ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘আবারও প্রমাণ করলাম, বাঙালি সব পারে’

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ১০ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ২৩:০৩, ১০ ডিসেম্বর ২০২০
‘আবারও প্রমাণ করলাম, বাঙালি সব পারে’

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ। ১০ ডিসেম্বর সেতুর সর্বশেষ (৪১তম) স্প্যান বসানো সম্পন্ন হয়েছে। এখন দৃশ্যমান ৬ কিলোমিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যের স্বপ্নের সেতু। স্টিল ও কংক্রিটে নির্মিত দুই স্তর বিশিষ্ট ব্রিজের ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে সিঙ্গেল লাইনের রেলপথ থাকবে।

১৫০ মিটার দৈর্ঘ‌্যের ৪১টি স্প‌্যান বসেছে এই সেতুতে। সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার বা ৫৪.৩ ফুট।

এই সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। বৃহৎ এ প্রকল্পটি তিনটি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে—মুন্সীগঞ্জ (মাওয়া পয়েন্ট), শরীয়তপুর আর মাদারীপুর। পদ্মা সেতু চালু হলে প্রায় ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার বা ১৭ হাজার বর্গমাইল এবং বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে ৩ কোটিরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। ফলে প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর’ নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। মূল প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেতুর সঙ্গে সেতুর নকশায় রেলপথ সংযুক্ত করে। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে প্রকল্প সংশোধন না করে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু তৈরির জন্য অধিগ্রহণ করা জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর।  

এই মেগা প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের কথা থাকলেও প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে সংস্থাটি।  অন্যান্য দাতা গোষ্ঠীও বিশ্বব্যাংকের পথ অনুসরণ করে। দুর্নীতির অভিযোগ পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কানাডিয়ান আদালত দুর্নীতির মামলাটি বাতিল করে। এখন বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

বাংলাদেশের বৃহৎ এই বহুমুখী সেতুর প্রাথমিক কাজ শেষ। আর কিছুদিন পর এই সেতু দিয়ে পার হবেন হাজার হাজার মানুষ। বর্তমানে ফেরি বা স্পিড বোটে করে প্রতি সপ্তাহে ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড়ি দেন ডা. জি এম ফরিদ। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। তিনি বলেন, ‘এটা যে জাতি হিসাবে আমাদের কত বড় অর্জন! শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমরা আবারও প্রমাণ করলাম, বাঙালি সব পারে। আর মাত্র ক’টা দিন। তারপর বাড়ি আসব, এই সেতুর ওপর দিয়ে—ভাবতেই শিহরিত হচ্ছি।’

পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরু থেকে প্রতিটি পিলার ও স্প্যান বসানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে দর্শকদের আপডেট জানিয়ে আসছিলেন গণমাধ্যমকর্মী এহসান জুয়েল। সর্বশেষ (৪১তম) স্প্যান বসানো শেষে তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘যখন সেতুর কাজটা শুরু হয়, আমরা দেখানো শুরু করি। তখন এই কাজটা নিয়ে অনেক সমস্যা ছিল। কাজটা শেষ পর্যন্ত হবে কি না, এমন অনিশ্চয়তাও ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। আমরা নিয়মিত দেখানোর কারণে মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে আশা জাগতে থাকে। সে আস্থাটা আমরা তৈরি করতে পেরেছিলাম। আস্তে আস্তে মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগে, বাংলাদেশ পারবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে এরকম একটা বড় প্রকল্প করার মতো সামর্থ‌্য আমাদের আছে। এটা গণমাধ্যমেরও একটা অর্জন যে, তারা নিয়মিত আপডেট জানিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছে।’

গৃহিনী সুলতানা শিপলু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, ‘আগে বাড়ি যেতে ফেরি ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে। এখন আর অপেক্ষা করতে হবে না। খুব গর্ব হচ্ছে যে, আমাদেরও এরকম একটা সেতু আছে। সেটাও নিজেদের টাকায় করা।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির সময়ে এসে এমন একটা অর্জনে ভীষণ খুশি আমি। অনেক বাধা-বিপত্তির পরও কেবল বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবিচল মনোভাবের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। তাও নিজেদের টাকায়। আমরা যে হার না মানা জাতি, সেটা তো আমরা ১৯৭১ সালেই প্রমাণ করেছি। আবারও সেটা প্রমাণিত হলো।’     

পদ্মা সেতু প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী আহসান উল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘এমন বিরাট একটা কাজের সাথে থাকতে পেরে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আজ ৪১তম স্প্যান বসানোর পর সেতুর বিরাট একটা অংশের কাজ শেষ হয়েছে। এরপর বসানো হবে সড়ক ও রেলপথের বাকি স্ল্যাবগুলো। কবে সেতু দিয়ে গাড়ি চলবে, ট্রেন চলবে, সেই অপেক্ষা আর উত্তেজনায় আছি।’

ঢাকা/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়