অঝোরে কাঁদলেন তামিম, মনে করলেন প্রিয় বাবাকে
সাইফুল ইসলাম রিয়াদ, চট্টগ্রাম থেকে || রাইজিংবিডি.কম
কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না তামিমের
চোখ ভয়ঙ্কর রকমের লাল। ছলছল করছে পানি। অন্যদিকে চট্টগ্রামের টাওয়ার ইন হোটেলের কনফারেন্স কক্ষে ব্যাপক কোলাহল। সংবাদকর্মীদের আনাগোনায় খালি নেই এক ইঞ্চি জায়গাও। পরিস্থিতি শান্ত হচ্ছে না দেখে তামিম ইকবাল নিজেই এগিয়ে আসলেন, ‘আচ্ছা ভাই আওয়াজ কম করেন। আমার জন্য বলাটা সহজ হবে।’
তামিমের কথা শোনে কে? এক পর্যায়ে তামিম আবার বলেন, ‘ভাইয়া আমি উঠে চলে যাবো’?
একটু শান্ত হতে তামিম কথা শুরু করলেন, দিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা। ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিকই ছিলেন ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সাবেক ক্রিকেটার হয়ে যাওয়া তামিম। যখনি বাবার কথা বলতে গেছেন, তখন তামিম আর নিজেকেই শান্ত রাখতে পারলেন না। মাথা নিচু করে কেঁদেছেন অঝোরে। পাশে থেকে একজন এগিয়ে দেন টিস্যু। কোলাহলপূর্ণ হলে নেমে এসেছে পিনপতন নীরবতা আর সঙ্গে তামিমের কান্নার শব্দ পরিস্থিতি শোকাবহ করে তোলে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার কথা বলতে গিয়ে তামিম কান্নায় ভেঙে পড়েন। দফায় দফায় বাবার কথা বলতে গিয়ে তামিম বারবার চোখ ভিজিয়েছেন চোখের জলে। অবশেষে ভেঙে ভেঙে তামিম বলেন, ‘আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাতে হবে আমার, যেটা আমার মনে হয় আপনাদের প্রাপ্য। আমি সবসময় একটা কথা বলেছি যে, খেলাটি আমি খেলেছি (কান্না…)… সবসময় বলেছি, ক্রিকেট খেলি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য (কান্না)… সবসময় বলেছি, ক্রিকেট খেলি বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য। নিশ্চিত নই, আন্তজার্তিক ক্রিকেটে এই ১৬ বছরে আমি তাকে গর্বিত করতে পেরেছি কি না..।’
শুধু বাবা নয়, চাচা আকবর খান, ছোট বেলার কোচ তপনের কথা আসতেই ভেঙে পড়েন তামিম, ‘আরও অনেককে ধন্যবাদ জানাতে হবে আমার। সবচেয়ে ছোট চাচা, যিনি ইন্তেকাল করেছেন, আকবর খান… উনার হাত ধরেই আমার প্রথম ক্রিকেট বলের টুর্নামেন্ট খেলা। তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে তপন দা নামে একজন কোচ আছেন, যিনি ছোটবেলা থেকে (কান্না আবারও)… তার কাছে ছোটবেলা থেকে অনুশীলন করেছি। তাকে ধন্যবাদ জানাই।’
যে সময়ে তামিম অবসরের ঘোষণা দিচ্ছিলেন ঠিক তার ২৪ ঘণ্টা আগে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের টস করেছিলেন। ম্যাচ শেষে রাতেই অবশ্য তিনি অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন দুপুর ১২টায়। যেটি পরে দেড় ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়।
কালো টি-শার্ট, মাথায় ক্যাপ পরা তামিম অবসরের ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আমি খুব বেশি বড় করব না। ছোট রাখার চেষ্টা করব। গতকাল আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিই আমার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এই মুহূর্তেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছি।’
‘এটার পেছনে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এটা নিয়ে ভাবছিলাম আমি... এটার ভিন্ন ভিন্ন কারণ আছে, যেটা আমার মনে হয় না এখানে বলার দরকার আছে। এটা না যে হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বেশ কিছুদিন ধরেই কথা বলছিলাম, এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলছিলাম। আমার মনে হয়েছে, আমার সরে দাঁড়ানোর ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের উপযুক্ত সময় এটিই’ -আরও যোগ করেন তামিম।
আফগানদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এমন পরিস্থিতির সূত্রপাত। তামিম জানিয়েছেন তিনি শতভাগ ফিট নন। প্রথম ম্যাচ খেলে তিনি দেখতে চান। এই বক্তব্য নিয়ে অনেক জলঘোলা হয়। ক্ষিপ্ত হন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। এরপর এলো এই ঘোষণা। শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে ২১ বলে ১৩ রান। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ হারে ১৭ রানে। নিজেদের বাড়ির মাঠে শেষটা রাঙাতে পারলেন না। বিদায় নিলেন অশ্রুজলে, মনে অনেক কষ্ট রেখে।
তামিম বলেন, ‘আমার আসলে বেশি কিছু বলার নেই। আমি চেষ্টা করেছি, সত্যিই নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি (কান্না…)… হয়তো আমি যথেষ্ট ভালো ছিলাম না, কিংবা ভালো ছিলাম না… জানি না, তবে যখনই মাঠে নেমেছি, নিজের শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
‘আরও অনেক কিছু আছে… অনেক কিছু বলতে চাই আসলে। তবে আপনারা যেমন দেখছেন, কথা বলতে পারছি না…। আশা করি, আপনারা এই পরিস্থিতিকে সম্মান করবেন (কান্না)… কথা বলার জন্য পরিস্থিতিটা সহজ নয়। বিশেষ করে, এত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পর যখন ছেড়ে দিচ্ছি, কাজটা সহজ নয়। আশা করি, আপনারা তা অনুধাবন করবেন। আমি দুঃখিত যে এত শর্ট নোটিশে আপনাদেরকে ডাকা হয়েছে। সব সংবাদমাধ্যমকে ধন্যবাদ জানাই’ -আরও যোগ করেন তামিম।
প্রায় দেড় যুগের ক্যারিয়ারে তামিম খেলেছেন ৭০টি টেস্ট, ২৪১টি ওয়ানডে ও ৭৮টি টি-টোয়েন্টি। রান করেছেন যথাক্রমে ৫১৩৪, ৮৩১৩ ও ১৭৫৮ রান। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামে টি-টোয়েন্টি থেকে বিশ্রাম নেন, শেষ পর্যন্ত আর ফেরেননি। এক ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে নেন বিদায়। এবার বিদায় দিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। মাশরাফির পর ওয়ানডেতে নেতৃত্ব পান তিনি। নেতৃত্ব দেন ৩৭টি ম্যাচে। নেতা তামিমের ব্যাট থেকে আসে ১১৩২ রান।
নিজের চেষ্টার কোনো কমতি রাখেননি জানিয়ে তামিম বলেন, ‘আমার দিক থেকে, আবারও একটি কথা বলছি, নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, সবটুকু দিয়েছি। আবারও একটি কথা পুনরাবৃত্তি করি, আমি ক্রিকেট খেলা শুরু করেছি আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। জানি না কতটা পেরেছি, তবে চেষ্টা করেছি নিজের সেরাটা দিয়ে।’
তামিম চান তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ে যাতে আর কোনো আলোচনা না হয়, ‘এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলার নেই। একটাই অনুরোধ করব যে, আমার টপিক এখানেই শেষ করে দিন। অন্তত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য। এটাকে নিয়ে আর বেশি গুতোগুতি করবেন না, কেন বা কী, কী হতে পারত, না হতে পারত। এটার সমাপ্তি টেনে দিন। সবসময়ই বলেছি, যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে দল সবসময়ই বড়। দলের দিকে মনোযোগ দিন। এই সিরিজে আরও দুটি ম্যাচ আছে, যে সিরিজ আমাদের জেতা উচিত বলেই বিশ্বাস আমার। এরপর বড় দুটি ট্রফি আছে (এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ)।’
ঢাকা/আমিনুল