ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভরত রাজার দেউলে আমাদের আনন্দযাত্রা

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৯, ২৭ জানুয়ারি ২০২২  
ভরত রাজার দেউলে আমাদের আনন্দযাত্রা

সকালটাই ছিল বিস্ময়ে ভরপুর! হালকা কুয়াশায় চারদিকে মিষ্টি ঠান্ডা। খুব ভোরে অরুণিত ভোরের ফোন- তোমরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু আসতে পারো।

ঘড়ির দিক তাকিয়ে দেখি ৬টা বাজে। শীতের সকালে এতো ভোরে ও বাইরে গেলো কখন? ভাবতে ভাবতেই উঠে দুজন রওনা হলাম। ভোরের ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে যথারীতি বিস্ময়ে দুজনেই চুপ হয়ে গেলাম! কেউ কোথাও নেই, প্রতি গাছে বেলুন আর নানান রঙের কাগজ দিয়ে সাজানো, বড় করে দুগাছের মাঝখানে আর্ট পেপারে রঙিন কাগজে লেখা ‘শুভ জন্মদিন বাবাই’।

তিনজনে বেশ ভোরবেলা কাটলো। ভোর সাইকেল নিয়ে এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে রাইডিং-এ যাবে। আমাকে বললো বাবাইকে এবার তোমার সারপ্রাইজ করার পালা। আমি ভাবতে লাগলাম ওকে কোনো নতুন জায়গায় নিয়ে যাবো। এটাই হবে একমাত্র উপহার। বাংলাদেশের প্রায় সব দেখা লোককে নতুন কোথায় নিয়ে যাই ভাবতে ভাবতে মনে হলো- ভরত দেউলের রাজাবাড়ি যে বৌদ্ধমন্দির সেখানে নিয়ে যাই। কৌশলে জানতে চাইলাম তুমি ভরত ভয়না চেনো? বলল- নাম শুনেছি, কোনোদিন যাইনি।

চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যাম্পাসের হোটেলে তিনজন পরোটা, ডিম দিয়ে নাস্তা শেষে চলে এলাম গল্লামারি মহেন্দ্র স্ট্যান্ডে। লোকাল মহেন্দ্রতে ভাড়া করে নিলাম চুকনগর পর্যন্ত। চুকনগর বধ্যভূমিতে যাবো সে ভেবেছিল। আমি বললাম- আজ না, আজ অন্য কোথাও। 

চুকনগর স্ট্যান্ড থেকে চা পান শেষে ভ্যান ভাড়া করলাম। কেশবপুর উপজেলায় ভরত ভায়না গ্রাম বলতেই উৎসুক ভ্যানওয়ালা বলল- ও মন্দিরে যাইবেন। তার কথা মতো রওনা হলাম। কিন্তু বিপত্তি হলো এর আগে আমি প্রাইভেট কারে যে পথে এসেছিলাম গ্রামের পথ হওয়ায় গুলিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের অন্য মন্দিরে নিয়ে যাওয়ায় একটু ভড়কে গিয়ে বললাম- এটা তো না! তারপর আমার মুখে বর্ণনা শুনে সে বলল- আগে তো কইবেন, বুঝছি, ওডা তো ভরতের দেউল। বুঝলাম বৌদ্ধমন্দির বলা ঠিক হয় নাই। এরপর সেই কাকুই আমাদের নিয়ে গেলেন। 

অসাধারণ গ্রামের মেঠো পথ! দুপাশে গাছ। মাঝখানে সরু রাস্তা। ভ্যান থামিয়ে খেজুরের রস ছিল বোনাস। দেখতে দেখতে আমরা মিকশিমিল সড়ক ধরে ভদ্রা নদীর সেতুর ওপর চলে এলাম। ভ্যানকাকু সব চিনিয়ে দিচ্ছিলেন। বললেন দেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে আমাদের সঙ্গে থাকবে। দেখা হলে আমাদের পুনরায় চুকনগর স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেবেন। শুনে হাসতে হাসতে বললাম- তাহলে দুপুরে কী খাবো? ওমনি চটপট উত্তর- ক্যা! আমার বাড়ি খাইবেন। 

কথা বলতে বলতে একটু ভাঙ্গা রাস্তায় পড়লাম। প্রায় তিন কিলোমিটার; তারপরেই দেখা গেলো লাল রঙের দেয়াল। অসংখ্য গাছগাছালি, বাঁশবাগান আর পাখির কলরব। দেউলের চূড়া নজরে পড়লো। আঙুল দিয়ে ভ্যানকাকু দেখালেন- উই যে ভরতের দেউল।  

খুলনা-যশোর সীমান্তে কেশবপুর উপজেলা থেকে ১৯ কি.মি. দূরে, বুড়িভদ্রা নদীর  পশ্চিম তীরে  প্রায় ৪০০ মিটার পশ্চিমে ভরত ভায়না গ্রাম। সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আনুমানিক দেড় হাজার বছরেরও বেশি আগের এক পুরাকীর্তি। অনেকটা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতো দেখতে এই প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনটি স্থানীয় জনগণের কাছে দীর্ঘদিন ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এখানকার ব্যবহৃত ইট ও প্রাপ্ত বিভিন্ন পোড়ামাটির মূর্তি গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন এটি খ্রিস্ট্রীয় তিন থেকে ছয় শতকে  নির্মিত একটি মন্দির। জানামতে, ভরত ভায়না মন্দির দক্ষিণ বঙ্গের একমাত্র আদি ঐতিহাসিক যুগের স্থাপনা।

১৯২২ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ এই ঢিবি সংরক্ষণ করে। ১৯২৩ সালে কশিনাথ দীক্ষিত ঢিবিতে জরিপ পরিচালনা করে মন্তব্য করেন- ঢিবির নিচে পাঁচ শতকের প্রাচীন একটি বৌদ্ধমন্দির আছে এবং এটি সম্ভবত হিউয়েন-সাং বর্ণিত সমতটের ৩০টি সংঘারামের একটি। সে সময় তিনি কিছু সীমানা পিলারও দেন। সুযোগসন্ধানী মানুষ বিভিন্ন সময়ে সেই সব মূল্যবান সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে। মন্দিরটি ভরত নামধারী এক প্রভাবশালী রাজা নির্মাণ করেছিলেন বলে প্রচলিত। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৫ সালে প্রথম এই ঢিবি খনন করে। খনন এখনো শেষ হয়নি। খননের ফলে একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা থেকে অনুমান করা হয় যে স্থাপনাটির উপরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানের দৃশ্যমান অংশ সম্ভবত বিনষ্ট হওয়া অট্টালিকার ভিত্তি বা উঁচু মঞ্চ।

মূল মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশপথ আছে। এগুলোর মধ্যেও এখন পর্যন্ত সাতটি প্রকোষ্ঠ দেখা গেছে। গঠনশৈলী বিবেচনায় পূর্ব দিকটাই এর মূল প্রবেশপথ ছিল বলে ধারণা করা হয়। স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও গুপ্তযুগের একটি পোড়ামাটির মাথা, পোড়ামাটির মানুষের হাত ও পায়ের কয়েকটি ভগ্ন টুকরা, কয়েকটি মাটির প্রদীপ, অলংকৃত ইটের টুকরা, পদচিহ্ন-সংবলিত দুটি ইটের টুকরা এবং একটি মাটির ক্ষুদ্র পাত্র সংগৃহীত হয়েছে, যা খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে রক্ষিত আছে। 

দেউল প্রাঙ্গণে আছে বিশাল এক বটগাছ। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম বটগাছ ডালে কতগুলো কিশোর-কিশোরী ঝুলছে। ওদের সঙ্গে কথা বলতেই ওরা নিচে নেমে এলো। যশোর মাধ্যমিকে ওরা পড়ে। আজ শুক্রবার স্কুল বন্ধ। তাই সাইকেল চালিয়ে এই দেউল বা বৌদ্ধমন্দির দেখতে এসেছে। এর মধ্যে নাখাল নামে ছেলেটির নানু বাড়ি পাশেই, সবাই ওই বাড়িতে দুপুরে খাবে। আমরা আবারও নিমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম। নাখাল আরও গল্প শোনালো। এই দেউলে নাকি ভাঙ্গা ঢিবির নিচে ভূত থাকে, ওর নানা সেই ভূত দেখে খবর দিলে বিজ্ঞানীরা এসে খনন করে এইসব পুরার্কীতি ফীর্তি বের করছে। 

আরও গল্প হলো এখান থেকে কিছু দূর গিয়ে এরকম আরও আছে, সেখানেও এরকম বট গাছ যেখানে ভূত থাকে। তাই গ্রামের মানুষ প্রতিবছর পুজো দেয়। মূল ব্যপার এই ভরত ভয়না মন্দির থেকে অদূরে ভিখুদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন রাজা দেউল। যা প্রায় মাটির নিচে। জানা গেছে ওখানেও খনন করা হবে। সেখানেও ছায়ার জন্য লাগানো হয়েছিল বটগাছ ও পানি সরবরাহের জন্য কুয়ো। এক একটি বটগাছের বয়স দেউলের প্রায় সমান। সব মিলিয়ে আমার সহযাত্রীর জন্মদিনের এই আনন্দযাত্রা আশা করি ভরত রাজার বাড়িতে ভালোই হয়েছে। তবে নাখালের নানার বাড়ি বা ভ্যানকাকুর বাড়িতে আমাদের দুপুরের খাবার করা হয়নি, আমরা ফেরার পথে খুলনার আরও একটি উল্লেখযোগ্য চুকনগরের আব্বাসের হোটেলে চুইঝাল গরুর মাংস দিয়ে দুপুরে বেশ জমিয়ে খেয়েছিলাম। 

কীভাবে যাবেন

খুলনার দৌলতপুর থেকে ডুমুরিয়ার শাহপুর বাজার হয়ে সামনে মিকশিমিল সড়ক ধরে এগিয়ে ভদ্রা নদীর সেতু পার হয়ে কিছুদূর গেলেই ভরত ভায়না গ্রাম। কেশবপুর সদর থেকে এর দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের খর্ণিয়া বা চুকনগর হয়েও খুব সহজে ভরত ভায়না যাওয়া যায়। হাতে সময় থাকলে ফেরার পথে রুপসা নদীর ওপর খান জাহান আলী সেতুটিও দেখে যেতে পারেন। আর খাবেন অবশ্যই আব্বাসের চুইঝাল গরুর মাংস অথবা চুইঝাল খাসির মাংস দিয়ে গরম ভাত।

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়