রেকর্ড উৎপাদন, বেড়েছে মজুত, তবুও চালের বাজারে উত্তাপ

ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামে উপচে পড়ছে চালের মজুত। বাজারে সরবরাহেও ঘাটতি নেই। তারপরও চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। প্রশ্ন উঠেছে সরবরাহ ও মজুত থাকার পরও হঠাৎ চালের মূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে কারা?
চাষির ঘাম, সিন্ডিকেটের ফায়দা
সরকারি তথ্য বলছে, চলতি বোরো মৌসুমে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ১৪ লাখ টন। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ১৫ লাখ টন। খাদ্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামে বর্তমানে ১৫ লাখ ৭২ হাজার টন চাল মজুত রয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৩ লাখ টন বেশি। অথচ এই অর্জনের ফল ভোগ করছেন না প্রকৃত উৎপাদক।
নোয়াখালীর কৃষক কালাম হোসেন বলেন, ‘‘ধান বিক্রি করছি মণপ্রতি ১১০০ টাকা। অথচ সেই ধানের চাল এখন কিনতে হচ্ছে ৮৫ টাকায়! আমরা দাম পাই না, আবার বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। লাভ করছে কারা?’’ ঝালকাঠির কৃষক জহর আলীরও একই প্রশ্ন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘ফসল ফলাই আমরা, কিন্তু বাজার চালায় অন্যেরা। আমাদের কথা কেউ শোনে না, ভাবেও না।’’
দাম বৃদ্ধি মিলগেটেই
অধিকাংশ জায়গায় চালের মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে মিলগেট থেকেই। জেলা খাদ্য কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,‘‘গুদামে চাল আছে, বাজারেও সরবরাহ আছে। কিন্তু মিল পর্যায় থেকেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। যেহেতু ৮৫ শতাংশ চালকলের দীর্ঘমেয়াদি মজুত ক্ষমতা নেই, তাই দায় বর্তায় করপোরেট চালকলগুলোর ওপর। এসব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে বিপুল ধান কিনে বাজারে প্রভাব ফেলে।’’
নওগাঁ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘প্যাকেটিং, পরিবহন, শ্রমিক মজুরিসহসব খাতে খরচ বেড়েছে। কম দামে চাল বিক্রি করা কঠিন।’’ তবে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির প্রচার সম্পাদক জয়নাল আবেদিনের ভাষ্য ‘‘বড় করপোরেট মিলগুলো মাঠ পর্যায় থেকে আগাম টাকা দিয়ে ধান কিনে নেয়। এতে স্থানীয় ছোট মিলগুলো পিছিয়ে পড়ে।’’
অভিযান শুধু খুচরা বাজারে
খাজানগর মোকামে সরু চালের ২৫ কেজির বস্তা ঈদের আগে বিক্রি হয়েছে ১৭২০ টাকায়, যা এখন ১৯২০ টাকা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা একে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বলছেন। কুষ্টিয়া চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘‘এটা অস্বাভাবিক। দাম বৃদ্ধির পেছনে গভীর সিন্ডিকেট তৎপরতা থাকতে পারে। তদন্ত হওয়া দরকার।’’
কিন্তু মূল নিয়ন্ত্রকরা সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। অভিযান বা তদন্ত চলে কেবল খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজারে অভিযান চালানো হলেও মিল পর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান তদারকি নেই। আর এই সুযোগ নিচ্ছেন এক শ্রেণির মজুতদার। তারা একসঙ্গে বিপুল ধান কিনে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করছে।
ভোক্তার কষ্ট
রবিবার রাজধানীর কাপ্তান বাজারে মিনিকেট কিনতে আসা চাকরিজীবী মনির আহমেদ বলেন, ‘‘আগে মিনিকেট কিনতাম ৭৫-৭৮ টাকায়। এখন কিনছি ৮০-৮৩ টাকায়। প্রতিদিনের খরচের হিসাব কষেই বাজারে যেতে হয়।’’
সাম্প্রতিক চালের বাজার পরিস্থিতি বলছে, খাদ্য উৎপাদন নয় বাজার ব্যবস্থাপনাই এখন প্রধান সংকট। কৃষক ও ভোক্তা দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। লাভবান গুটিকয়েক মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর। এই ব্যবস্থার সংস্কার না হলে বাম্পার ফলনেও জনগণের কষ্ট কমবে না।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘যখন ফসল কৃষকের হাতে থাকে, তখন দাম পড়ে। আর ফসল যখন যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে, তখনই মূল্য বাড়ে। পুরো ব্যবস্থাই এক ধরনের জিম্মি দশায় আছে।’’
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘‘সরবরাহে ঘাটতি নেই, বরং এবার সংগ্রহ অভিযানও নির্ধারিত সময়ের আগেই শুরু হয়েছে।খুব দ্রুতই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে। চলতি মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে।’’
তারপরও বাজারে চালের দাম কমছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘‘চালের দাম বাড়াতে বাজারে কোনো সিন্ডিকেট থাকলে তা ভেঙে দিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। দক্ষিণাঞ্চলে সরু জাতের ধান চাষের কারণে ধান সংগ্রহে কিছু সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।’’
তারা//