধুই কফি। ফাস্টফুডও খাচ্ছেন অনেকেই। আমরা ছিলাম ৩০ মিনিটের মতো। পুরোটা সময়ই দেখলাম, গরম কফির উষ্ণ হাওয়ায় যেন পূর্ণ কফি হাউজ।

খাবার মেন্যু লিস্টেই স্পষ্ট করে লেখা আছে, ১৯৫৫ সালে কফি হাউজ চালু হয়। হিসাব করলে এটির বয়স দাঁড়ায় ৫৫ বছর। সময়টা দীর্ঘ। বয়স বাড়লেও এটির ব্যস্ততা যেন একটুও কমেনি। জৌলুস কমেনি একটুও। মনে হলো বাঙালির শহর কলকাতার বয়সের সঙ্গে কফি হাউজেরও বেড়ে ওঠার অনেক মিল। কফির চাহিদা যেন একটুও কমেনি। মানুষ ছুটে আসে এখানে শুধুই কি এক পেয়ালা  গরম কফি পানের আশায়? নাকি কফি হাউজে আসার পেছনে রয়েছে ভিন্ন কোনো অনুভূতি? উত্তরটা তাদেরই জানা যারা এখানে আসেন।   

সাড়া-জাগানো ‘কফি হাউজের’ গানের স্রষ্টা কিংবদন্তির শিল্পী মান্না দে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন এই সেদিন। কিন্তু কফি হাউজকে ঘিরে বহমান বাঙালির আবেগে কি কখনো ভাটা পড়বে- এই প্রশ্ন ঘুরেফিরেই আমাদের নাড়া দেয়। এখন মান্না দের স্মরণে  কফি হাউজে চলছে স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচি। অনেকেই রক্ত  দিচ্ছেন আর্তমানবতার সেবায়।  মান্না দে-কে কতটা ভালোবাসে কলকাতার মানুষ, তা সহজেই টের পাওয়া যায়, শহরজুড়ে তার বিশাল বিশাল ছবি দেখে। সেগুলো জানান দেয় বাঙালির হৃদয়ে মান্না দের জায়গাটা অন্য কেউ দখল করতে পারেনি এখনো। শ্রেণিবিচারে সব মানুষের আবেগের জায়গাটা এখনো মান্না দে-কে ঘিরে, এখনো কফি হাউজকে ঘিরেই বয়ে যাচ্ছে।

আমরা যখন কফি হাউজে ঢুকি, তখন দেখি, একটি টেবিল ঘিরে লোকজনের কিছুটা জটলা। কাছে গিয়ে দেখি, নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন স্বয়ং সেখানে উপস্থিত। তাকে ঘিরেই অন্যদের আগ্রহের জটলাটা বেশি। কয়েকজন পুলিশ তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত। সবার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি হাসিমুখে। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের নারী রিপোর্টার নিচ্ছেন তার সাক্ষাৎকার। জানলাম, অমর্ত্য সেন কলকাতায় এলে কফি হাউজে একবার আসেন। শুধুই কি কফি পান করতে আসেন, নাকি কফি হাউজ ঘিরে বহমান বাঙালির আবেগ তাকেও এখানে টেনে আনে?

আমাদের টেবিলে যিনি কফি পরিবেশন করলেন, তার কাছ থেকেই  জানতে পারলাম, প্রতিদিন কফি হাউজে আসেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক-কবি-প্রাবন্ধিক-লেখকসহ সব শ্রেণীর বিখ্যাত লোকজন। কফি পানের পাশাপাশি আড্ডায় মেতে থাকেন সারা দিন।  

কফি হাউজের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি বড় বড় ছবি দেখলাম। সুন্দর করে দেয়ালে ঝোলানো। চেনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চিনতে পারিনি।  ছবিগুলির মধ্যে একটিমাত্র মেয়ের ছবি। অনুমান করলাম, হয়তো ইনিই মান্না দের গানের  সেই সুজাতা।  গানের বাকি চরিত্রগুলোর ছবিও আছে দেয়ালে। এখনো অমলিন সবকিছু।  

আগের দিন কলকাতার বই বাজারের কথা লিখেছিলাম। এশিয়ার বড় বইয়ের বাজার এটি। বিশ্বাস করার কারণ আছে। অন্তত বই আর বইপ্রেমীর ভিড় দেখে তা মানতেই হবে। এই বাজারের মাঝামাঝি কফি হাউজের অবস্থান। বইপ্রেমী মানুষ এখানে আসেন বেশি। তারা কেউ শিক্ষার্থী কেউ শিক্ষক কেউ  সাহিত্যিক। তাদের কারণেই কফি হাউজে প্রতিদিনই একই দৃশ্য একই হুল্লোড়। তারা একবার ঢু মেরে যান এই হাউজে।

কলকাতার কফি হাউজ আর ঢাকায় আমাদের মধুর ক্যান্টিনের মধ্যে যেন কোথায় একটু মিল আছে। মধু ক্যান্টিনের স্মৃতি আমাদের অনেক গাঢ়। আর কফি হাউজের স্মৃতিও জমা হলো মানসপটে।   
কফি হাউজ আমাকেও কত আবেগতাড়িত করেছে। মান্না দের গানের সেই কফি হাউজ।  মান্না দে এখন নেই। কিন্তু তার প্রতি আর তার গানের প্রতি ভক্তকুলের অগাধ ভালোবাসা দেখে আমরা  অভিভূত হলাম। কফি হাউজ যতদিন থাকবে, মান্না দের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসার স্রোত চিরকালই বহমান থাকবে- এই আশা করতে তো কোনো দোষ নেই।


রাইজিংবিডি/মিল্টন আহমেদ/আনু মোস্তফা/কমল কর্মকার    

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়