দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা
রণজিৎ সরকার || রাইজিংবিডি.কম
নিজের কার্য়ালয়ে রণদা প্রসাদ সাহা (ছবি : সংগৃহীত)
রণজিৎ সরকার
রণদা প্রসাদ সাহা- আর পি সাহা নামেই যিনি পরিচিত। রণদা প্রসাদ সাহা জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার অদূরে সাভারের শিমুলিয়ার কাছৈড় গ্রামে মামাবাড়িতে। ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বরে (১৩০৬ বঙ্গাব্দ)।
তার বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার লৌহজং নদীবিধৌত নিভৃত পল্লির মির্জাপুর গ্রামে। মায়ের নাম কুমুদিনী সাহা, বাবার নাম দেবেন্দ্র নাথ সাহা।
তিনি একজন সংগ্রামী, আত্মপ্রত্যয়ী মানবসেবক। অতি সাধারণ পরিবারে তার জন্ম। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত মির্জাপুর বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তার বাবার আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। রণদা প্রসাদের বয়স যখন সাত বছর, তখন তার মা সন্তান প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্করে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান।
বাবা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করলে সৎমায়ের অবহেলায় গৃহত্যাগ করেন রণদা প্রসাদ সাহা। তার বয়স যখন ১৬, তখন তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানে তাকে করতে হয়েছে মিন্তির কাজ, খবরের কাগজ বিক্রি, আরো কত কী। অভাবের তাড়নায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে খাবার চেয়ে খেয়েছেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে দিনমজুরের কাজ করেছেন। দারিদ্র্যের কঠোর কশাঘাত নিয়ে অনাদরে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন রণদা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৫ সালে রণদা চাকরি নেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে। কর্মস্থল ছিল ইরাকে। একদিন সেখানে সামরিক হাসপাতালে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। রণদা ঝাঁপিয়ে পড়ে ৩৮ জন সেনাসদস্যকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে বীরত্বগাথা ভূমিকার জন্য বিভিন্ন মহলে প্রশংসা অর্জন করেন। কলকাতায় ফেরার পর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসেন রণদার জন্য অভিনন্দনের ডালি নিয়ে। এরপর রণদা যোগ দেন বেঙ্গলি রেজিমেন্টে। সেই রেজিমেন্টেই ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। দুজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে যান অল্পদিনেই।
কলকাতায় মুটের কাজ থেকে শুরু করে নানারকম কাজ করেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) রণদা প্রসাদ সাহার ছন্নছাড়া জীবনের দিন বদল ঘটিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করে কমিশনপ্রাপ্ত হন।
যুদ্ধ শেষে ইংরেজরা টিকিট কালেক্টরের চাকরি দেন তাকে। কিন্তু সে চাকরি রণদা বেশি দিন করেননি। আয় করা কিছু টাকা জমিয়ে ১৯৩২ সালে তিনি কলকাতাতে প্রথমে লবণ ও পরে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। পুঁজি কম। কিন্তু রণদা ছিলেন সৎ আর পরিশ্রমী। ব্যবসায়ী হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
এ ব্যবসা থেকেই ধীরে ধীরে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ব্যবসায় কিছুটা সফল হওয়ার পর তিনি বেঙ্গল রিভার নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। লক্ষ করেন, নৌপরিবহণ ব্যবসায়ীদের পুঁজির এক বিরাট অংশ ব্যয় হয়ে যায় নৌজাহাজ মেরামতের কাজে। রণদা নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন একটি ডাকইয়ার্ড। এ সময় রণদা বেঙ্গল রিভার্স সার্ভিস (বিআরএস) নামে একটি নৌপরিবহণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪৩ সালে বাংলাদেশে প্রচণ্ড খাদ্যসংকট দেখা দেয়। রণদা তখন দেশের বিভিন্ন অংশে মোট ২৭৫টি লঙ্গরখানা চালু করেন। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য দিয়ে বাঁচান আট মাস।
নারায়ণগঞ্জে জর্জ এন্ডারসন কোম্পানির পাটের বেল তৈরি করে। পরবর্তী সময় তিনি লেদার ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ এলাকা মির্জাপুরে ফিরে আসেন। মায়ের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর স্মৃতি নাড়া দেয় তাকে। তাকে ভাবায়। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, আর্থিক সচ্ছলতা পেলে চিকিৎসা করবেন বঞ্চিত হতদরিদ্র মানুষের জন্য। সেই কথা স্মরণ করে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার প্রেরণা জোগায়। তিনি মায়ের নামে মির্জাপুরে ‘কুমুদিনী হাসপাতাল’(১৯৩৩) প্রতিষ্ঠা করেন।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিজে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হলেও নারীশিক্ষার জন্য তিনি কুমুদিনী চত্বরের ভেতরেই ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস। প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী নার্সিং স্কুল। বাবার নামে মানিকগঞ্জে ‘দেবেন্দ্র কলেজ’প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজ, মির্জাপুর সদয়কৃষ্ণ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, করটিয়া সা’দত মহাবিদ্যালয়, ভূঞাপুর ইবরাহীম খাঁ কলেজ, মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজসহ টাঙ্গাইলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার দান অপরিসীম। তিনি তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কল্যাণধর্মী ও জনহিতকর কাজের স্বার্থে একটি ট্রাস্টভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৯৪৪ সালে গঠন করেন ‘কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’। ট্রাস্টের লভ্যাংশ থেকে শুধু নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ ব্যয় ছাড়া সবটুকুই মানুষের কল্যাণে, শিক্ষা বিস্তারে ও সেবামূলক কাজে ব্যয় করেছেন। বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় (১৩৫০ বাং) রেডক্রস সোসাইটিকে এককালীন তিন লাখ টাকা দান এবং ক্ষুধার্তদের জন্য চার মাসব্যাপী সারা দেশে ২৫০টি ফ্রি-কিচেন খোলা রাখেন।
১৯৭১ সালের ৭ মে রাত ১১টায় তার নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে দেশীয় সহচরের সহযোগিতায় পাকবাহিনী দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাসহ ধরে নিয়ে যায়। তার পর থেকে তাদের আর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকার তার সম্মানার্থে ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত সব প্রতিষ্ঠান আজও তার অমর কীর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখান থেকে যুগ যুগ ধরে মানুষ সেবাসহ নানা উপকার পেতে থাকবে। তার কর্মের মাঝেই এ দানবীর হয়ে থাকবেন চির অমর।
আগামী প্রজন্মকে জানতে হবে রণদা প্রসাদ সাহা কে ছিলেন? কীভাবে তিনি একজন দানবীরে রূপান্তরিত হলেন। সাহসের সঙ্গে জীবনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেছেন। দেশের মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদন করেছেন।
রণদার মোট চার সন্তান বিজয়া, জয়া, দুর্গপ্রসাদ ও ভবানী।
রণদা প্রসাদ সাহাকে নিয়ে সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফর চৌধুরী ‘ব্যক্তি নন, তিনি এখন একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘রায় বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহা তো প্রয়াত হননি, দিন দিন তার ব্যক্তিত্বের বিশাল প্রসারতা ঘটছে। তার অস্তিত্বের পরিধি বাড়ছে। ব্যক্তি যখন নিজের সাধনায় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন, তখন তার মৃত্যু হয় না, তার মৃত্যু ঘটাতে কেউ পারে না। শহীদ আর পি সাহার বেলায়ও এ সত্যটি প্রমাণ পেয়েছে।’
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতিটি উক্তিই সত্য। রণদা প্রসাদ সাহা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তার গড়ে তোলা একেকটি প্রতিষ্ঠান আজও মানুষের স্বপ্ন পূরণ করে যাচ্ছে। এভাবেই তিনি ব্যক্তি থেকে একেকটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন।‘রণদা প্রসাদ সাহার স্মৃতি’প্রবন্ধে আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘রণদা প্রসাদ সাহাকে যখন পাকিস্তানি সেনারা মেরে ফেলে, তখন মনে হয় এই প্রশ্ন জেগেছিল যে মানুষটি দেশবাসীর কল্যাণের জন্য এত কিছু করেছেন, এত সৎ উদ্যোগে সাহায্য করেছেন, তাকে হত্যা করা কেন অনিবার্য বলে তারা বিবেচনা করেছিল? তিনি হিন্দু বলে? বাঙালি বলে? উদ্যোক্তা বলে? দানবীর বলে?’
অসামান্য অবদানের কারণে নিশ্চয়ই তার স্মৃতি কখনো ম্লান হবে না। ধন্য হে কীর্তিমান পুরুষ। তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহান। রণদা প্রসাদ সাহার অবিনশ্বর স্মৃতিতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই|
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ সেপ্টেম্বর২০১৪/রণজিৎ/এএ
রাইজিংবিডি.কম