করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গের এক দুরন্ত মাতঙ্গিনী
শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম
কলকাতার ময়দান অঞ্চলে মহান বিপ্লবী মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি
শাহ মতিন টিপু : মাতঙ্গিনী হাজরা। একটি বিপ্লবী জীবন, একটি ইতিহাস। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে যার অবদান অনস্বীকার্য। ভারত বর্ষের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামী। ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই মহান বিপ্লবী নেত্রীর। ১৯৪২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তদনীন্তন মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানার সামনে ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশের গুলিতে তিনি মারা যান। কলকাতার ময়দান অঞ্চলে মহান বিপ্লবী মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি এখনো তার শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যতদূর জানা যায়, মাতঙ্গিনীর জন্ম ১৮৭০ সালের ১৯ অক্টোবর। পশ্চিমবঙ্গের তামলুকের হোগলায়। সাধারণ এক কৃষক ঠাকুরদাস মাইতির ঘরে। অল্প বয়সেই তার বিয়ে হয় ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে। ১৮ বছর বয়সেই স্বামীকে হারান মাতঙ্গিনী হাজরা। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। আনুষ্ঠানিক কোন শিক্ষাদীক্ষা ছিল না। ছিলেন গান্ধীর অনুসারী। তার আরেক পরিচয় গড়ে উঠেছিল `গান্ধী বুড়ি` নামে। ১৯০৫ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৩২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন।
তার বিপ্লবী জীবন ছিল ক্ষুরধার। ব্রিটিশের লবণনীতির প্রতিবাদে তার লড়াই ছিল দুরন্ত। তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসেরও সদস্য ছিলেন। গান্ধী আদর্শমতে, নিজের হাতে চরকা কেটে খাদি কাপড়ও বানিয়েছেন তিনি। মৃত্যুর সময়ও তিনি কংগ্রেসের পতাকা উঁচু হাতে ধরেছিলেন। ডান্ডি মার্চ, অসহযোগ আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য।
স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে মেদিনীপুরের নারীদের যোগদান ছিল ইতিহাসে এক মাইলফলক ঘটনা। মাতঙ্গিনী হাজরা সে ইতিহাসেরই এক জ্বলন্ত বারুদ। তাই মেদিনীপুরে ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন আলাদা রূপ পেয়েছিল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কংগ্রেস সদস্যেরা মেদিনীপুর জেলার সকল থানা ও অন্যান্য সরকারি কার্যালয় দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা নেয়। উদ্দেশ্য ছিল জেলা থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। প্রধানত মহিলা স্বেচ্ছাসেবক সহ ছয় হাজার সমর্থক তমলুক থানা দখলের উদ্দেশ্যে একটি মিছিল বের করে। প্রাণবিনাশী এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন মাতঙ্গিনী হাজরা।
দেশবাসীদের উদ্দেশ্যে বলা স্বামী বিবেকানন্দর ওই সময়ের একটি বক্তব্য মাতঙ্গিনীকে বিশেষভাবে স্পর্শ করেছিল। স্বামীজি বলেছিলেন- ‘এখন থেকে আগামী পঞ্চাশ বছর তোমাদের একমাত্র উপাস্য দেবতা হবেন- জননী-জন্মভূমি। তার পূজো করো সকলে।’
এ সময়টিতেই গান্ধীজি পরিচালিত আইন অমান্য আন্দোলনের (১৯৩০-৩৪) ঢেউ মেদিনীপুরেও আছড়ে পড়ে। বিপ্লবতীর্থ মেদিনীপুরের শাসনব্যবস্থা তখন প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে সন্ত্রাসবাদীদের দাপটে। তিন-তিনজন জাঁদরেল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটপেডি, গডলাস ও বার্জ প্রাণ হারিয়েছেন সন্ত্রাসবাদীদের হাতে। এক কথায় বলা যায়, এ সময় শাসককুল মেদিনীপুরের নাম শুনলেই বিশেষভাবে আতঙ্কিত ও দিশেহারা হয়ে পড়তেন।
১৯৩০ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে শুরু হল লবণ সত্যাগ্রহ আইন অমান্য আন্দোলন। দেশবাসীর পক্ষে সমুদ্র-জল থেকে লবণ সংগ্রহ করা তখন বেআইনি ছিল। দেশের যে যে জায়গায় লবণ তৈরির সুযোগ ছিল সত্যাগ্রহীরা সেইসব জায়গায় লবণ তৈরি করে আইন-অমান্য করতে লাগলেন। মেদিনীপুরের কাঁথিতেই প্রথম লবণ তৈরি শুরু হল। খবর পেয়েই পুলিশ গ্রামে ঢুকল। ঘর-বাড়ি সব জ্বালিয়ে দিল। নানান অত্যাচার শুরু করে দিল। তবুও মেদেনীপুর শায়েস্তা হল না। শাসককুল চাইল লবণ তৈরির একচেটিয়া অধিকার তাদের হাতে থাকুক। কিন্তু দেশের মানুষ চাইল লবণ তৈরির ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা।
আইন অমান্য আন্দোলনে মাতঙ্গিনী ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে আলিনান গ্রামের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। খবর পেয়েই পুলিশ এল। মাতঙ্গিনী গ্রেপ্তার হলেন। সঙ্গে রইলেন অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকরাও। তারাও গ্রেপ্তার হলেন। এ দুর্ভোগ অবশ্য বেশিক্ষণ সইতে হয়নি। কিছুটা পথ হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে মাতঙ্গিনীকে ছেড়ে দেওয়া হল।
রাইজিংবিডি/মানিকগঞ্জ/২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪/টিপু
রাইজিংবিডি.কম