ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

অনিন্দ্য সুন্দর নেলসন 

রবিউল মিলটন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৪, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৩:৩৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩
অনিন্দ্য সুন্দর নেলসন 

মাত্র মিনিট পঞ্চাশের উড়োজাহাজ ভ্রমণ। নিউজিল্যান্ডের এক শহর থেকে আরেক শহরে এসেছি। কিন্তু আবহাওয়ার তারতম্য বড্ড বেমানান! নিউজিল্যান্ডের ডানেদিন থেকে এসেছি নেলসনে। মাত্র ৭৬৩ কিলোমিটারের দূরত্ব। কিন্তু আবহাওয়া? আকাশ পাতাল পার্থক্য!

ডানেদিনে সকালের নাস্তা শেষে যখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হই, তখনও কনকনে ঠাণ্ডা। গাড়িতে উঠে গুগলে দেখলাম তাপমাত্রা আট ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখনো বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা বা উত্তরবঙ্গের কোথাও এতো ঠাণ্ডা পড়েনি। ‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’ কথাটি আমাদের হলেও দেশে তাপমাত্রা এতোটা কমে না। অথচ নেলসন এয়ারপোর্টে নামতেই বাতাসে উল্টো সুর। দমকা হাওয়ার পরশে জ্যাকেট খুলে ফেলতে হলো। লাগেজ নেওয়ার জন্য বিমানবন্দরের নির্দিষ্ট জায়গার দিকে যেতে যেতে গরমের অস্বস্তি বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম। 

উড়োজাহাজ ছোট ছিলো বলে যাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিলো না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লাগেজ পেয়ে গেলাম। বিমানবন্দরে যতবারই লাগেজের জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছি ততবারই মনে অস্বস্তি চেপে বসেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাজে অভিজ্ঞতার স্মৃতি মনের অজান্তেই ভেসে ওঠে। গত বছর বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট সিরিজের স্পন্সর ছিলো বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। খেলাধুলায় এই প্রতিষ্ঠানের অবদান অসামান্য। প্রতিষ্ঠানের কাজের সুবাদেই আমার ভ্রমণের সুযোগ হয়। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরে আমার সঙ্গী ছিলেন দুজন তারকা সাংবাদিক রিয়াসাদ আজিম এবং নাহিয়ান বিন জসিম। দুজনই ওই ট্যুর কাভার করতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়েছিলেন। আমরা ডোমিনিকায় ম্যাচ শেষ করে গায়ানা যাই। ডোমিনিকায় আমরা বাংলাদেশের তিনজন এয়ার কাউন্টারে লাগেজ ট্যাগ করে প্লেনে উঠে বসি। এই প্লেন বারবাডোজ হয়ে গায়ানা যাবে। গায়ানায় ফ্লাইট অন টাইম ছিলো না। কখন আসবে সেটিও ঠিক করে বলতে পারছিলো না কর্তৃপক্ষ।

এয়ারপোর্টে বাস আসার আগে অফিসের কাজ ঝালিয়ে নিচ্ছে মাহমুদ, সহযোগিতা করছে রুদ্র

ঘণ্টা দু’য়েক পরে প্লেন আমাদের নিতে এসেছিলো। যাই হোক, আমাদের প্রতীক্ষার অবসান হলো। আমরা প্লেনে উঠে বসলাম। প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি আমার লাগেজ ওরা নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পাশে বসা রিয়াসাদ আজিমকে বললাম, আরে! দেখুন তো, ওটা আমার লাগেজ না? সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল, হুম, তেমনই লাগছে। বলতে বলতেই সেও সবিস্ময়ে বলল, ভাই ওই দেখুন আমার লাগেজও নিয়ে যাচ্ছে। হায় হায়! প্লেন ছেড়ে দেবে। ওগুলো আবার কই নিয়ে যায়?

আমি কিছুটা আশ্বস্ত করে বললাম, এই প্লেনটা খুব ছোট দেখছেন তো, এটায় আমাদের লাগেজের জায়গা হয়নি। হয়তো পরের ফ্লাইটে চলে যাবে। এখন একটা ঘুম দেন। কারণ সেই রাত ৪টায় আমাদের উঠতে হয়েছে এয়ারপোর্টে আসার জন্য।

উল্টো পাশে বসা ছিল নাহিয়ান। সে তথৈবচ। দিব্যি বসে আছে। লাগেজ কিংবা ভোরে ঘুমের ব্যাঘাত- কোনো বিষয়েই তার হেলদোল নেই। মিটিমিটি হাসছে। আমি বললাম, আপনি হাসলেন? নাহিয়ান কম কথা বলা নরম মানুষ। বেশ সময় নিয়ে হাসিমুখেই বলল, ভাই ওয়েস্ট ইন্ডিজে কিন্তু লাগেজ হারানোর ইতিহাস হরহামেশা। এর আগের ট্যুরে দেব দাদার (দেব চৌধুরীর) লাগেজও হারিয়েছিল। তবে সাত-আট দিন পর ফিরে পেয়েছিল। হারানো লাগেজ ফিরে পেতে যে ভোগান্তি সেটাও পোহাতে হয়েছিল। নাহিয়ান কথাগুলো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেই সিটে হেলান দিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলল! মনে মনে যতই রাগ লাগুক তাকে কিছু বলেও তো লাভ নেই। ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েছে। সেই লাগেজের গন্তব্য কোথায় ছিলো বা এ ঘটনার শেষ পরিণতি আসলে অন্য গল্প। আরেক লেখায় না হয় বলা যাবে। 

নেলসন এয়ারপোর্টে অল্প সময়েই লাগেজ পেলাম। একই ফ্লাইটে পেয়ে গেলাম ক্রিক ফ্রেঞ্জির সাংবাদিক জয়ন্তকে। কম বয়েসী। সাংবাদিকতা শুরু করেছে বছর দু’য়েক হলো। দারুণ সব রিপোর্ট করে ক্রিকেট নিয়ে। জয়ন্ত আর আমি এক এলাকায় হোটেলে উঠবো। জয়ন্ত বলল, ভাইয়া, রুদ্র ভাইয়ের ফ্লাইট এখানে পৌঁছাবে ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যে। উনি আমাকে বলেছিলেন অপেক্ষা করতে। আমি বললাম, ওকে। অলরেডি ১৫ মিনিট হয়ে গেছে। আমিও তোমার সঙ্গে থাকি। আমরা এয়ারপোর্টের ভেতরেই নিরিবিলি একটি কর্নার বেছে বসলাম। এই অবসরে মোবাইল চার্জে দিয়ে একজন একজন করে লাগেজ পাহারায় রেখে ফ্রেশ হয়ে এলাম। টুকটাক ছবিও তুললাম। এর মধ্যেই রুদ্র আমাকে কল দিয়ে জানতে চাইলো- ভাইয়া, আপনি চলে গেছেন? আমি বললাম, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। 

নেলসন এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরে বই এবং গিফট শপে লেখক

রুদ্র চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক। কাজের বাইরে ডানেডিনে ওর সঙ্গে সময় কেটেছে অনেকটা। আজ সকালেও আমরা একসঙ্গে এয়ারপোর্টে এসেছি। তবে ওর ফ্লাইট ছিলো পরে। আমারটা আগে। জয়ন্তকে বললাম, এবার চলো, বেলা যে হলো! রুদ্র বলল, ভাই, বিডিক্রিকটাইমের মাহমুদ অকল্যান্ড থেকে নেলসনের প্লেনে উঠেছে। এখনই পৌঁছে যাবে। এই তিনজনই বয়সে আমার ছোট। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে গেলাম। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই মাহমুদ এসে পড়ল। একগাল হেসে সালাম দিয়ে ‘ভাই’ বলে জড়িয়ে ধরল। দীর্ঘদিন এদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা, আড্ডা; ক্রিকেট মাঠে, প্রেস বক্সে, ঢাকার বাইরে, দেশের বাইরেও। ভালোবাসা, ভালোলাগা এবং একের প্রতি অন্যের সম্মানই হলো এই সুসম্পর্কের মূল কারণ।  

নিউজিল্যান্ড দেশটিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নর্থ আইল্যান্ড এবং সাউথ আইল্যান্ড। নেলসনকে বলা হয়, সিটি অফ সাউথ আইল্যান্ড। ১৮৪১ সালে আরথার ওয়েকফিল্ড নামে একজন ইংরেজ নেলসন সিটি প্রতিষ্ঠা করেন। নেলসনের ডাকনাম নাকি ‘টপ অব দ্য সাউথ’। এই সিটি নাকি দক্ষিণ নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত। তাসমান সাগরমুখি এই শহরের সৌন্দর্য লিখে শেষ করা যাবে না। প্লেনের জানালায় চোখ রেখে অবাকই হতে হয়েছে। তাসমান সাগরের নীল জল একদিকে। আর অন্য পাশে শতশত পাহাড়। আমরা এয়ারপোর্ট থেকে সাঁটল বাসে চড়ে হোটেলে আসার সময় কত উপরে উঠেছি তার ইয়ত্তা নেই। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সবুজের মধ্যে হাজারো ঘর-বাড়ি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সুনসান নিরিবিলি শহরকে অদ্ভুত মোহময় মনে হয়েছে। দানেদিনও সুন্দর নিঃসন্দেহে। তবে আমরা যারা এতো ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত নই তাদের জন্য সৌন্দর্য উপভোগ অনেকটা বাধাগ্রস্ত হবে বৈকি। অন্যদিকে নেলসনের ওয়েদার অসাধারণ! 

নেলসনের পথে

৪২২ বর্গকিলোমিটারের এই শহরে জনসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজারের কাছাকাছি। নেলসনকে নিউজিল্যান্ডের তৃতীয় বৃহত্তম শহর বলা হয়। ডানেডিনে থাকা অবস্থায় বাঙালি যে কয়জনের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সবাই এক বাক্যে বলেছে- দারুণ সুন্দর শহর নেলসন! খুব ভালো লাগবে নাকি এখানে। কথার যথার্থতা আমরাও খুঁজে পেয়েছি এখানে এসে। এই শহর পর্যটকদের অতি আকাঙ্ক্ষার জায়গা। প্রতি বছর এখানে লোকাল আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়, যা নেলসনবাসীর জন্য তথা নিউজিল্যান্ডবাসীর কাছে বড় উৎসবের আমেজ তৈরি করে।

বাসের চালক প্রাণোচ্ছ্বল মানুষ। বাসে বসে আমরা চারদিকের ছবি তোলা আর ভিডিও করায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। বেচারা চালক বুঝতে পেরেছে আমরা এই দেশে প্রথম এসেছি। আমাদের কাছে জানতে চাইলো কোথায় আমাদের দেশ, কবে, কেন এসেছি ইত্যাদি। আমি জানতে চাইলাম তুমি কোন দেশের? মজা করে সুর দিয়ে বলল- সে এই দেশের। আমি বললাম- সত্য করে বলো। ও গর্বের সঙ্গে বলল- ফিলিপিনো। ওর নাম জসুয়া। সিঙ্গাপুরে একসময় গাড়ি চালাত। দুই বছর আগে এখানে চলে এসেছে। আমরা ক্রিকেট সিরিজের কারণে এসেছি শুনে বলল- কে সেরা দল? মাহমুদ বলল নিউজিল্যান্ড। জসুয়া আবারো সুর করে বলল, না না অস্ট্রেলিয়া। আমি তাকে শুধরে দিয়ে বললাম অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু বাংলাদেশ এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যে নিউজিল্যান্ডই ভালো। মাহমুদ অবশ্য এটিই বোঝাতে চেয়েছিল। গুগল ম্যাপ দেখে আমাদের স্টেশনে নামিয়ে আবার মজা করতে করতে হাই, হ্যালো, সি ইউ, বাই বাই বকতে বকতে জসুয়া নিজের রাস্তা ধরল।

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়