ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দেখে এলাম অ‌্যামাজনের সবুজ অ্যানাকোন্ডা

রবিউল মিলটন, গায়ানা থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ১৩ জুলাই ২০২২   আপডেট: ২২:১০, ১৩ জুলাই ২০২২
দেখে এলাম অ‌্যামাজনের সবুজ অ্যানাকোন্ডা

গায়ানা চিড়িয়াখানায় অ‌্যামাজনের অ‌্যানাকোন্ডার খাঁচার সামনে লেখক।

দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলের দেশ গায়ানা। ১৫০ বছরের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন শেষে ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা পায় গায়ানা। দেশটির নামের চমৎকার একটি অর্থ আছে, ‘পানির দেশ’। 

উইন্ডিজ-বাংলাদেশের চলমান সিরিজের ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হচ্ছে গায়ানায়। গত পরশুদিন (১১ জুলাই) বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলে। তাই পরেরদিন করার মত কিছু ছিল না। 

এমনিতে গায়ানায় দেখার মত কিছু নেই। নেই ঘোরার মত কোনও ভালো স্পট। প্রথম আলোর তারেক ভাই একদিন বলেছিলেন, গায়ানা চিড়িয়াখানায় নাকি আমাজনের অ্যানাকোন্ডা আছে। আরও আছে আমাজনের বিখ্যাত হারপি ঈগল। দেখে আসতে পারেন। প্রথমটা দেখা যেতে পারে ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম চিড়িয়াখানা দেখতে যাব। শুধুমাত্র অ্যানাকোন্ডা দেখতে। 

দেব চৌধুরী, রিয়াসাদ এবং নাহিয়ানসহ আমরা একই হোটেলে আছি। তিন জনই বাংলাদেশের নামকরা ক্রীড়া সাংবাদিক। তাদের বললাম, ‘কাল তো মনে হয় আপনারা ফ্রি আছেন। চলেন অ্যানাকোন্ডা দেখে আসি। আমাজনের কাছে এসে ওটা না দেখে গেলে বেচারা কোনদিন জানলে কী ভাববে!’

উনারা রাজি হয়ে গেলেন। সিনেমাতেই এই বিশালাকার সাপটি দেখেছি শুধু। এখন বাস্তবে দেখব। ১৯৯৭ সালে হলিউডে মুক্তি পায় ‘অ্যানাকোন্ডা’ নামের একটি মুভি। যদিও আমি অনেক পরে এটি টিভিতে দেখেছি। সিনেমায় যেভাবে সাপটিকে দেখানো হয়েছিলো, সেটা আসলে অবাস্তব লাগে। কিছু সিনেমা আছে টিভিতে চললে সামনে পড়লে দেখতে ইচ্ছে করে। অ্যানাকোন্ডাও তেমনই একটি সিনেমা। জেনিফার লোপেজ অভিনীত এই সিনেমার মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারি, এই নামে একটি বিশাল সাপ পৃথিবীতে আছে। যাইহোক, আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিলাম। খুব দূরে না, মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই চিড়িয়াখানায় পৌঁছে গেলাম। 

আমাদের দেশের মত এখানেও চিড়িয়াখানা আর বোটানিক্যাল গার্ডেন একইসাথে। সব দেশেই বোধহয় এমনটাই হয়। বিস্তৃত আর বড় জায়গাটিকে দুই ভাগ করে একভাগ চিড়িয়াখানার জন্য, অন্যভাগ বোটানিক্যাল গার্ডেনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। আমি শ্রীলঙ্কায়ও এমনটা দেখেছি। 

যাইহোক, আমরা চার জন ৮০০ ডলারে চারটি টিকিট কাটলাম। প্রতিজন দুইশ’ গায়ানিজ ডলার। বাংলাদেশের টাকায় একশ টাকা করে হয়। ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই  দেখলাম টিয়া পাখির খাঁচা। তবে সেটা যেনতেন টিয়া পাখি নয়। অ্যামাজনের টিয়া। সাইজে বেশ বড়সড়। 

দশ মিনিট ধরে হেঁটে নানারকম পাখি, বক, সারস, ম্যাকাও দেখছিলাম। এসবেরই রং, শারীরিক গঠন, ঢং সবই আমাদের দেশের পাখিদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। মানে এরা যে পৃথিবীর সবচাইতে বড় বনের প্রাণি তা এদের ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যায়।

গায়ানার চিড়িয়াখানা খুব একটা বড় নয়। বাংলাদেশের চিড়িয়াখানায় হরিণের যে খাঁচা তার দুইটার সমান বড়জোর হতে পারে। একে একে আমরা কুমির, কয়েক প্রজাতির বাঘের মধ্যে পুমা এবং জাগুয়ার দেখলাম। 

হঠাৎ দেব চৌধুরী বললেন, ‘আরে ওই দেখেন!’ আমরা সবাই তাকালাম। দেব বললেন, ‘এটা ঈগল, বিখ্যাত হারপি ঈগল!’ আমরা কাছে গিয়ে দেখলাম ওটাকে। এতগুলো জীবজন্তু দেখতে দেখতে এলাম যদিও, কিন্তু এই হারপি ঈগলের ব্যক্তিত্বটা সত‌্যিই অন্যরকম। আমরা চার জন মানুষ তার এত কাছে, ছবি তুলছি, হুসহাস করছি, কিন্তু সে তার আভিজাত্যপূর্ণ ভঙ্গিমা নিয়ে থম মেরে বসেই আছে। মনে হচ্ছে এলাকার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত তিনিই। কোনও নড়াচড়া নেই, কাউকে কোনও পাত্তাই দিচ্ছে না। 

এতকিছুর মধ্যেও আমি মনে মনে যে প্রাণিটিকে খুঁজছি অবশেষে পেলাম তার দর্শন। অ্যামাজনের বিখ্যাত সেই অ্যানাকোন্ডা। সময় নিয়ে দেখলাম আমরা। বেশ কয়েকটাকে দুটি খাঁচায় একসাথে রাখা হয়েছে। বড় সাইজের অ্যানাকোন্ডা খুঁজছিলাম আমি। কারণ, এই বস্তু ছোট দেখে শান্তি পাওয়ার কথা না। 

হঠাৎ দেখলাম বেশ বড়সড় একটা এনাকোন্ডা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। খাঁচার একেবারে শেষ প্রান্তে। খুব কাছ থেকে ওটাকে না দেখতে পাওয়ায় চোখের শান্তি আর হলো না। কাছেই যে মধ্যম সাইজের অ্যানাকোন্ডা দুটি ছিলো তাদেরই দেখলাম। 

অ্যানাকোন্ডার খাঁচার সামনে ছোট্ট সাইনবোর্ডে প্রাণিটি সম্পর্কে বেশ লম্বা বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে সেগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। সাপের ছবি তুললাম, খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আমিসহ সবাই স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তুললাম।

সাইনবোর্ড থেকে অ্যানাকোন্ডা সম্পর্কে যা জানা গেলো তা হলো- অ্যানাকোন্ডার শিকার ধরার পদ্ধতি অন্যান্য সাপের মত নয়। এটি তার শিকারকে ছোবল দেয় না। শিকারকে পেঁচিয়ে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলে। এরপর ধীরে ধীরে পুরো শরীরটাই গিলে ফেলে।

 

অ্যানাকোন্ডার কয়েকরকম প্রজাতির মধ্যে সবুজ অ্যানাকোন্ডাই বেশি ভয়ঙ্কর। এই সবুজ অ্যানাকোন্ডাই হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাপ। এটি সর্বোচ্চ ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ওজন হতে পারে ২২৭ কেজি পর্যন্ত। একটি পূর্ণবয়স্ক হরিণ, ভেড়া, ছাগল বা শুকর খাওয়ার পর অ্যানাকোন্ডা নাকি প্রায় এক মাস না খেয়ে থাকতে পারে। অনেকটা উটের মত। উট নাকি পানি না খেয়ে ছয় মাস বেঁচে থাকতে পারে। 

সৃষ্টির যে কত বৈচিত্র্য আমরা তার একহাজার ভাগের একভাগও হয়তো জানি না। নারী অ্যানাকোন্ডা পুরুষের চেয়ে আকারে বড় হয়। অন্যান্য সাপের সাথে অ্যানাকোন্ডার আরও একটি জায়গায় অমিল রয়েছে। অন্যান্য সাপ যেখানে ডিম পাড়ে, সেখানে অ্যানাকোন্ডা সরাসরি বাচ্চা জন্ম দেয়! 

একটা মা অ্যানাকোন্ডা একসাথে বিশ থেকে পঁচিশটি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করতে পারে। বাচ্চা অ্যানাকোন্ডা জন্মের সময়ই প্রায় দুই ফুট লম্বা হয়। তাছাড়া সেটি সাঁতারেও বেশ দক্ষ হয়। শুধু তাই নয়, এরা জন্মের সাথে সাথে শিকার ধরা শুরু করে। 

একটি অ্যানাকোন্ডা দিনে ২০ কেজি পর্যন্ত খাবার খেতে পারে। এর চামড়া এবং দাঁত অত্যন্ত দামী। তাই মানুষ গভীর জঙ্গলে গিয়ে অ্যানাকোন্ডা শিকার করে। আর এ কারণে এরাও মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।

লেখক : ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, ওয়ালটন গ্রুপ।

ঢাকা/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়