ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

‘ক্ষুধার্ত নদী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে’

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ১৩ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৬:২৫, ১৩ মার্চ ২০২১
‘ক্ষুধার্ত নদী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে’

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়িগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার বেদকাশি গ্রামের ছবি

‘ক্ষুধার্ত নদী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমাদের বাড়িগুলো ধীরে ধীরে ডুবছে। আমরা পেছনে সরে আসছি। এক বছর আগেও যেখানে ছিল রাস্তা, ঘরবাড়ি, এখন সেখানে ৮০ ফুট পানি! সাইক্লোন আম্পানের আঘাতের পর এখানে দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে।’ বলছিলেন খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামের ফকিরকোণার বাসিন্দা আকবর হোসেন মোড়ল (৬৫)।

আকবর হোসেন এই এলাকার স্থায়ী এবং পুরনো বাসিন্দা। সুন্দরবনকেন্দ্রিক জীবিকা তার। তবে এক সময়  এলাকাতেই কৃষিকাজ করতেন। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা তার জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। এলাকার অনেক পরিবর্তনের নীরব সাক্ষী তিনি। বাড়িঘর, বড় বড় গাছপালা, ক্ষেত ভরা ফসল- এখনও তার চোখে ভাসে। কালাবগি বাজার কিংবা সুতারখালী ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত নলিয়ান বাজার থেকে সড়কপথে যাতায়াত করতেন ফকিরকোণা এলাকার মানুষ। কিন্তু এখন দীর্ঘ নদী পার হয়ে তাদের ওপারে যেতে হয়।

সুতারখালী ইউনিয়নের দক্ষিণে নতুন বেড়িবাঁধের বাইরে চোখে পড়ে অসংখ্য ঝুলন্ত বাড়ি। এর কিছু অংশ সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায়, কিছু অংশ পড়েছে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। জোয়ারের পানি থেকে বাঁচতে মানুষগুলো উঁচু ঘর বানিয়েছে। দীর্ঘ ঝুলন্ত গ্রামের ফকিরকোণার অংশ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পরে দ্বীপে পরিণত হয়েছে। শতাধিক পরিবার এখন একেবারেই বিচ্ছিন্ন। জোয়ারের সময় দূর থেকে দেখা যায়- বাড়িগুলো যেন পানিতে ভাসছে!

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভেঙে পড়েছে যাতায়াত ব্যবস্থা। খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রাম থেকে তোলা ছবি

কালাবগি বাজারের পাশে ছোট্ট ঝুলন্ত ঘরে বাস করেন আবদুস সোবাহান গাজী (৭০)। এ বয়সেও নদীতে যান নৌকা নিয়ে। কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জীবনে দশবার বাড়ি বদল করেছেন। এক সময় ভিটেমাটি ছিল। এখন থাকেন ঝুলন্ত বাড়িতে। সোবাহান গাজী বলেন, ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এরপর ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে সুতারখালী ইউনিয়নের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এলাকাটি পানির তলায় ছিল প্রায় ৫ বছর। এক সময়ের সবুজে ঘেরা গ্রাম এখন মরুভূমি!

ভরদুপুরে ঘরের সামনে সরু রাস্তার উপর কাজ করছিলেন কালাবগি গ্রামের আবদুল হামিদ মোল্লার স্ত্রী মর্জিনা বেগম (৪৫)। তিনি বলেন, দুর্যোগের কারণে আমাদের ঘর বদল করতে হয়েছে ৬ বার। প্রায় ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে সব হারিয়েছি। সেই থেকে আমরা রাস্তার ধারে বাস করি।

বড় প্রভাব কর্মসংস্থান এবং আবাসনে

‘আমাদের গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতের পর বাড়ি বদল করেছি ৫ বার। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাজের ক্ষেত্র বদলে দিচ্ছে, উপার্জন কমিয়ে দিচ্ছে। বলছিলেন দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামের সোলায়মান শেখ (৬৫)। একই কথা উপজেলার অন্যান্য মানুষের কণ্ঠেও শোনা গেছে।

সোলায়মান শেখ বলেন, এতবার দুর্যোগের আঘাতে আমরা কীভাবে টিকে থাকবো? দুর্যোগ আঘাত করলেই আমরা কোনো না কোনো ক্ষতির মুখে পড়ি। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অর্থ প্রয়োজন। দুর্যোগের কারণে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়েছে। নদী থেকে চিংড়ির রেণুপোনা সংগ্রহ আমাদের উপার্জনের প্রধান ক্ষেত্র ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে নদী থেকে রেণু ধরা সরকার নিষিদ্ধ করেছে। ফলে কাজের জন্য আমাদের শহরে যেতে হচ্ছে। সেখানে জীবন আরো কঠিন।’

নদী এবং সুন্দরবন ঘেঁষা জীবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিঃস্ব হয় মানুষ। তারপরও ঘুরে দাঁড়ায় তারা

খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার হাজতখালী এবং কাটমারচর গ্রাম দুটি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পরে প্রায় ৯ মাস পানিতে ডুবে ছিল। এই এলাকায় কৃষি এবং চিংড়ির আবাদ হতো। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। চিংড়ি চাষ বা কৃষি খামারে মজুরি- সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মানুষগুলো বেকার। হাজতখালী গ্রামের অনেক মানুষ আর কখনোই বাড়িতে ফিরতে পারবে না।

কয়রার হাজতখালী গ্রামের বেড়িবাঁধের উপর দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল পরিতোষ মণ্ডল, কার্তিক মণ্ডল এবং ঊষারাণী মণ্ডলসহ আরও অনেকের সঙ্গে। দীর্ঘ ৯ মাসের বেশি সময় ধরে এই এলাকার অসংখ্য মানুষ বেড়িবাঁধের উপরে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এলাকার পিচঢালা সড়ক ভেঙে কয়েকটি খাল তৈরি হয়েছে। খালে নৌকা চালিয়ে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অথচ তারা এক সময় কৃষিকাজ অথবা চিংড়ির ঘেরে কাজ করতেন।

 বেড়িবাঁধের ওপর ভোরে কর্মব্যস্ত নারী। কৃষিকাজ নেই, বদলে গেছে পেশা

২০১১ সালের আদমশুমারী থেকে আমরা দেখতে পাই- এ অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। অথচ জনসংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কেন এমন হলো? এর কারণ, এ এলাকায় মানুষ বাস করতে পারছে না। খুলনা, বরিশাল ও যশোর জেলাশহরে শিল্পাঞ্চল না-থাকা সত্ত্বেও জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু এই এলাকায় যুগের পর যুগ মানুষ বাড়ছে না। এর কারণ উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলের মানুষ উল্লেখিত জেলায় যাচ্ছে। প্রতি বছর অন্তত দুই লাখ মানুষ উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল থেকে শহরমুখো হচ্ছে। এটি স্পষ্টতই একটি অভিঘাত। বারবার পেশা বদল করে নিজের এলাকায় টিকতে না পেরে তারা মহানগর অথবা এর নিকবর্তী এলাকায় যাচ্ছে। বলছিলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তর-এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন।

তিনি আরো বলেন, শহরে এসে তারা বিভিন্ন পেশায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আর যারা উপকূলেই থাকছে, তারা বছরের পর বছর বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এলাকার মানুষের এটাই যেন নিয়তি। 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়