ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘এই পেসাররা যে কোনো কন্ডিশনে বাংলাদেশকে জেতাতে পারে’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ১৪ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ০৭:৪৮, ১৫ আগস্ট ২০২১
‘এই পেসাররা যে কোনো কন্ডিশনে বাংলাদেশকে জেতাতে পারে’

মোস্তাফিজুর রহমানকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন ওটিস গিবসন যেন তাকে রাজ্য জয়ের স্বাদ দিয়েছেন! দুজনের চোখাচোখিতে সে কি হাসি! মুখে প্রাপ্তির ঝিলিক। অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর তৃপ্তি এমন হবে স্বাভাবিক নয় কি?

বাংলাদেশের পেস আক্রমণে বইছে সুবাসিত সুবাতাস। যার নেপথ্যে পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসন। সম্প্রতি দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পেসারদের সাফল্য প্রশংসিত হচ্ছে সর্বত্র। এর আগে জিম্বাবুয়ে সফরেও পারফরম্যান্সের ডানা মেলে ধরেছেন তারা।

পেস বিভাগের বাঁকবদলের কারিগর মুখোমুখি হয়েছিলেন রাইজিংবিডির। তার সঙ্গে কথা বলেছেন  ইয়াসিন হাসান।

রাইজিংবিডি: শেষ দুইটি সিরিজে পেসারদের পারফরম্যান্স কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ওটিস গিবসন: বাংলাদেশের পেসাররা দেশের পরিবর্তে বিদেশের মাটিতে ভালো করবে এমন প্রত্যাশা করা হয়। এখানকার কন্ডিশনের কারণে এমনটা হয়েছে। তবে এমন ভাবনা অহেতুক তৈরি হয়েছে। জিম্বাবুয়েতে ছেলেরা কিন্তু দারুণ কাজ করেছে। শুধু যে টেস্ট ম্যাচে ভালো করেছে এমনটা নয়, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতেও তারা সফল। তাসকিন টেস্ট এবং ওয়ানডেতে দুর্দান্ত বোলিং করেছে। ঘরের মাঠে আমরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জিতেছি যা বিশাল অর্জন। এ সিরিজে মোস্তাফিজ ছিল একেবারে বিশ্বমানের। যেভাবে বোলিং করেছে, কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে নিজের সামর্থ্য দেখিয়েছে...এক কথায় অবিশ্বাস্য ও বিশ্বমানের বোলিং। শরিফুল পরিণত এবং সুন্দরভাবে বিকশিত হচ্ছে। ছয় মাসেরও কম সময় হলো জাতীয় দলে এসেছে। কিন্তু স্বল্প সময়ে ভালো কাজ করেছে। তার স্কিলের উন্নতি হচ্ছে।

রাইজিংবিডি: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে পেসারদের বড় ভূমিকা ছিল। মোস্তাফিজ ও শরিফুল দাপটের সঙ্গে পারফর্ম করেছে। স্পিনারদের উপরও তারা চাপ কমিয়েছে নিশ্চয়ই…

ওটিস গিবসন: আমি মনে করি না আন্তর্জাতিক বা ঘরোয়া ক্রিকেটে কেউ কাউকে চাপে রাখে বা অন্য কারো উপর নির্ভর করে। এটি একটি সুযোগ যা তাদের অধিকাংশ গ্রহণ করে। স্পিনাররা খুব ভালো বোলিং করেছে। বিশেষ করে এই উইকেটে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে যে ধারাবাহিকতার দরকার ছিল সেটা তারা ভালোভাবে করেছে। যখন আপনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেন তখন একদল খেলোয়াড় বর্তমান খেলোয়াড়দের উপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তারা একই ফলের জন্য একসাথে কাজ করে, দলের জন্য জয়। তাই পেসার এবং স্পিনাররা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে। এটি কেবল স্পিনারদের জন্য আসেনি, উভয়ের অবদান ছিল। 

রাইজিংবিডি: তৃতীয় ম্যাচে মোস্তাফিজের বিশেষ ১৯তম ওভারের কথাই যদি বলি, সেই ওভারটিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন। এতোটা কঠিন পরিস্থিতিতে মাত্র ১ রান দেয়া…

ওটিস গিবসন:  হ্যাঁ নিশ্চিতভাবেই ওই ম্যাচটা এমন ছিল যেখানে মোস্তাফিজ তার সামর্থ্য দেখিয়েছে এবং প্রমাণ করেছে সীমিত পরিসরের ক্রিকেটে সে বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন বোলার। সেদিন কন্ডিশন ভালোভাবে মূল্যায়ন করেছে। এরপর নিজেই ঠিক করেছে তার কি করতে হবে। বেশিরভাগ সময়ই সে কাটার দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের সেসব কাটারের উত্তর জানা ছিল না। যা বাইরে থেকে দেখতে অসাধারণ লাগছিল।

রাইজিংবিডি: এ সব মুহূর্তে যখন বোলাররা জিতে যায় তখন কোচ হিসেবে কতটা আনন্দিত হন?

ওটিস গিবসন: আমরা সেইরকম মুহূর্ত তৈরি করে অনুশীলন করি। আমরা অনুশীলনে অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করি। ছেলেরা যখন মাঠে যায় এবং আমরা যে পরিকল্পনাগুলি করেছি তা বাস্তবায়ন করতে দেখে খুব ভালো লাগে। আমি বোলারদের কন্ডিশন মূল্যায়ন করে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করি। তারপর নিজেদের স্কিল অনুশীলন ঠিক চূড়ান্ত করি। প্রতিদিন আমরা সেই স্কিল চর্চায় মনোনিবেশ করি। কাটার, ইয়র্কার, বাউন্সার, স্লোয়ারের অনুশীলন করা হয় নিত্যদিন। অনুশীলনগুলি মাঠে দেখতে পারা আনন্দদায়ক।

রাইজিংবিডি: মোস্তাফিজ সিরিজে ১০২ বল করেছে। তার ৫৮ বলই ছিল ডট। রান দিয়েছে মাত্র ৬০। আপনি কি মনে করেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে উইকেট নেওয়ার থেকে ডট বলা করা বেশি কার্যকরী?

ওটিস গিবসন:  আসলে ডট বল উইকেটের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। আপনি যদি উইকেট নিতে না পারেন তাহলে আপনাকে ডট বল দিতে হবে এবং প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে হবে। মোস্তাফিজের ক্ষেত্রে সিরিজে যেটা হয়েছে, সে তার বোলিংয়ে বাউন্ডারি হতে দেয়নি। এটা ছিল তার বোলিংয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক। অবশ্যই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ডট বল বিশাল কিছু।

রাইজিংবিডি: তবে দেশে বাইরে মোস্তাফিজ কি এতোটাই কার্যকর হবে। আমরা আগে দেখেছি, কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলে মোস্তাফিজ খুব বিবর্ণ। সেসব জায়গায় উন্নত করার কাজটা কিভাবে করছে?

ওটিস গিবসন:  এ জায়গায় তার আরও উন্নতি করতে হবে। সে সব জায়গায় তার পছন্দের কন্ডিশন পাবে না। তাকে ওই কন্ডিশনে টিকে থাকতে হলে নিজের সামর্থ্য বাড়াতে হবে। আমরা সেটা নিয়েই কাজ করছি। আগের থেকে সে আরও উদ্যমী হয়ে উঠেছে। প্রচুর খাটছে নিজের বোলিংয়ে। ভাবনায় পরিবর্তন এনেছে। বোলিং নিয়ে চিন্তা করে। কিভাবে করলে আরও ভালো হবে। এগুলি উন্নতির লক্ষণ। যেমন সুইং করানো, ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের বল ভেতরে ঢোকানো, বাউন্সার, ইয়র্কার এসব নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি শিগগিরিই ভালো পরিবর্তন দেখা যাবে দেশের বাইরেও।

রাইজিংবিডি: সাইফ উদ্দিন নাকাল বল করার চেষ্টা করে সফল হয়েছে। নাকাল বলের কার্যকারিতা কেমন দেখছেন?

ওটিস গিবসন:  দেখুন, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নিজস্ব দক্ষতা আছে। মোস্তাফিজের দক্ষতা কাটারে গড়ে উঠেছে। সাইফ উদ্দিন নাকাল বল ও স্লোয়ার নিজেকে গড়েছে। শরিফুল নিজেকে মোস্তাফিজুর রহমানের মতো করে গড়ে তুলছে। সে কাটার শিখছে। সিরিজেও কিছুটা করে দেখিয়েছে। তবে আমি প্রত্যেককে কন্ডিশন দেখে সিদ্ধান্ত নিতে বলি। কোন ধরণের বোলিং কার্যকর হবে সেটা করতে বলি। মোস্তাফিজ কিন্তু জোর দিয়ে বোলিং করেনি। পেসারদের মধ্যে ছিলো মন্থরতম। সে কাটার চেষ্টা করেছে এবং সফল হয়েছে। দেখুন অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের বোলিংয়ে গতি ছিল। আমাদের ব্যাটসম্যানরা সেই সুবিধা নিয়েছে এবং রান করেছে। এটা আমাদের সকলের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয়। কন্ডিশন অনুযায়ী প্রত্যেকে স্কিলের ব্যবহার করা উচিত। যদি কন্ডিশন কাটার ব্যবহারে নিখুঁত না হয় তবে সেটা ব্যবহার করা যাবে না। যদি নিখুঁত হয় তাহলে একটানা ব্যবহার করুন।

রাইজিংবিডি: তাসকিন এখন নিজেকে ফিরে পেয়েছে। বোলিংয়ে ধার বেড়েছে। তাকে আরো ভালো হতে হলে, প্রতিপক্ষের জন্য হুমকি হতে হলে কোন জায়গায় উন্নতি করার প্রয়োজন বলে মনে করছেন?

ওটিস গিবসন:  তাসকিন নিজেকে তৈরি করেছে বর্তমান অবস্থায় আসতে। অতীতে সে ধাক্কা খেয়েছে সেখান থেকে শিখেছে নিজেকে পরিবর্তন করেছে। এ পরিস্থিতিতে তাসকিন আমাদের সম্পদ। সেটা লাল ও সাদা বলের ক্রিকেটেও। ওর শক্তির জায়গা গতি। সুইং নিয়ে কাজ করে সফল হয়েছে। ব্যাটসম্যানকে পড়তে পারছে। সঙ্গে আগ্রাসনও আছে। আমরা নিউ জিল্যান্ডে দেখে কতটা কার্যকরী বোলিং করেছে সে। নিজেকে আরেকধাপ এগিয়ে নিয়ে তাসকিনকে মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকতে হবে। বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনতে হবে। লাল ও সাদা বলের ক্রিকেট এক নয়। সাদা বলে অনেক সময় গতিতে কাজ হয় না। এখানে বৈচিত্র্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে আটকে রাখতে হবে। এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। আশা রাখছি দ্রুত সময়ে ফল পাওয়া যাবে।

রাইজিংবিডি: তরুণ শরিফুল ইসলামকে বেশ উদ্যমী মনে হচ্ছে। বল হাতে সাফল্য পাচ্ছে। তার ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

ওটিস গিবসন:  উদীয়মান পেসারদের মধ্যে শরিফুল বেশ ভালোভাবে নজর কেড়েছে। তার নতুন জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেশি। শিখতে আগ্রহী। মোস্তাফিজের থেকে কাটার শিখছে। তাসকিনের সঙ্গে কথা বলে গতি বাড়াচ্ছে। এটা যে কোনো দলের জন্য খুব আশার খবর যে, দলের ভেতরে সতীর্থরা একে আরেকজনকে এগিয়ে নিচ্ছে। শরিফুল এখনও তরুণ। মনের আনন্দে বড় হচ্ছে। তাকে জোর দিয়ে কোনো ছকের মধ্যে ঢোকানো যাবে না। বড় হবে, আরও শিখবে। তাতে আরও উন্নত হবে।

রাইজিংবিডি: ভালোমানের পেস ইউনিট তৈরি হয়েছে। মোস্তাফিজ, শরিফুল, তাসকিন আছে। সঙ্গে রুবেল, হাসান মাহমুদ রয়েছে। ২০২৩ বিশ্বকাপে পেস বোলিং আক্রমণ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী।

ওটিস গিবসন:  নিশ্চিতভাবেই, ২০২৩ বিশ্বকাপ উপমহাদেশে অনুষ্ঠিত হবে (ভারত) এবং আমাদের জন্য বড় সুযোগ বটে। বিশ্বজুড়ে সব কন্ডিশনে ভালো করতে আমরা পেসারদের তৈরি করে যাচ্ছি। আশা করছি, ২০২৩ সালের মধ্যে ছেলেরা আত্মবিশ্বাস পাবে এবং কোচ ও নির্বাচকরা আমাদের এই মূল পেস বোলারদের গ্রুপের প্রতি আস্থা রাখবেন। আমি বিশ্বাস করি এই ছেলেরা যে কেউ যে কোনো কন্ডিশনে গিয়ে বাংলাদেশকে জেতাতে পারে। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। আশা করি ২০২৩ সালের মধ্যে সবাই ভালো থাকবে, ফিট থাকবে, সুস্থ থাকবে এবং এ সময়ে আমরা উইনিং কম্বিনেশন তৈরি করতে পারবো।

রাইজিংবিডি: পেসারদের যত্ন নেওয়া খুব জরুরী ক্যারিয়ারের জন্য। তাদের কাজের পরিধি নির্দিষ্ট করার কাজটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনি রোটেশন করে খেলানোর পক্ষে কি না?

ওটিস গিবসন:  হ্যাঁ, ফাস্ট বোলারদের অধিকাংশ দল এটি অনুসরণ করে। আমরা কত ম্যাচ খেলেছি তা দেখুন এবং আমাদের মাত্র ৫-৬ জন আন্তর্জাতিক মানের বোলার আছে এবং তিনটি ফরম্যাটেই তারা খেলছে। তাই কোন ফরম্যাটে কে খেলবে তা নির্ধারণ করে বোলারদের বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনি কীভাবে তার থেকে সর্বাধিক উপকার পাবেন, তাকে সর্বদা সতেজ এবং দলের জন্য ফিট রাখবেন সেটা ভাবনা জরুরী। 

রাইজিংবিডি: শেষ প্রশ্ন, পেস বোলিং অনেকটাই কন্ডিশনের উপর নির্ভর করে। নিউ জিল্যান্ডে তাসকিন গতি পেয়েছিল। বাউন্স পেয়েছিল। এখানে মোস্তাফিজে স্লোয়ার দুর্বোধ্য ছিল। কন্ডিশন অনুকূলে না হলে আপনি কিভাবে পেসারদের সাফল্য পেতে পরামর্শ দেন। তারা নিজেরা আউট অব বক্স কিভাবে চিন্তা করে…

ওটিস গিবসন: আমি যেমনটা আগে বলেছি, ভিন্ন কন্ডিশনে সাফল্য পেতে আমি খেলোয়াড়দের স্কিল উন্নতির কাজ করছি। যখন আমরা বিদেশে যাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা কন্ডিশন মূল্যায়ন করার চেষ্টা করি। তারপর সেখানে কোন পরিকল্পনায় বোলিং করা ঠিক হবে সেটা চূড়ান্ত করি। এখানে স্লোয়ার ও কাটার কার্যকর। নিউ জিল্যান্ড বা ইংল্যান্ডে সুইং বোলিং প্রয়োজন। পেসারদের দিন শেষে তাদের স্টক বলের উপর নির্ভর করতে হয় এবং ধারাবাহিকতা যে কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আমাদের মূল কাজগুলিকে একত্রিত করে সাফল্যের জন্য লড়াই করতে হবে।  কখনও কখনও তারা উইকেট পাবে না। কিন্তু তাদেরকে রান তোলার পথ বন্ধ করতে হবে। চাপে রাখতে হবে। আমি সব সময় ছেলেদের এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করি।

ঢাকা/রিয়াদ 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়