ঢাকা     সোমবার   ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও আমাদের করণীয়

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:১৬, ২ ডিসেম্বর ২০১৩   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও আমাদের করণীয়

এ.এস.এম সারওয়ার

এ.এস.এম সারওয়ার
৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এই দিবসটি অত্যন্ত তাৎপর্যময়। এবারের এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো: প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে সমন্বিত সমাজের দরজা খুলে দাও।

১.
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই, এল, ও) এর মতে “একজন প্রতিবন্ধী হচ্ছে তিনি, যার স্বীকৃত শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিগ্রস্ততার কারণে যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা কমে যায়।”

জাতিসংঘের ৩৭তম সভায় গৃহীত সংঙ্গানুযায়ী প্রতিবন্ধীতা হচ্ছে, এমন কোনো বাঁধা বা সীমবদ্ধতা (শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিগ্রস্ততার কারণে উদ্ভূত) যা একজন মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে পূর্ণভাবে ব্যাহত করে।

অপর দিকে প্রতিবন্ধিতার কারণে ব্যক্তি যদি সামাজিক নেতিবাচক মনোভাব ও কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতার দরুন স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধার সম্মুখীন হয়, তবে তাকে আমরা Handicapped বা সামাজিক প্রতিবন্ধী বলতে পারি ।

বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ভাবে প্রতিবন্ধীতার শিকার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আচরণগত বাধার সম্মুখিন হয়। ফলে তারা সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের মত কার্যকরী ও পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহনকারী হিসেবে অন্যদের মতো আত্মপ্রকাশ করতে পারে না।

তারা অসমানুপাতিক ভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্রতম ও মৌলিক সম্পদ যেমন শিক্ষা, চাকরী, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক ও আইনগত সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত। তাদের মধ্যে মৃত্যুর হারও বেশি। তা স্বত্ত্বেও উন্নয়নের মূল আলোচ্যসূচী ও এর প্রক্রিয়াতে প্রতিবন্ধী বিষয়টি উপেক্ষিত।

২০০৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক সম্মেলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী আন্দোলন জোরালো অগ্রগতি লাভ করে। পরবর্তীতে ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার মূল ভাব ছিল, এগিয়ে যাওয়ার উপায়: ২০১৫ এবং এর কাছাকাছি সময়ের মধ্যে প্রতিবন্ধীতাকে উন্নয়নের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্তকরা।

২.
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে এখনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। তবে বিভিন্ন তথ্য মতে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪ শতাংশ ব্যক্তি প্রতিবন্ধীতার শিকার। এসকল প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ সাধন ও পূনর্বাসনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ সমূহে নানারকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে ।

যদিও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সরকারি-বেসরকারি সংস্থা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তথাপি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষা ও চাকরী ক্ষেত্রে তারা খুব কম সুযোগ পায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলো নিম্নরূপ-

সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব :  প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পর্কে সমাজে এখনো তেমনভাবে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের শিকার হয়। এ সকল অন্ধবিশ্বাসের ফলে মানুষ তাদের অবজ্ঞা করে।

সামাজিকভাবে বিব্রতকরণ : যে সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায় সম্বল আছে তারা কিছুটা উন্নত জীবন লাভকরতে পারে। আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশের পরিবার ও সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অভিশাপ হিসাবে বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে নারী ও শিশু প্রতিবন্ধীদের অবস্থা আরো শোচনীয়।

স্বাস্থ্য ও পূণর্বাসন : বেশির ভাগ তথ্য মতে ৭০% প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন প্রয়োজন। এনজিও গুলোর মাধ্যমে শহরে কিছু সংখ্যক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পুর্নবাসনের সুযোগ পেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রোগ্রাম থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিচ্ছিন্ন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও চাকরীর সুযোগ খুব কম।

৩.
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত :

  •  সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা;
  •  শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা;
  •  প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তিগত বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা, যাতে করে তারা আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে আয় করতে পারে;
  •  প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্ম সংস্থান এর জন্য আলাদা শিল্প কারখানা স্থাপন করা উচিত। এর জন্য তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে;
  •  প্রতিবন্ধীদের মননশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করা উচিত। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অলিম্পিকের মত আসরে (প্রতিবন্ধীর জন্য বিশেষ অলিম্পিক) সাফল্য পেয়েছে;
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে সমাজ কর্মীদের ভূমিকা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজকর্মের কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমন-(ক) সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি কৌশল (খ) জনগণকে উদ্বৃদ্ধ করণ কৌশল (গ) গণসংযোগ ও সম্পৃক্তকরণ কৌশল (ঘ) সমস্যা চিহ্নিত করণ ও বিশ্লেষণ কৌশল (ঙ) সম্পদ আহরণ ও সদ্ব্যবহার কৌশল (চ) সক্ষমতা ও অভিযোজন ক্ষমতা অর্জন কৌশল (ছ) মানব সম্পদ উন্নয়ন কৌশল প্রভৃতি;
  • চাকরী ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীর কোটা বৃদ্ধি করা উচিত;
  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যানে আইন প্রনয়ণ ও তার প্রয়োগ করতে হবে;
  • প্রতিবন্ধী বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে;

 

৪.
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজে অবহেলিত ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত। তাদের পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তাদের জীবনযাত্রার মানও অতি নিম্ন। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে সকলকে। তাদের পূণর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুণর্বাসনের কাজটি বেশ দূরূহ। বিশেষ করে যুগ যুগ ধরে এদেশে প্রতিবন্ধীতার কারণ সম্পর্কে পোষণকৃত ধারণা দূরীকরণ এবং প্রতিবন্ধীদের প্রতি জনগণের মনোভাবের পরিবর্তন বেশ কঠিন কাজ। এজন্য সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ফলপ্রসূ কর্মসূচীর বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস-২০১৩ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নেয়া যেতে পারে যেমন: প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের কর্তাব্যক্তি, বিদেশি দাতা সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যদের নিয়ে বিষয় ভিত্তিক আলোচনা, র‌্যালি প্রভৃতি।

এ সকল কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রে যাতে অন্তর্ভূক্ত করা যায় তার জন্য জোরালো জনমত তৈরি করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে উৎসবের আয়েজন এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের বিভিন্ন খেলাধূলা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতার আয়োজন করা যেতে পারে।

সম্প্রতি প্রতিবন্ধীদের কল্যান সাধন ও তাদের অধিকার আদায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওডিডি ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই সংগঠনটি যাত্রা শুরু করেছে।

আসুন বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস-২০১৩ কে সামনে রেখে আমরা সকলে মিলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করি এবং সেই সাথে সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ি।


লেখক : উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী

[email protected]

 

রাইজিংবিডি / এস / এলএ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়