ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করার দাবি

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৬, ২৪ মে ২০২১   আপডেট: ১৩:২৮, ২৫ মে ২০২১
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করার দাবি

আম্ফান শিশুদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। জীবিকার প্রয়োজনে ওদেরও ছুটতে হয় কাজে

‘এক সময় আমার সব ছিল। নিজের জমিতে কৃষি কাজ করতাম। এখন কিছুই নাই। পরিবারসহ এই বেড়িবাঁধের উপরে বাস করি। পরিবারের পাঁচজনের খাবার যোগাড় করি দিন মজুরির মাধ্যমে। কিন্তু এলাকায় এখন কাজও নাই। দৈনিক তিনবেলা খাবার যোগাড় করাই খুব কঠিন!’

এক বছর ধরে নিজের জীবনের সংকটের কথা এ ভাবে ব্যাখ্যা করছিলেন পরিতোষচন্দ্র মণ্ডল (৪৫)। তার বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের হাজতখালী গ্রামে। ওই গ্রামের আরও অনেকগুলো পরিবার বেড়িবাঁধে বসবাস করছে। বেড়িবাঁধের পাশেই কপোতাক্ষ নদ। জোয়ারের সময় এই নদের পানি বেড়িবাঁধের কাছে আসে। তখন আতঙ্ক আরো বাড়ে। আজ থেকে এক বছর আগে, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের রাতে এই বেড়িবাঁধ ভেঙেই কপোতাক্ষ নদের তীব্র জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। এ কারণে এই বেড়িবাঁধে বসবাস করতেও এখন মানুষের ভয়।

বেড়িবাঁধের উপরে বসবাসের স্থান পাননি অনিতা রাণী মণ্ডল (৬২)। তিনি ঘর বানিয়েছেন বেড়িবাঁধের বাইরের অংশে। সেখান থেকে জোয়ারের পানি আরো খুব কাছে। তার বৃদ্ধ স্বামী জগদীশচন্দ্র মণ্ডলকে (৭২) নিয়ে সেখানেই বাস করেন অনিতা। ঋণ করে সংসার চলছে। অথচ এক সময় তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের কোনো সমস্যা ছিল না।

এদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এই এলাকায় অনেক। এক বছর ধরে বহু মানুষ বেড়িবাঁধের উপরে, রাস্তার ধারে, সাইক্লোন শেলটারে, স্কুল-মাদ্রাসা ভবনে বাস করছেন। অনেক এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। দশ মাস পরে ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কার করে লবণ পানি আটকানো সম্ভব হয়েছে। এরপর কিছু মানুষ বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু অনেকের পক্ষে আর কখনোই বাড়ি ফেরা সম্ভব হবে না। কারণ গ্রামগুলো নদীতে হারিয়ে গেছে।

বিপন্ন গ্রামের ধ্বংস চিহ্ন। এক বছরেও স্বাভাবিক হয়নি জীবন। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার কাটমারচর গ্রামের ছবি

সব কিছু হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। অনেকে বাঁচার জন্য বাধ্য হয়ে ঋণ নিয়ে ফাঁদে আটকা পড়ছেন। অনেকে পরিবারের মূল্যবান সম্পদ বিক্রি করছেন পানির দামে। তবুও শূন্য থেকেই তাদের আবার জীবন শুরু করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এত উদ্যোগের পরেও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষেরা কেন বছরের পর বছর এমন সংকটের মধ্যে বাস করে? এই প্রশ্ন করেছিলাম বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান এমপি’র কাছে। তিনি বলেন, ‘সাইক্লোনের এই সংকট মোকাবিলায় সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। সাইক্লোনের আগে, সাইক্লোনের সময় এবং সাইক্লোনের পরে আমরা মানুষের সুরক্ষার জন্য নানান উদ্যোগ নেই। আমাদের প্রচেষ্টার কারণেই সাইক্লোনে ক্ষতির পরিমাণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমেছে। যদিও আম্ফানের পরে বেড়িবাঁধ ও পোল্ডারের ক্ষতি পুরোটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। তবে কাজ অব্যাহত আছে।’

প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব  মোঃ মোহসীন বলেন, ‘আম্ফান এলাকায় বিশেষ নজর আমাদের ছিল। কোভিড মহামারির মধ্যেও আমরা ভালোভাবে সাইক্লোন মোকাবিলা করেছি।’

ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে

সরকারের তরফে সাইক্লোনের ক্ষতি শতভাগ রিকভারির কথা বলা হলেও মাঠের চিত্র ভিন্ন। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে সব জায়গায় আম্ফানের ধ্বংস চিহ্ন স্পষ্ট। অনেক স্থানে পড়ে আছে বিধ্বস্ত বাড়ি। কৃষি ও চিংড়ির খামার বিরাণ পড়ে আছে। অনেকেই জরুরি রিলিফ ছাড়া কোনো সহায়তাও পাননি।

মোহাম্মদ মাফুয়ার রহমান (৩৯) তাদেরই একজন। তার বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া গ্রামে। আম্ফানের পর প্রায় এক বছর গ্রামটি পানির নিচে ছিল। মাফুয়ার রহমান এখন বাস কারেন ফুলতলা গ্রামে অন্যের জমিতে। কৃষিকাজ ছেড়ে তিনি এখন ভ্যান চালক।

মাফুয়ার রহমান বলেন, ‘আমার বাড়ি ছিল, কৃষি জমি ছিল। সবই এখন পানির নিচে। ভ্যান চালিয়ে দৈনিক তিনবেলা খাবার যোগাড় করা অনেক কষ্ট। আম্ফানে আমার ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা।’

মাঠ পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে ইউনিয়ন পরিষদ। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে এবং মৃত্যু কমাতে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের পরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ খুবই কম। এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির প্রধান কারণ দুর্বল বেড়িবাঁধ। ষাটের দশকে নির্মত এই বেড়িবাঁধগুলো শক্ত করে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় না।’

আন্তর্জাতিক রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস (আইএফআরসি)-এর পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ ত্রিমূখী বিপদ মোকাবিলা করেছে। কোভিড ১৯ মহামারী, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং বর্ষার বন্যা। কোভিড মহামারির কারণে আম্ফান আক্রান্ত সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোকে পুনর্নির্মাণে সহায়তা করা কঠিন হয়ে ওঠে। এটা উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

দুর্যোগ মোকাবিলার মেকানিজম আপডেট করার পরামর্শ

মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান অনেক পরিবারকে নতুন করে নিঃস্ব করেছে। শুধু আম্ফান নয়, এর আগেও বেশি কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের বহু মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। ২০০৯ সালের সাইক্লোন আইলার আঘাতের পর খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নটি প্রায় পাঁচ বছর ধরে পানির তলায় ছিল। ওই সাইক্লোনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কালাবগি ও গুনারি গ্রাম। এই দুই গ্রাম থেকে বহু পরিবার অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। কালাবগি গ্রামটি ‘ঝুলন্ত গ্রামে’ পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকবার ঘূর্ণিঝড় নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে আগামীতে বড় প্রাকৃতিক বিপদের শঙ্কা আছে।

হাবিবুর রহমান, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আম্ফানে। মূল বাড়ি ছিল সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনির চাকলা গ্রামে। এখন ঠাঁই হয়েছে সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পে

এ অবস্থায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার মেকানিজম আপডেট করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ব্যাপক তৎপরতা থাকে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের পরে পুনর্বাসন পর্যায়ে সহায়তা কম। ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ ব্যবস্থা এখনও অনেক পুরানো। ঘূর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করা দরকার। কেননা, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ থাকে স্থানীয় সরকারের। তবে সবার আগে শক্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণের দিকে নজর দিতে হবে।

দুর্যোগ ফোরাম-এর আহবায়ক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, সকলেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সফলতার কথা বলছেন। কিন্তু প্রত্যেকবারই আমরা বেঁচে যাচ্ছি জোয়ারের সময় ঘূর্ণিঝড় আঘাত না করায়। জোয়ারের সময় সাইক্লোন আঘাত করলে বোঝা যাবে আমরা কতটা সফল। আমরা এখনও ঘূর্ণিঝড় সিগন্যাল আপডেট করতে পারিনি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা আছে। গোটা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করতে হবে। শক্ত বেড়িবাঁধ করতে হবে। বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব জনগণকে দিতে হবে।

বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর নির্বাহী পরিচালক এম. জাকির হোসেন খান। তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি প্রাকৃতিক বিপদগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্যে আমাদেরকেও শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমে অরো জোর দিতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় কমিউনিটিকে যুক্ত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস (আইএফআরসি)-এর বাংলাদেশ ফেডারেশন অফ কান্ট্রি ডেলিগেশন প্রধান সঞ্জীব কুমার কাফলে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আমাদেরকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ এই ধরণের ঘূর্ণিঝড় আগামীতে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলিকে প্রতিক্রিয়া চক্রের বাইরেও ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের সহায়তার জন্য আরও তহবিল জোর দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী এবং জাতীয়ভাবে আরও আলোচনা করা দরকার। সম্মিলিতভাবে, আমাদের দুর্যোগের প্রতিক্রিয়া এবং পুনরুদ্ধারের দিকে তাকানোর পুরানো উপায়গুলি অতিক্রম করা দরকার। দারিদ্র্য হ্রাসের মূল কারণ সম্পর্কে কাজ করতে হবে।

আম্ফান সুপেয় খাবার পানির সংকট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পানি সংগ্রহে যেতে হয় অনেক দূরে

তবে সরকার বলছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার চলমান মেকানিজমেই তারা সফল। এই মেকানিজমেই বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলানো সম্ভব। তবে এই মেকানিজমকে আরো জোরদার করার চেষ্টা করছেন তারা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এমপি বলেন, আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন আছে। আমাদের আছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার স্থায়ী আদেশাবলী। দুর্যোগ আঘাত করলে কাউকে কমান্ড করতে হয় না। যে যার কাজগুলো যথাযথভাবে করতে পারে এই আদেশের আলোকে। দুর্যোগ পরেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খোঁজ রাখি। মাঠ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের রিপোর্ট আসে। সে অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তবে আমরা চলমান মেকানিজম আরও জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব  মো. মোহসীন বলেন, আমরা যে কোনো বড় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রস্তুত। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মেকানিজম ঠিক থাকবে, নাকি আপডেট হবে, তা জানার প্রয়োজন মনে করেন না পরিতোষচন্দ্র মণ্ডল কিংবা মাফুয়ার রহমানেরা। তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে চান। অনেক কষ্টে গড়া সম্পদ সাইক্লোনের প্রবল স্রোতে ভেসে যাক তারা চান না। তবে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের কারণে আতঙ্ক তাদের পিছু ছাড়ে না। 

[সমাপ্ত]

আরো পড়ুন:
# এখনও স্পষ্ট ধ্বংসের চিহ্ন
# মহামারিতে ঘূর্ণিঝড়: মরার উপর খাঁড়ার ঘা
# উপকূলে বেড়েছে জীবনের সংকট
# টিকে থাকার লড়াই শেষ হয় না

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়