ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

রওশনের কাছে যাননি, এরশাদের চেয়ার দখল!

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ২৩ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রওশনের কাছে যাননি, এরশাদের চেয়ার দখল!

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। দলের মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ সম্মানী ব্যক্তি। কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পর এখনো দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের সঙ্গে দেখা করতে যাননি জিএম কাদের।

জাপা নেতাদের অভিযোগ, ২৮ ডিসেম্বর দলের কাউন্সিলে জাপার চেয়ারম্যান হওয়ার ২৫দিনেও মাতৃতুল্য প্রধান পৃষ্ঠপোষকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেননি নতুন চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

শুধু তাই নয়, এরশাদের স্ত্রী হিসেবে এরশাদের বনানী অফিসে যে রুমটিতে মাঝে মাঝে এরশাদের সঙ্গে রওশন বসতেন সেটিও তিনি নিজের জন্য ভিআইপি রুম বানিয়ে ফেলেছেন। বরং বনানী আর কাকরাইলের অফিসে যে চেয়ারে এরশাদ বসতেন, ওই রুমে-ওই চেয়ারে বসেই অফিস করছেন জিএম কাদের। বিষয়টিকে প্রয়াত চেয়ারম্যানের প্রতি অসম্মান ও দৃষ্টিকটু বলছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

দলের নতুন চেয়ারম্যানের এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তারা যেমন ক্ষুদ্ধ, তেমনি অসন্তুষ্ট দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। এ কারণে দলের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে বলে জানিয়েছেন একাধিক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।

জাপার জ্যেষ্ঠনেতা ও সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, ‘ম্যাডামের সঙ্গে উনার (কাদের) দেখা করা উচিত ছিল। স্যারের চেয়ারে বসাও ঠিক হয়নি। কারণ, পার্টির চেয়ারম্যান আমাদের আবেগ-অনুভূতি। তার রুমে, তার চেয়ারে বসা দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছে।’

গত ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয় পার্টির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। প্রধান পৃষ্ঠপোষক করার কথা জেনে রাগে সম্মেলনে আসেননি রওশন। তার মতামত ছাড়াই তাকে কাউন্সিলে এ পদ দেয়া হয়।

নেতাকর্মীরা মনে করেছিলেন, চেয়ারম্যান হয়েই জিএম কাদের মাতৃতুল্য ভাবীর বাসায় ছুটে যাবেন। রাগ ভাঙ্গিয়ে ভাবীর দোয়া নেবেন। কাউন্সিলের ২৫ দিন পার হতে চলেছে কিন্তু এখনো তিনি রওশন এরশাদের কাছে যাননি। সালাম দেয়া তো দূরে তার কোনো খবরাখবরই নিচ্ছেন না।

এ বিষয়ে কথা বলতে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘উনি অসুস্থ, বাসা আর হাসপাতাল ছাড়া তেমন কোথাও যান না। শুধু সংসদে যান।’

দলে সক্রিয় নয় কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাকে জিজ্ঞেস করুন, দলের নিষ্ক্রিয় কেন সেটা তিনি ভাল জানেন।’ পদ-পদবি নিয়ে রওশন অসন্তুষ্ট নন বলেও দাবি করেন রাঙ্গা।

রওশনপন্থী নেতাদের অভিযোগ, এরশাদের স্ত্রী হিসেবে রওশন এরশাদকে এমনিতেই নামমাত্র প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে জাতীয় পার্টিতে কর্তৃত্বহীন করা হয়েছে। তারমধ্যে চেয়ারম্যান হয়ে ভাবীর কাছে না গিয়ে ঠিক কাজ করেননি জিএম কাদের। এভাবে পার্টি ও পদ-পদবি নিয়ে রওশনের যে ক্ষোভ, সেটাকে আরো উস্কে দেয়া হয়েছে।

জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, ‘কাউন্সিলের পরেই ম্যাডামের কাছে চেয়ারম্যানের যাওয়া উচিত ছিল। এতে বয়োজ্যেষ্ঠের প্রতি সম্মান দেখানো হতো। তাছাড়া প্রেসিডিয়ামের সর্বশেষ সভায় তাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলেও তা পাস হয়েছে। তার পরামর্শেই পার্টি পরিচালিত করা উচিত। এতে দলের জন্য মঙ্গল হবে।’

রওশনপন্থী দলের এক সিনিয়র নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘জিএম কাদেরের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ম্যাডাম তার উপর অসন্তুষ্ট। এরশাদের স্ত্রী হিসেবে, দলের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে ম্যাডামের পরামর্শে দল পরিচালনা করার কথা। দলের সর্বশেষ প্রেসিডিয়াম সভায় রওশনকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করার কথা যখন প্রস্তাব পাস করা হয়, তখন বৈঠক শেষে দলের মহাসচিব রাঙ্গা বলেছিলেন, বিরোধী দলের নেতা জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হবেন, তিনি পার্টির সর্বোচ্চ সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে পতাকা ব্যবহার করবেন। তার পরামর্শ নিয়ে জাতীয় পার্টি পরিচালিত হবে।’

‘কিন্ত বাস্তবে তার উল্টো। পার্টির চেয়ারম্যান পরামর্শ নেয়া তো দূরে, ম্যাডামের কোনো কথাই শুনছেন না। তিনি (ম্যাডাম) বাদ পড়া কিছু নেতাকে পদায়ন করেছিলেন, গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে চেয়ারম্যান সেটা আমলে নেননি। বরং অসুস্থতাসহ ম্যাডামের নামে নানা মিথ্যাচার করা হচ্ছে। অথচ ম্যাডাম সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। সংসদে বিরোধী দলর নেতা হিসেবে নিয়মিত সংসদে যাচ্ছেন। তাছাড়া বনানী অফিসে স্যারের রুম ও চেয়ারের পাশাপাশি ম্যাডামের রুম দখল করে নেয়া হয়েছে। এসব কারণে ম্যাডাম পার্টির চেয়ারম্যানের উপর চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন।’

প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বনানীর অফিসে নিয়মিত বসে দলীয় কার্যক্রম চালাতেন। বনানী অফিসের দ্বিতীয় তলা যেখানে এরশাদ বসতেন, ওই অফিসে ও তার পাশে গেস্টরুমে এরশাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বসতেন স্ত্রী রওশন। আর কো চেয়ারম্যান হিসেবে দ্বিতীয় তলায় একেবারে শেষ রুমে বসতেন কাদের। এরশাদের মৃত্যুর পর তার দুটি রুমই বেদখল হয়ে যায়। এরশাদের রুমে এরশাদের চেয়ারে বসেই অফিস করা শুরু করেন জিএম কাদের। পাশের রুমে যেটিতে মাঝে মাঝে রওশন বসতেন সেটি এখন তার ভিআইপি রুম করে ফেলা হয়েছে। বরং তিনি যে রুমে বসতেন সেটিতে বসানো হয়েছে দলীয় নেতা ভাগ্নে জামাই জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলুকে।

দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হলেও রওশন এরশাদের জন্য কোন রুমই রাখা হয়নি এরশাদের বনানী অফিসে। দলের কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অবস্থাও তাই। এই অফিসেও রওশনের জন্য আলাদা কোন রুম নেই। কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এরশাদ যে রুমে বসতেন, তার পাশেই আলাদা রুম ছিল জিএম কাদেরের। কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পর নিজের রুম ছেড়ে এরশাদের রুমে চলে এসেছেন জিএম কাদের। এরশাদের চেয়ারটিও দখলে নিয়েছেন তিনি। প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ, এমনকি দলের সিনিয়র কো চেয়ারম্যানদের জন্য কোন রুম রাখা না হলেও কী কারনে বাবলুকে রুম দেয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, এরশাদের চেয়ারে বসা অবশ্যই আদবের বরখেলাপ। আমি দাবি করব কাকরাইলের স্থায়ী কার্যালয়ে স্যারের রুমটা যেন মিউজিয়াম করা হয়। সেখানে স্যারের সব স্মৃতি যাতে সংরক্ষণ করা যায়।

পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদের রুম ও চেয়ারে জিএম কাদেরের বসা দৃষ্টিকটু কিনা- এ প্রশ্নে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, দৃস্টিকটু হবে কেন? চেয়ারম্যান ‍যিনি হবেন তিনি তো সেখানেই বসবেন। জিএম কাদেরও বসছেন। প্রধানমন্ত্রী যে হন তিনি তো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারেই বসেন। আসলে দলের কিছু নেতার কোন কাজ নেই, কমিটি থেকে বাদ পড়ে তারা জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।

এরশাদের চেয়ারে বসা নিয়ে নেতাদের অভিযোগ প্রসঙ্গে মহাসচিব বলেন, বনানী অফিসে স্যারের চেয়ার সরিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু নেতারা বলছেন বনানী ও কাকরাইলের অফিসে এরশাদের রুমে এরশাদের চেয়ারেই অফিস করছেন জিএম কাদের।

এরশাদের রুমকে মিউজিয়াম করা হোক-নেতাদের এমন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, রংপুরে মিউজিয়াম করা হবে সেখানে দরকার হলে তার চেয়ারসহ সবকিছুই নিয়ে যাওয়া হবে।

 

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সনি

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়