ঢাকা     বুধবার   ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩১

রপ্তানি বিকাশের অপেক্ষায় দেশীয় ‘প্রসাধনী শিল্প’

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ২ নভেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২৩:৫৬, ২ নভেম্বর ২০২৪
রপ্তানি বিকাশের অপেক্ষায় দেশীয় ‘প্রসাধনী শিল্প’

আশির দশকের গোড়ার দিকে স্বল্প পরিসরে একটি অপ্রচলিত রপ্তানি খাত হিসেবে দেশের পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়ে রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশে পৌঁছেছে। আশার কথা হলো আরও এমন বিকাশমান রপ্তানি শিল্প রয়েছে, যা দেশীয় শিল্প হিসেবে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিতে পারে; তার মধ্যে অন্যতম দেশীয় কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট বা প্রসাধনসামগ্রী।

প্রসাধনী শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা, ক্রেতার সংখ্যা, বৈশ্বিক চাহিদাসহ বিভিন্ন গুণনীয়ক বা ফ্যাক্টর পর্যালোচনা সাপেক্ষে অর্থনীতিবিদরা শোনাচ্ছেন আশার কথা। 

তারা বলছেন, দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি খাতেও অপার সম্ভাবনা রয়েছে প্রসাধনসামগ্রীর। তবে এ জন্য সরকারের নীতিসহায়তার পাশাপাশি, উৎপাদকের প্রতিশ্রুতি এবং সামাজিক ও পরিবেশগত শর্তগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। 

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্যের আগামী দিনে রপ্তানি বাণিজ্যে অন্যতম বড় অংশীদার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য দেশে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতের উপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। খাতটির গুরুত্ব বিবেচনায় সরকারও নীতিসহায়তা দেবে আশা করা যায়।’

তিনি বলেন, ‘দেশে পোশাক খাতের পর ওষুধশিল্প, নির্মাণশিল্পসহ কয়েকটি শিল্পের বিশ্ববাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আমরা ভালোও করছি। তেমনি দেশে প্রসাধন পণ্যেরও সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে প্রসাধনী ও ব্যক্তিগত যত্নের সামগ্রীর বার্ষিক বাজার এখন প্রায় ৯০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আশা করা হচ্ছে ২০২৭ সালে ৮ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে বোঝাই যাচ্ছে কতটা সুযোগ রয়েছে এই খাতে।’ 

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এরই মধ্যে গ্লোবাল ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্যের রিটেইল চেইন শপ চালু হওয়ায় জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব দেশের শতভাগ নির্ভেজাল কালার কসমেটিকস, স্কিনকেয়ার, হোমকেয়ার ও পার্সোনাল কেয়ার পণ্য। 

তারা বলছেন, এই খাতের এখনও সবচেয়ে বড় বাধা নকল পণ্য, যা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। পাশাপাশি আমদানি পণ্যও এই খাতের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা, এর ফলে একদিকে তদারকির অভাবে নকল পণ্য উৎপাদন উৎসাহিত হচ্ছে, অন্যদিক সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। এসব বন্ধ করার পাশাপাশি সরকার নীতি সহায়তা ও বাণিজ্য সুবিধা দিলে এই শিল্প খাত হতে পারে ভবিষ্যতের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও এর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পটিআইনেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, গত এক দশকে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তরিকভাবে কাজ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও কমপ্লায়েন্ট শিল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 

‘অদূর ভবিষ্যতে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের মতো সক্ষমতা এখন এই শিল্পের বেড়েছে। বেটার ওয়ার্ক প্রকল্প সরকার, কারখানা এবং বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর মতো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে কারখানা পর্যায়ে বাস্তবসম্মত চর্চা সুপারিশ ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও তা অনুসরণ করতে পারে। অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান বিশ্ববাজারে ঢুকতে চায়, তাদের উচিত পোশাক খাতের উদ্যোগগুলো খতিয়ে দেখে সেভাবেই পদক্ষেপ নেওয়া। সামাজিক ও পরিবেশগত শর্তগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করলে খাদ্য ও কৃষি, নির্মাণশিল্প, ওষুধশিল্প, আসবাবশিল্পসহ আরও অনেক খাতেই বাংলাদেশের বড় কিছু করার সম্ভাবনা রয়েছে। 

টুমো পটিআইনেনর ভাষায় প্রসাধনশিল্প সঠিক পরিকল্পনামাফিক এবং কাঠামোগতভাবে এগিয়ে যেতে পারলে বিশ্বমানের শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব।  

পোশাক শিল্পের মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ এর তথ্য মতে, দেশের ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ জনশক্তি কৃষিতে নিয়োজিত। অর্থাৎ দেশের মোট জনশক্তির প্রায় অর্ধেক নিয়ে কৃষি জিডিপিতে অবদান রাখে প্রায় ১২ শতাংশ।

বিবিএস-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে তুলে ধরা কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১১ দশমিক ৩৮ (স্থির মূল্যে), আর শস্য খাতের অবদান ৫ দশমিক ৫১ (স্থির মূল্যে)। সেখানে মাত্র ৪৪ লাখ জনশক্তি নিয়ে পোশাকশিল্প জিডিপিতে অবদান রাখে ১০ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান বাড়ছে। প্রসাধনীর মতো চাহিদাসম্পন্ন পণ্যের সুযোগ রয়েছে পোশাক খাতের মতো প্রতিষ্ঠা পাওয়ার। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ক্রমেই বাড়ছে। তেমনি সম্ভাবনাও বাড়ছে। একদিকে যেমন সরকারি খাতে শিল্প-কলকারখানা চলছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও শিল্প কল-কারখানা যোগ হয়েছে। শুধু জিডিপিতে অবদান নয়, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। দেশে যেমন ভারী শিল্প গড়ে উঠেছে, তেমনি এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে উঠছে অনবরত। 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে স্থির মূল্যে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ৩২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এই বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে শ্রমঘন পরিবেশের পাশাপাশি রপ্তানি শিল্প বহুমুখিকরণে রূপান্তর হয়েছে। 

স্থানীয় পর্যায়ে উৎপন্ন হওয়ায় এবং এ-সংক্রান্ত চেইনসপ তৈরি হওয়ায় হাতের নাগালেই নিওয়, লিলি, হারল্যান, সিওডিল এবং ব্রেইজ ও স্কিনের মতো প্রিমিয়াম কোয়ালিটির অথেনটিক সব প্রোডাক্ট পাওয়া সহজ হয়েছে। টাইলক্স, অরিক্স, একনল এর মতো দৈনন্দিন ব্যবহারিক হোম কেয়ার পণ্যও দেশে পাওয়া যাচ্ছে। এসব পণ্য দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের নীতি সহায়তা পেলে একদিকে যেমন উৎপাদন বাড়বে, তেমনি রপ্তানি আয়ও বাড়বে। ফলে আমদানিনির্ভর সম্ভাবনাময় কসমেটিকস সেক্টরটি রপ্তানিমুখী খাতে পরিণত হতে পারে এবং এর মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। 

বর্তমানে ত্বক ও ফ্যাশন সচেতনতা বাড়ায় স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদা বাড়ছে বিশ্বজুড়েই। মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। চাহিদা তৈরি হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি পণ্যের। বেশ কিছু কোম্পানি এখন উন্নত ফর্মুলেশন-গবেষণা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে দেশে।

প্রয়োজন নীতিসহায়তা

আমদানির বিকল্প ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকার পরও দেশীয় কসমেটিকস শিল্পে নীতি সহায়তার পরিবর্তে বাড়তি শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে নতুন উদ্যোগগুলো আরও বেশি অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। সম্পূরক ভ্যাট, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপকে এ খাতে অন্যতম বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। 

খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্যের কাঁচামাল আমদানির শুল্ক কমালে দেশীয় বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা এসব কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশই বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়। দেশীয় পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের শুল্ক হ্রাস, বিদেশি পণ্য আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি, অবৈধ পথে বাজারে আসা পণ্য ঠেকানো, নকল পণ্য রোধ ইত্যাদি বিষয়ে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশে কসমেটিকস শিল্প খাতের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

তারা বলছেন, আমদানি বিকল্প দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। কর্ম️সংস্থান ছাড়াও রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। তাই নীতিনির্ধারণে অগ্রাধিকার তালিকায় শীর্ষে️ থাকা উচিত স্থানীয় বিনিয়োগ সুরক্ষা।

রপ্তানি আয়ের বিকল্প খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠার হাতছানি

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্থানীয় উৎপাদনকে নীতিসহায়তা দিয়ে মানসম্মত পণ্য ক্রেতাদের জন্য সুলভ করা জরুরি। দেশে গ্লোবাল ব্র্যান্ডের উৎপাদন কার্যক্রম সম্প্রচারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি সহজলভ্য করা গেলে এবং সরাসরি কসমেটিকস পণ্যের শুল্কহার বাড়ানো হলে দেশীয় উৎপাদন ও উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়া সহজ হবে।

কসমেটিকস শিল্প খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এই শিল্পের নীতি প্রণয়নে চার দফার জোরালো সুপারিশ করেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সহায়তার নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে না। 

ট্যারিফ কমিশন তাদের সুপারিশে তুলে ধরেছে যে, একজন স্থানীয় উৎপাদনকারীকে প্রতি পিসের একক মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়; যার ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীর ওপর সম্পূরক শুল্কের প্রভাব অনেক বেশি। কারণ আমদানিকৃত পণ্যের শুল্কায়ন মূল্যের চেয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য মূল্যের অনেক বেশি। ভোক্তা বাজার সবার জন্য এক হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের বিনিয়োগ হুমকির সম্মুখীন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পোশাক শিল্পের টেকসই উন্নয়ন ও বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মখীন হতে পারে। এর মধ্যে ডিকার্বোনাইজেশন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয়করণের প্রভাব অন্যতম। 

তারা বলছেন, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর জেনারেলাইজড প্রেফারেন্স স্কিমসহ (জিএসপি) অন্যান্য বাণিজ্য সুবিধা কমে যাওয়া, শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও আমদানিকারকরা বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলক কম খরচে পোশাক উৎপাদন করা দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা বাড়তে পারে। 

এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের বিকল্প খাত হিসেবে কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্যকে সরকার বিবেচনা করতে পারে বলে পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। 

তারা বলছেন, সরকারের নীতি সহায়তা পেলে কম সময়ে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে প্রসাধনশিল্প। কারণ বর্তমান রুচি ও ফ্যাশন সচেতনতার যুগে অন্যান্য অনেক খাতের তুলনায় বেশি সম্ভাবনাময় খাত এটি।

দ্রুত বর্ধনশীল ও সম্ভাবনাময় খাত

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত বর্ধনশীল ও সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্যের অনেক সুযোগ রয়েছে দেশে। 

বিশ্ববাজারে এই মুহূর্তে কসমেটিকসের বাজার ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে হালাল কসমেটিকস তিন ট্রিলিয়ন ডলারের। এই বিশাল বাজারে বিশ্বের ১২টি দেশ হালাল কসমেটিকস রপ্তানি করছে। অথচ তাদের মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই। 

অবশ্য বাংলাদেশ ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ। দেশেই কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্যের বিশাল বাজার রয়েছে। পাশাপাশি মুসলিম দেশ হিসেবে বিশ্ববাজারের হালাল পণ্য হিসেবেও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কথা বাংলাদেশের। 

ভোক্তা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবদুল জলিল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমেরিকায় যেসব কসমেটিকস ব্যবহার হয়, সেগুলো আমাদের দেশের জন্য উপযোগী নয়। কারণ, ওদের আবহাওয়া আর আমাদের আবহাওয়া ভিন্ন। এ জন্য আমাদের দেশের মানুষের জন্য আমাদের দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী কসমেটিকস পণ্য তৈরি করতে হবে। নিজেদের জন্য পণ্য যদি নিজেরা তৈরি করতে পারি, তাহলে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে না। এ ক্ষেত্রে ভোক্তাদের প্রাধান্য দিতে হবে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েকবছর ধরে আমরা দেখেছি দেশীয় শিল্প উৎপাদকদের সুবিধা দেয়ার একটি প্রবণতা ছিল জাতীয় বাজেটে। এর সুফলও পাওয়া গেছে। তবে আমরা দেখেছি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাজেটে কসমেটিকস আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক ছিল। এই অর্থবছরেও শুল্ক কমানো হয়নি। যেহেতু দেশে গ্লোবাল মানের স্কিন কেয়ার পণ্য উৎপাদন হচ্ছে, এই খাতকেও বিবেচনায় আনা উচিত সরকারের।

‘পোশাক খাত দেশে অপ্রচলিত রপ্তানি খাত হিসেবে যাত্রা করেও আজ এই অবস্থানে এসেছে। অথ্চ এখনই স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদা রয়েছে বিশ্ববাজারে। সুতরাং এই খাতকে নার্সিং করে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারার সুযোগ করে দেওয়া উচিত।’ 

তিনি বলেন, কিছুক্ষেত্রে এমন নীতিমালা দরকার যাতে দেশেই কিছু পণ্যের সক্ষম এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎপাদক তৈরি হতে পারে। আর যেসব প্রতিষ্ঠান নিজেরা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তাদের সহায়তা দেওয়া উচিত। 

অ্যাকসেসরিজ খাত বিকাশের সুযোগ

একটি খাত বিকশিত হলে এর সঙ্গে সর্ম্পকিত অন্যান্য খাত-উপখাতও বিকশিত হয়। দেশের পোশাক খাত বিকশিত হওয়ায় রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ বা পোশাকের উপকরণ তৈরির অনেক উপখাতও প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে- ডস্টিং, ইলাসটিক, বাটন (মেটাল, উড, প্লাস্টিক), জিপার (মেটাল, ভিসলন, নাইলন কয়েল), আইলেট, রিভেট, স্টপার, ব্যাজ, বাকল, সাসপেন্ডার বাকল ইত্যাদি। গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজের অনেক কারখানাও গড়ে উঠেছে দেশে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্য দেশে প্রতিষ্ঠা পেলে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক কারখানাও গড়ে উঠবে। ফলে বিপুলসংখ্যক জনশক্তির কর্মসংস্থানও হবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা পেতে পারে প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন খাতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জনবল তৈরির খাতও। 

প্রণীত আইন বাস্তবায়নে তাগিদ

আগের ড্রাগস (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ একীভূত করে অন্যান্য দেশের ওষুধ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করে বাংলাদেশে যুগোপযোগী ‘ওষুধ ও কসমেটিকস্ আইন ২০২৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। জেল-জরিমানার বিধান রেখে ঔষধ ও কসমেটিকস বিলও পাস হয়েছে। আইনে নকল কসমেটিকস্ উৎপাদন করলে বা জ্ঞাতসারে কোনো নকল কসমেটিকস বিক্রয়, মজুত, বিতরণ বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে প্রদর্শন করা হলে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিতের বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে বিউটি পার্লার কর্তৃক বিধি লঙ্ঘন করে কোনো কসমেটিকস্ প্রয়োগ ও ব্যবহার করলে অনূর্ধ্ব তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। 

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রসাধনীর বেশিরভাগ বাজার চোরাকারবারি ও নকল পণ্য উৎপাদনকারীদের দখলে। এমনকি আমদানি ও উৎপাদিত প্রসাধনীর ৭০ শতাংশই থাকে মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে নকল ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহার করে দেশের মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার চোরাই পথে বিপুল পরিমাণ প্রসাধনী দেশে আসায় সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আইনের বাস্তবায়ন না হওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে প্রসাধনীর বিশাল বাজার।

নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের কসমেটিকস ব্যবহারে মাথার চুল পড়ে যাওয়া, ফর্সা হতে গিয়ে চামড়া বিকৃত হওয়া, বন্ধ্যাত্বসহ লিভার ও কিডনির নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। 

খাত সর্ম্পকিত কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে কসমেটিকস খাতের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। তবে এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানি হয়। বাকি ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনীর বাজার চোরাকারবারি ও নকল পণ্য উৎপাদনকারীদের দখলে। বিদেশি কসমেটিকস বৈধ পথে আমদানির চেয়ে চোরাই পথে লাগেজ পার্টির মাধ্যমেই দেশের বাজারে প্রবেশ করছে বেশি। 

লাইট ক্যাসেল পার্ট️নার্স এবং অ্যালাইড মার্কে️ট রিসার্চে️র মতো গবেষণা সংস্থাগুলোর ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের স্কিন কেয়ার বা পারসোনাল কেয়ার শিল্পের আনুমানিক বাজারের আকার ২০২০ সালে ছিল ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৭ সালের মধ্যে এর আকার ২ দশমিক ১২ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করছে তারা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত️ ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হারে এই শিল্প বৃদ্ধি পাবে। 

ফলে প্রসাধনশিল্পের মাধ্যমে রপ্তানি বিকশিত করার নতুন দুয়ার খোলার সম্ভাবনাকে এখনই গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতি ও বিশেষজ্ঞরা।

হাসান/রাসেল পারভেজ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়